ঢাকা–বরিশাল লঞ্চে রোমাঞ্চকর যাত্রা

ছবি: ইশতিয়াক চৌধুরী

চারদিকে শান্ত পরিবেশ। আকাশে ফিনিকফোটা জোছনা। দূরে টিম টিম করে বাতি জ্বলছে। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস। চুলগুলো উড়ছে এদিক–সেদিক। মুগ্ধতায় মন ছুঁয়ে গেছে। নীরবেই দাঁড়িয়ে আছেন রেলিং ধরে। এমন সুন্দর, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ চান। নিজেকে একটু ভিন্নতার স্বাদ দিতে বড় ইচ্ছা হয়। তবেই আপনাকে লঞ্চে করে বরিশাল যেতে হবে। ধান নদী খাল—এই তিনে বরিশাল। কেবল লঞ্চে বরিশাল গেলেই সম্ভব এমন দৃশ্যপটের মুখোমুখি হওয়া। বাস, ট্রেন, বিমান কত কিছুই না আছে যাতায়াতের বাহন। তবে লঞ্চ যেন একটু বেশি ব্যতিক্রম। অন্য রকম এক ব্যাপার।

নদীর বুক চিরে চলমান নৌযান আপনাকে ভিন্নতার স্বাদ দেবে। লঞ্চ বলতেই আসলে এখন যা, তা কিছুদিন আগেও ছিল। বলা যেতে পারে এখনকার লঞ্চগুলো যেন থ্রি স্টার হোটেল। কি নেই এখন। ওয়াইফাই, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, নামাজের জায়গা, উন্নত মানের খাবার, লিফট আরও কত কী? মনটাকে প্রশান্তি দিতেই লঞ্চযাত্রাকে বেছে নিই বারবার। আরামদায়ক যাত্রা। একটুও কষ্ট হয় না। সে কারণে লঞ্চ বাহন হিসেবে বরাবরই পছন্দ।

ছবি: ইশতিয়াক চৌধুরী

চলো বরিশাল যাই, বলতেই গিন্নি এক পায়ে খাড়া। মিরপুর থেকে সদরঘাট যেতেই ঘণ্টা দুয়েক কেটে গেল। এতটুকুন পথ। এত সময় লাগা। যানজটে বসে থাকা, বড়ই বিরক্তিকর। সদরঘাট গিয়ে তো চোখ কপালে উঠল। এত বড় বড় লঞ্চ, নাকি অন্য কিছু। জানা গেল, প্রতিটি ৩০০ ফুটের মতো লম্বা। ৫০–৫৫ ফুট চওড়া। নজরকাড়া লাইটিং। মনে হচ্ছিল, বিয়েবাড়ি সাজানো হয়েছে। কোনোটার চেয়ে কোনোটা কম নয়। লাল, নীল কত রঙের বাতি। এমন সিঁড়িও আলোকসজ্জার বাইরে নেই। দেখতে কত সুন্দরই না লাগছে। লঞ্চের লোক হাঁক ছাড়ছে, তিন শ-তিন শ। মানে জনপ্রতি ভাড়া তিন শ টাকা। কেউ কেউ চুপি চুপি কানে বলছে, ভাই কেবিন লাগবে। সিঙ্গেল, ডাবল। এদের কাছে কেবিন পাওয়া যায়। একটু বেশি ভাড়া নেবে। সদরঘাটের ভিড়ভাট্টা ঠেলে লঞ্চে উঠে দম নিলাম। ডবল কেবিন। ফ্যান, টিভি এসব তো আছেই। সাথে মিনি পেস্ট, স্যান্ডেল পাওয়া গেল। একটু সামনে যেতেই দেখা মিলল দোকানের। সেখানে কফি বিক্রি হয়। চিপসসহ নানা হালকা খাবার। দুই কাপ কফি নিয়ে এক কাপ গিন্নির হাতে দিলাম। নদীর পাশের করিডরে বসলাম। কিছুক্ষণ পর লঞ্চ ছেড়ে দিল। যাঁরা ডেকে যাতায়াত করেন, তাঁদের জন্য বসে খাওয়ার আলাদা জায়গা আছে। একবারে লঞ্চের পেছনের দিকে। নিচতলায় চা বিক্রি হয়। সেখানে গিয়ে একটু চা পান করে নিতে ভুল করলাম না। কারণ, লঞ্চের চা, ডাল চচ্চড়ি খুব মজার হয়। এটা স্বীকৃত সত্য।

ছবি: ইশতিয়াক চৌধুরী

ডাবল, সিঙ্গেল, ভিআইপি, ফ্যামিলিসহ বিভিন্ন রকমের কেবিন লঞ্চে থাকে। ভিআইপি কেবিনে অনেক সুবিধা। চওড়া আরামদায়ক বেড, সোফা। বড় সাইজের টিভি। রুমের সাথে লাগোয়া বাথরুম। আলাদা জায়গায় বসে সবাই মজা করে খাবার ব্যবস্থা। টি টেবিল, ফ্রিজ আরও কত কী? বাসাবাড়িতে যা থাকে প্রায়ই সবই আছে। রুমের সঙ্গেই বারান্দা। যেখানে চেয়ারে বসে একান্তে নদীর সৌন্দর্য দেখার সুযোগ আছে। প্রাইভেসি আছে যথেষ্ট। নয়টার দিকে ঢাকা–বরিশালের লঞ্চ ছাড়ে। একটার পর একটা। এক লাইন ধরে চলে। অনেক সময় প্রতিযোগিতাও হয়। মৃদু আলোতে লঞ্চের এই বহর। সত্যিই দেখার মতো ব্যাপার। গিন্নিকে নিয়ে লঞ্চের ছাদে উঠলাম। মনে হলো এ যেন একটা ফুটবল মাঠে উঠেছে। এত বড়। পাশপাশি হেঁটে চললাম। হালকা বাতাস। তার খোলা চুলগুলো বারবার উড়ে এসে আমার মুখের ওপর পড়ছিল। এরই মধ্যে লঞ্চের হুইসেল। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছিল। নিচে যেতে মন চাইছিল না। এই ঠান্ডা লাগবে তো? বউয়ের এমন তাড়ায় কেবিনে ফিরতে হলো।

মুরগি ভুনা, ডাল চচ্চড়ি, ভর্তা, ভাত অতি সাধারণ খাবার। কেবিন বয় এসেই অর্ডার নিয়ে গেল। সাধারণ খাবার। তবে অসাধারণ স্বাদ পেলাম দুজনে। এরপর আবারও দুই কাপ চা নিয়ে হাঁটাহাঁটি। নিচতলায় ইঞ্জিন রুমের কাছে চলে যাই। তারপর দ্বিতীয় তলা। ডেকে যাঁরা যাচ্ছে তাঁদের কেউ ঘুমাচ্ছেন। কেউবা গল্প করছেন। কেউবা তাস খেলছেন। লঞ্চের লোক টিকিট কাটছেন। সব মিলিয়ে এখানে জীবন অন্য রকম। বড় বেশি সুন্দর। দক্ষিণের মানুষেরা এসব লঞ্চকে অনেকটা বাড়ির মতো ভাবে। লঞ্চে উঠে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়। যানবাহন মানে ক্রান্তি। এই ব্যাপারটা এখানে একদমই নেই। ঘুরেফিরে এসে কেবিনের বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। জানালার পর্দা সরানো। চারদিকে নিয়ন আলোর ছড়াছড়ি। কেবিনের জানালা–দরজা ভালো করে আটকিয়ে ঘুমাবেন। কেবিন বয় বলে গেল।

ছবি: ইশতিয়াক চৌধুরী

ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। এরই মধ্যে লঞ্চ বরিশাল চলে এসেছে। এত সকালে নামা যাবে না। করিডরে বসে বসে নদীর সৌন্দর্য দেখলাম। কীর্তনখোলা নদী। যার তীরে গড়ে উঠেছে বরিশাল। সামনে গিয়ে বরিশালে নৌবন্দর দেখলাম। এভাবেই কেটে গেল কিছুটা সময়। লঞ্চ ছেড়ে চলে যাওয়ার হলো। যেতে তো হবেই। যাত্রা কখনো দীর্ঘ হয় না। একসময় না একসময় সমাপ্তি টানতেই হয়। আলতো করে বউ হাত ধরে বলল, সত্যিই খুব ভালো লেগেছে। নদীতে লঞ্চে এত আনন্দ, ভালো লাগা কখনো ভাবিনি। তুমি নিয়ে না এলে জানতামই না। অধিকাংশ যানবাহনের যাত্রা উপভোগ্য হয় না। কিন্তু লঞ্চের বাইরে যিনি কখনো যাননি। তাকে বোঝানো যাবে না। এত এত কিছুর সমাহার। সে জন্য লঞ্চের লোকেরা লঞ্চকে বলে জাহাজ। বড়ত্ব বোঝানোর জন্যই হয়তো–বা।

ছবি: ইশতিয়াক চৌধুরী

আরও কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য—

সদরঘাট এসে ফোনে লঞ্চের টিকিট বুকিং দেওয়া যায়। অনলাইনে, অ্যাপসেও কাটা যায় কিছু লঞ্চের টিকিট। সিঙ্গেল কেবিন ১০০০ থেকে ১২০০, ডবল কেবিন ২৪০০ টাকা ভাড়া। ভিআইপি, ফ্যামিলি কেবিনের ভাড়া ৫০০০ থেকে শুরু। লঞ্চ ভেদে, সুবিধা ভেদে ভাড়া ভিন্ন হতে পারে। রাত নয়টার দিকে লঞ্চগুলো ছাড়ে।