ভোলার প্রাকৃতিক সাজের পসরা চর কুকরি-মুকরি

বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে নদীবেষ্টিত গাঙ্গেয় দ্বীপজেলা ভোলা। এর আয়তন ৩ হাজার ৪০৩ বর্গকিলোমিটার। রুপালি ইলিশ, ধান আর সুপারির জন্য এ জেলা সুপরিচিত। ভোলার সর্বদক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে চর কুকরি-মুকরিসহ অনেকগুলো বিস্তৃত চরে ম্যানগ্রোভ বন আর সাগরের সৈকতে মিলে অপরূপ সৌন্দর্যের আধার হিসেবে প্রকৃতিপ্রেমীদের নজর কাড়ছে। এক পাশে সৈকত, আরেক পাশে বন; সঙ্গে শোঁ শোঁ শব্দ। সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের মায়াবী দৃশ্য যে কারও মনে অদ্ভুত দোলা দেবে। এখানে না এলে প্রকৃতির অবারিত সাজের পসরা বর্ণনায় বোঝানো কঠিন।

চর কুকরি-মুকরি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ট্রলার বা স্পিডবোটে মাঝারি খালের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় দুই পাশের ম্যানগ্রোভ বন দেখে সুন্দরবনের অবয়ব ভেসে ওঠে। পায়ে হেঁটে বনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হবে, যেন সুন্দরবনের কোনো অংশ। সুন্দরী, গেওয়া, গরান ও শ্বাসমূলীয় গাছের বন এটি। এ ছাড়া গোলপাতার সমাহারও চোখে পড়ার মতো। বনে রয়েছে হরিণসহ নানা প্রাণীর বিচরণ। কুকরির পূর্বাংশে নারকেলবাগান। নামে নারকেলবাগান হলেও নানা প্রজাতির বৃক্ষরাজির আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে সূর্য। বনের ভেতরে যাওয়ার জন্য গামবুট অথবা কেডস উপযুক্ত। অন্যথায় শ্বাসমূলে পা রক্তাক্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। নদীর পাড় আরও মুগ্ধতার। এর পাড় যেন শুভ্রতায় মোড়ানো। কারণ, সাদা বকের সমারোহ থাকে সেখানে। শীতের সময় পরিযায়ী পাখি এ এলাকাকে দেয় ভিন্নমাত্রা। এ চরে বেড়ানোর জন্য শীতই যথোপযুক্ত।

কুকরি-মুকরির শীতকালের চিত্র মুগ্ধ হওয়ার মতো। বিভিন্ন প্রজাতির পরিযায়ী পাখির কলতানে মুখর হয়ে ওঠে এসব অঞ্চলের চারপাশ। পরিযায়ী পাখিদের আগমনে চরাঞ্চলগুলো যেন নতুন রূপ ধারণ করে। এ ছাড়া এখানকার সমুদ্রসৈকতটিও বেশ পরিচ্ছন্ন ও নিরিবিলি। দেশের অন্যান্য পর্যটনকেন্দ্রগুলোর তুলনায় কুকরি-মুকরির চিত্র কিছুটা ভিন্ন। মাইলের পর মাইল বৃক্ষরাজির বিশাল বনভূমি কুকরি-মুকরিকে সাজিয়েছে অদ্ভুত সবুজের চাদরে। তবে গ্রীষ্ম বা বর্ষায় পরিযায়ী পাখি দেখা না গেলেও ম্যানগ্রোভ বন জেগে ওঠে স্বমহিমায়। ফাল্গুনের ছোঁয়া পাওয়ার পরপর গাছের পাতা, ফুল-ফলে যেন যৌবন-সময় খেলা করে। বনের ভেতর মরা খালগুলোও পানিতে ভরে যায়। ওই সময় ট্রলারে চরে বনের সব প্রান্তে যাওয়া যায়। যেটা শীতে সম্ভব হয় না।  

চর কুকরি-মুকরির ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে একটি খাল। খালটির নাম ভাড়ানি খাল। মেঘনার বিশাল বুক থেকে বয়ে গিয়ে খালটি পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। এখানকার ধু ধু বালিয়াড়ির ওপর দাঁড়ালে সাগরের শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাবে না। স্থানীয় মানুষ স্পটটিকে বালুর ধুম নামে ডাকে। একটু সামনে এগোলেই ঢালচর। এরপরই বঙ্গোপসাগর। এখানে উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়া দেখলেই মনে পড়ে যাবে কক্সবাজার কিংবা কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের কথা।

এখানে বসেই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কুকরি-মুকরির অন্যতম আকর্ষণ সাগরপাড়। এখানে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত কিংবা সূর্য ডোবার দৃশ্য ভ্রমণপিপাসুদের মুগ্ধ করবে। চর কুকরি-মুকরিতে ডুবন্ত সূর্যের লাল, হলুদ, কমলা আভা সবুজরঙা চর কুকরি-মুকরির বনে ছড়িয়ে পড়ে বনটিকে আরও মায়াবী করে তোলে।

যাওয়ার পথ

ঢাকা থেকে লঞ্চে সরাসরি যেতে পারবেন ভোলা জেলার চরফ্যাশনে। সেখান থেকে মোটরসাইকেল কিংবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে চর দক্ষিণ আইচা এলাকার চর কচ্ছপিয়া ঘাটে। এরপর চর কচ্ছপিয়া ট্রলার ঘাট হয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা অথবা বেশ খানিকটা জলপথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছানো যাবে চর কুকরি-মুকরি অথবা তারুয়া দ্বীপে। লক্ষ্মীপুর থেকে যেতে হলে মজু চৌধুরী লঞ্চ ও ফেরিঘাট থেকে লঞ্চ, ট্রলার, স্পিডবোটে ভোলার ইলিশা ঘাট; সেখান থেকে অটোরিকশায় ভোলা শহরে। শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে চরফ্যাশনের বাসে করে চরফ্যাশন গিয়ে পূর্বনির্দেশিত পথে।  

থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা

এ চরে থাকার ব্যবস্থার মধ্যে চর কুকরি-মুকরি বাজারের পাশে বন বিভাগের একটি রিসোর্ট রয়েছে। সেখানে থাকতে পারেন। বাজারে হানিফ নামের একটি হোটেল রয়েছে। রিসোর্ট আর ইউনিয়ন পরিষদে খাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে বেশ কয়েকটি হোম স্টে সার্ভিস চালু আছে। সেখানে স্বল্প খরচে থাকা যায়।

লেখক: মোবাশ্বির হাসান শিপন, শিক্ষক, সংগঠক