কালাপাহাড়ের গল্প

প্রথম আলো ফাইল ছবি

সিলেট বিভাগের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের নাম কালাপাহাড়। এর উচ্চতা ১ হাজার ৮০ ফিটের কাছাকাছি। পার্বত্য চট্টগ্রামে এর থেকে তিন গুণ বেশি উচ্চতার অনেকগুলো পাহাড় আছে। এমনকি বান্দরবানে ২ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার ৮০০ ফুট উঁচু পাহাড়ে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। তাহলে কালাপাহাড়ের বিশেষত্ব কী? সে কথায় ধীরে ধীরে আসছি।

সকালবেলা আসগরাবাদ টি এস্টেটের গেটের কাছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নেমে সব ক্লান্তি নিমিষেই উধাও। গতকাল রাত দুইটায় বাস ছেড়েছে সায়েদাবাদ থেকে। সারা রাত বাসে চড়ে, সকালে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চড়ার পর ছয় থেকে সাত ঘণ্টা পাহাড়ে হাঁটার শক্তি অবশিষ্ট আছে কি না কিছুটা শঙ্কায় ছিলাম। কিন্তু চা–বাগানের গেটের কাছে আসার পর মস্তিষ্কের একটা অংশ নিঃশব্দে বলে উঠল, ‘দু-একটা দিন হোক নিয়ম ভাঙার দিন।’

বেলা ১১টা বাজলেও সুয্যি মামার ঘুম তখনো ভাঙেনি। আজ সারা দিন মামা যদি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পার করে দেন, তাহলে আমাদের জন্য সোনায় সোহাগা। চা–বাগানের মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা ছোট রাস্তা ধরে আমরা হেঁটে যাচ্ছি। গত রাতে বৃষ্টি হওয়ায় চাগাছগুলো ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে আছে। চারপাশে সবুজ। মনে হচ্ছে, অনেক এলাকাজুড়ে চাগাছ দিয়ে স্নিগ্ধ সবুজ রঙের আলপনা করা হয়েছে শিল্পীর হাত দিয়ে। একটু পরই সেই চা–শিল্পীদের দেখা মেলে। দল বেঁধে নারীরা লাইন ধরে চা–পাতা তুলছেন।

আমরা আসগরাবাদ চা–বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে থাকি। কোথাও কোথাও রাস্তা দুই দিকে ভাগ হয়েছে। আশ্চর্য বিষয় হলো এ পথে পথিকের দেখা মেলে অনেকক্ষণ পরপর। চা–বাগানের শেষে পাহাড়ি রাস্তা শুরু। তবে এখানে রাস্তা প্রায় সমতলই বলা যায়। একটু পরপর নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পার হতে হয়। হঠাৎ রাস্তায় দুই–একজন মানুষের দেখা মেলে। জঙ্গলের ভেতর থেকে তাঁরা পানের বোঝা বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন।

পথজুড়েই ঝিঁঝি পোকার ডাক, বিভিন্ন পোকা ও পাখির শব্দ, জঙ্গল—এসব কিছু শহুরে জীবনের হারিয়ে যাওয়া অনুষঙ্গকে মনে করিয়ে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে একটা জায়গা থেকে বেশ দূরে কালাপাহাড়কে দেখা যায়। সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে। আমাদের উৎসাহ বেড়ে যায়। ওই পাহাড়ের চূড়ায় উঠব! প্রায় ১ ঘণ্টা হাঁটার পর বেগুনছড়া পুঞ্জির কাছে পৌঁছে যাই। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে হেঁটে এলে বড় একটা খাসিয়া গ্রামের দেখা মেলে। অনেকগুলো বাড়িঘর থাকলেও মানুষের তেমন দেখা মেলেনি। এ পাড়া থেকে গাইড নিতে হবে। গ্রাম–প্রধান আমাদের বললেন, এখানে কোনো গাইড নেই।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

সবাই পান তুলতে গেছে। একজন বাঙালি পান ব্যবসায়ী এগিয়ে এসে আমাদের রক্ষা করেন। তিনি গাইড হিসেবে আমাদের সঙ্গে যাবেন। খাসিয়া পাড়া–প্রধানের বাড়িতে ব্যাগ রেখে আমরা রওনা দিলাম কালাপাহাড়ের উদ্দেশে।

বেগুনছড়া পুঞ্জির পর আর কোনো বাড়িঘর নেই। গাইডের সঙ্গে গল্প করতে করতে আমরা হাঁটতে থাকি। নাম জিজ্ঞেস করায় গাইড বলে, ‘আমার নাম সামসু মিয়া। কোপা সামসুর সামসু।’ সে জানায় এই এলাকার পাহাড়িদের মূল ব্যবসা হলো পানপাতা। স্থানীয় খাসিয়ারা এই পানপাতা সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন। আমরা আস্তে আস্তে ওপরের দিকে উঠতে থাকি। সূর্য ওঠেনি। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বৃষ্টি এলে আমাদের খবর আছে।

যে রাস্তা দিয়ে ওপরের দিকে উঠছি, বৃষ্টি হলে এই রাস্তা দিয়ে নিচে নামা খুবই কঠিন হবে। জনপ্রতি দুই লিটার করে পানি সঙ্গে নিয়েছিলাম। এই পানির বোতলকেও অনেক ভারী মনে হয়। কিছুদূর পরপর বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে আস্তে ওপরের দিকে উঠতে থাকি। একটু পর দলের একজন হাল ছেড়ে দেন, তাঁর পক্ষে আর ওপরে ওঠা সম্ভব নয়।

তাঁকে দলের বাকি সবাই উৎসাহ ও সাহস দিয়ে সামনে নিয়ে যাই। কিছুদূর যাওয়ার পর আরেকজন হাল ছেড়ে দেন। সবাই মিলে নাশতার বিরতি দিয়ে, বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটতে থাকি। আসলে কালাপাহাড়ের উচ্চতা ১ হাজার ৮০ ফিটের পুরোটাই হেঁটে উঠতে হয়। অর্থাৎ প্রায় ১০০ তলা একটা বিল্ডিং সিঁড়ি দিয়ে ওঠার মতো কষ্ট। ঢাকাতে ৮ তলা একটা বিল্ডিং সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে উঠলেই জিহ্বা বের করে হাঁপাতে থাকি। সেখানে ১০০ তলা মানে বুঝতেই পারছেন! বেশ কয়েকবার বিশ্রাম নিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হই।

চূড়ার শেষের পথটুকুর চারপাশে বাঁশগাছ। এমনকি চূড়াতে ওঠার পরও চারপাশে শুধু বাঁশ আর বাঁশ। বাঁশগাছের ভিড়ে আশপাশের কিছুই দেখা যায় না। চূড়াতে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা ফিরতি যাত্রা শুরু করি। পাহাড়ের ওপর দিকে ওঠা কষ্টকর কিন্তু নিচে নামা বিপজ্জনক। ভারসাম্য রাখতে না পারলে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে যখন–তখন। বর্ষার দিনে এ পাহাড়ে ওঠা ও নামা খুবই কষ্টকর। তবে পাহাড়ে ঘোরাঘুরি যাঁদের নেশা, তাঁদের জন্য কালাপাহাড় সুন্দর ও আদর্শ জায়গা।

কালাপাহাড় যাওয়ার জন্য বাস বা ট্রেনে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় রবির বাজার আসতে হবে। সেখান থেকে আসগরাবাদ চা–বাগান। চা–বাগানের গেট থেকে গাইড নেওয়া সুবিধাজনক।

রবির বাজার থেকে শুকনা খাবার, স্যালাইন, পানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিয়ে নিতে হবে। আসগরাবাদ চা–বাগান থেকে যাত্রা শুরু করে আবার ফিরে আসা পর্যন্ত প্রায় ৬ ঘণ্টা সময় লাগবে, শারীরিক ফিটনেস খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যই কোনো ধরনের অপচনশীল দ্রব্য যেখানে–সেখানে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে।