ঘুরে এলাম রাশিয়া

জল্পনা–কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে রাশিয়া ঘুরে এলাম। পৃথিবীর সব থেকে বড় এ দেশটি আমাদের কাছে একরকম অজানাই। আমরা তেমন একটা এই দেশ নিয়ে শুনতেও পাই না। তবে কেমন করে যেন আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েই গেল। এত বড় দেশে প্রায় এক মাস ঘুরার সুযোগ আমার মতো মধ্যবিত্ত একা এক মেয়ের জন্য অলীক কুসুম কল্পনাই বটে। দেখা হয়েছে ৬টা দেশের সীমান্ত, ৫টা সাগর, ৪টা প্রদেশ আর এক মাসে ১০ বার বিমানে চড়ার সৌভাগ্য। আমার এখন পর্যন্ত জীবনে এতবার বিমানে ওঠা হয়নি। সেই গল্প আপনাদের শেয়ার করব, বলব চারটা শহরের গল্প। নদীর আর সাগরের গল্প।

কীভাবে গিয়েছি

আমি গিয়েছিলাম রাশিয়ার বিখ্যাত বিশ্বকাপ করা হোস্টিং সিটি সোচিতে কনফারেন্স যোগ দিতে। কনফারেন্সে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর। ৬ মাস ধরে দফায় দফায় বিভিন্ন আপডেট আর আপলোড চালিয়ে কনফারেন্স কনফার্মেশন মেইল পেলাম। দু–তিন দফা দূতাবাসের চক্কর কাটিয়ে রাশিয়ার ভিসাও পেলাম। মূল কনফারেন্স ছিল আট দিন।

কেমন ছিলো সোচি শহর?

কল্পনার মতো করে শহরটা সাজিয়েছে রুশ সরকার। মূলত শহরটা তৈরি হয়েছে ৫০ হাজারের ওপর গেস্ট হোস্টিংয়ের জন্য। কৃষ্ণ সাগরের পাশে এই শহর, সবুজ আর শান্ত। রাশিয়ার রাজা–বাদশাহরা এ শহরে অবকাশ কাটাতে আসতেন। সামারে এ শহরে পর্যটকদের ঢল নামে।

মূল শহর গোছানো। লাইনের বাস, ট্রেন, ট্রাম—সবকিছুই নাগালের মধ্যে। মোবাইল অ্যাপস ধরে, ক্যাশ কিংবা কার্ডে পেমেন্ট করে অনায়াসে আপনি ভ্রমণ করতে পারবেন। রুশ সরকার আমাদের ফ্রি সিম আর ব্যাংক কার্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তবে আপনি সহজেই পাসপোর্ট আর মাইগ্রেশন কার্ড দিয়ে সিম আর ব্যাংক কার্ড করতে পারবেন। অত ঝাক্কি–ঝামেলা পোহাতে হবে না। আমি যদিও সিমের ১০ হাজার মানুষের লাইনে দাঁড়াতে চাইনি, বাংলা টাকায় ৭–৮ শ টাকা খরচ করে সিম আর ১ মাসের নেটের প্যাকেজ কিনে নিয়েছিলাম। সোচি ভ্রমণ খুব স্মুথ ছিলো, আমাদের চমৎকার খাবার আর আয়েশি হোটেল। অফুরন্ত ইভেন্ট আর এডুকেশনাল সেশনে চোখের পলকে দিন শেষ। আর সাগর পারে রাতগুলো, ভেসে গেল। দিন চলে এল আমাদের, অগত্যা সোচি ত্যাগ করার প্রস্তুতি নেওয়া লাগল। আমাদের বিমানবন্দরে দিয়ে আসল। আমি সোচি থেকে বিমানযোগে মস্কো চলে এলাম। মস্কো থেকে একদম পৃথবীর শেষের শহর মুরমাস্ক। শুরু হলো আমার সোলো ট্রাভেল।

মুরমাস্ক শহর–পৃথিবীর শেষ গ্রাম

মস্কো শহর থেকে বিমান যোগে চলে গেলাম মুরমাস্ক। এখানে আমি গিয়েছিলাম, পৃথিবীর শেষ গ্রাম টেরিবার্কাতে। অসাধারণ সে অনুভূতি। ৪ জন রাশিয়ান মেয়ে আর আমি মিলে যাই সে গ্রামে। কী ভয়াবহ সুন্দর এই বরফ! দেখেছি সি গাল, গ্রিক মিথিওলজির রেইন্ডার, স্লেজ গাড়ি টানা হাস্কি কুকুরের ফার্ম। এদের সঙ্গে খেলেছি। খাবার খাইয়েছি। টেরিবারকা থেকে আর্ক্টিক সাগরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখেছি। ঠান্ডা এত যে পাঁচ–ছয়টা লেয়ারে জামাকাপড় পরেও জমে গিয়েছি! কিন্তু তবু ভালো লাগার রেশ যেন যায় না।

নর্দান লাইট/অরোরা হান্ট-

এই শহরেই আমার জীবনের সব থেকে সুন্দর জিনিস দেখেছি। আমি প্রফেশনাল একজন গাইড বুক করেছিলাম, আমার পরিচিত এক ভাই এর রেফারেন্সে, যাঁরা খুব প্যাশনেট নর্দান লাইট হান্টিং করে। আমার গাইড ইয়োরাস্লভের ডেডিকেশনের গল্প বললে কম হয়ে যাবে। সারা রাত ধরে আমাদের নর্দান লাইট হান্টিং চলে। রাতের আকাশে নিয়ন লাইটের দেখা পাওয়া মার্চ মাসে এত সহজ নয়। আমরা ২০–২১ বার গাড়ি থেকে নেমেছি। মাইলের পর মাইল ছুটেছি। অবশেষে ধাপ করে নেমে এল বরফ রাজ্যে আকাশ থেকে সেই সবুজ নিয়ন আলো। আমার গাইড আমাকে বলল, তুই খুব লাকি। আমি তাকিয়ে দেখলাম বরফ সবুজ হয়ে গেছে, পাইন বনে নেমে এসেছে নর্দান লাইট।

মস্কো ব্যাক করলাম বিমানযোগে, এ শহর ঘোরা শেষে। মস্কো গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, বিমানের টিকিট পরিবর্তন করে পেছাব। সেন্ট পিটার্সবার্গ যাব।

সেন্ট পিটার্সবার্গ

মস্কো এসে চলে গেলাম সেন্ট পিটার্সবার্গ। একি শহর, নাকি ছবি! মনে হচ্ছে ইতালির ভেনাসে আমি। সব কিছু সেই ৩০০ বছর আগের করা। এখনো কত আধুনিক। যা দেখি তাতেই অবাক হই। জারদের কি স্থাপত্য শৈলী! কী সেই রাজপ্রাসাদ। স্টেট হেরমিটেজ, কাজান কেথেড্রাল, সেভিয়র অব দ্য স্পিল্ড ব্লাড। কী অবাস্তব স্থাপত্য, তবু কত বাস্তব। নদীগুলোর বরফ ভাঙতে শুরু করেছে। বরফ গলা জহির রায়হানের নদী। আমি সেই নদীর বরফের মতো। আমার মনেও গ্রীষ্মের উষ্ণতা লেগেছে। নিজেকে বহমান নদী মনে হচ্ছে। আমি রাস্তায় ঘুরতাম, ঘুরতাম নদীর ধারে, বাসে, ট্রামে। আর মেট্রো! সে এক এলাহী কাণ্ড। পৃথিবীর গভীরতম মেট্রো বোধ হয় এই সেন্ট পিটার্সবার্গ।

মস্কো

সব শেষে আসি মস্কো ভ্রমণে। আমি দফায় দফায় মস্কো এসেছি এই অউরো ভ্রমণে, মস্কো ছিলো আমার রেস্টিং জোন, আর সব শহরে বিমানে ফ্লাই করার কমন পয়েন্ট। মস্কোর মেট্রো সিস্টেম আমার মাথা খারাপ করে ছেড়েছে। একবার ১ ঘণ্টার জন্য হারিয়েও গিয়েছিলাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে হোটেলে ফিরেছি। পুরো শহর যেন পাতাল পুরী। মাটির ওপরে যত না কিছু, মাটির নিচে তার কয়েকগুণ বেশি এলাহী কাণ্ড! কি নেই! শপিং মল থেকে শুরু করে সব কিছুই। পরে জানতে পারলাম মেট্রোগুলো কেন এত গভীরে করেছে। যেন যুদ্ধ লাগলে এগুলোকে বাঙ্কার হিসাবে ব্যবহার করেতে পারে। মস্কোর আকাশ খুব সুন্দর আর পরিষ্কার।

কোথায় থাকবেন

আমার মতো বাজেট ট্রাভেলার হলে থাকার জন্য বেস্ট অপশন সস্তা হোস্টেলগুলো। সব ফেসিলিটি ইনক্লুডিং কিচেন। সব থেকে দারুণ কথা, এখানে আপনি একা নন। দুনিয়াজুড়ে দেশ–বিদেশের বন্ধু বানানোর চমৎকার জায়গা এ হোস্টেলগুলো। আমি যেহেতু বেশিরভাগ একাই ট্রাভেল করি, পরিচিত বন্ধু না থাকলে আমি হোস্টেলগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করি। এগুলো নিরাপদ, সস্তা, আর মূল শহরেই হয়। কীভাবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাবেন, যদি আপনার একটা ফোন থাকে আর তাতে নেট থাকে, সঙ্গে রাশিয়ান একটা কার্ড—এ দেশ আপনার! যে কোনো জায়গায় কার্ড দিয়েই পেমেন্ট করে বাসে, ট্রামে, মেট্রোতে, প্লেনের টিকেট কেটে চলতে পারবেন। আর ফোনে অ্যাপস আছে ট্রান্সলেটর, ম্যাপ, টেক্সির ম্যাপ। সব ব্যবহার করে আপনি স্মুথলি মুভ করতে পারবেন। মনে জোর আর বুকে একটু সাহস আর এক টুকরো হাসি, ব্যস এই টুকুই যথেষ্ট।

সতর্কতা—

রাশিয়ার ইমিগ্রেশন শেষে তারা একটা মাইগ্রেশন কার্ড দেয়। এটা হারিয়ে গেল পাসপোর্ট হারানোর মতোই কঠিন অবস্থা হবে। এটা একদম শেষ পর্যন্ত আপনার সঙ্গে থাকা লাগবে। রাশিয়ার মানুষ দারুণ। ভাষা না বোঝা একটা সমস্যা, এ ক্ষেত্রে ট্রান্সলেটর আপনাকে সাহায্য করবে। ভ্রমণে আপনি মানেই বাংলাদেশ, এমন কিছু করবেন না, যেটা আপনার দেশের পরিচয়কে হেয় করে। রাশিয়ানরা বাংলাদেশিদের খুব ভালোবাসে।