টাঙ্গুয়ার হাওর ও ট্যাকেরঘাটে একদিন

প্রকৃতি ও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ছোটখাটো একটা মিতালি হয়ে গেছে আমার। তাই চাকরিসূত্রে নেত্রকোনা থেকে মোহনগঞ্জে যাওয়া আর মোহনগঞ্জ থেকে নেত্রকোনায় আসার সময় অন্যতম কাজ হলো রাস্তার আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ আর সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখা। প্রতিদিন একই রকম দৃশ্য তবুও কেন জানি চোখ ফেরাতে পারি না। একই ধরনের গাছ, একই ধরনের ফল-ফুল, একই ধরনের সবুজ প্রান্তর, প্রতি বর্ষার প্রতিদিনের একই রকম বিস্তীর্ণ জলরাশি, শুকনা মৌসুমের প্রতিদিনের একই রকম দিগন্তবিস্তৃত মাঠ আমার কাছে কেমন যেন প্রতিনিয়তই নতুন লাগে। কখনো কাঠফাটা রৌদ্দুর, কখনো বা ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কিছুটা নিজের, নিজের পরিবারের অথবা আমাদের মতো মানুষের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদনকারী কৃষকদের দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকতে আমার অসম্ভব ভালো লাগে। কী পরিশ্রমটাই না তাঁরা করেন! যাঁদের বিরামহীন পরিশ্রমের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও আমাদের দেশের অর্থনীতি বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁদের দিকে আমার সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। এভাবে কখন যে আমার রাস্তা শেষ হয়ে যায়, আমি অনেক সময় টেরই পাই না।

প্রকৃতি, কৃষি আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ যখনই পাই, শত ব্যস্ততা আর অসুবিধা সত্ত্বেও চেষ্টা করি প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত কোনো এক জায়গা ঘুরে আসতে।

গত ২০ জুলাই এমনই একটি সুযোগ পেয়ে যাই। মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিষদের উদ্যোগে শিক্ষকেরা টাঙ্গুয়ার হাওর আর ট্যাকেরঘাট ঘুরে আসার পরিকল্পনা করেন। আমিও উদ্যোগে সায় দিই। এর মধ্যে হঠাৎ করেই আমার শরীরটা খারাপ হয়ে যায়। মাত্র এক দিনের মধ্যেই অসুস্থতা কাটলেও দুর্বলতাটা ছেড়ে যেতে চাইছিল না। কিন্তু এই যে বিশাল একটা হাওর আর সীমান্তবর্তী একটা এলাকা দেখার হাতছানি আমাকে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারল না। সব আয়োজন শেষে ২০ জুলাই সকাল পৌনে ৮টায় স্কুল থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি।

মোহনগঞ্জ থেকে অটোরিকশায় ধর্মপাশায় যাই। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে মধ্যনগরের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম। ধর্মপাশা থেকে একটু এগিয়েই সুনুই সেতু পেরিয়ে টগার হাওর।

হাওরটা তেমন বড় না হলেও সৌন্দর্যের কোনো কমতি নেই। দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি আর আশপাশের আকুণ্ঠ নিমজ্জিত গ্রামগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হাওরের পাশের রাস্তার ধারে নোয়াদার, ভাটগাঁও, জামালপুর, সুনুই এসব গ্রামের কিছু লোক পাটের আঁশ ছাড়াচ্ছিলেন। পচানো পাটের চিরচেনা গন্ধটা আমাকে শৈশব-কৈশোরে নিয়ে যায়। ছোটবেলায় আমাদের জমিতে পাট কাটা, পাট পচানোর পর এগুলোর আঁশ ছাড়ানো এসব কাজ বহুবার করেছি। একসময়ের সোনালি আঁশ পাটের দাপট আগের মতো না থাকলেও আমাদের কৃষকদের কাছে এর অর্থনৈতিক ও পারিবারিক গুরুত্ব একেবারে কম নয়।

বর্ষাকালে কর্মচঞ্চল মধ্যনগর

যা–হোক সুনুই সেতু পেরিয়ে আরও কিছুক্ষণ গিয়ে ইটখোলায় আমরা ট্রলারে উঠলাম। সেখান থেকে মধ্যনগর সকালের নাশতা করলাম এবং সাউন্ড সিস্টেমসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিলাম। মধ্যনগরে আমি প্রথমবার গেলাম। বর্ষাকালে মধ্যনগর থাকে একেবারেই কর্মচঞ্চল। বিশেষ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাওর দেখতে আসা পর্যটকেরা মধ্যনগর থেকেই ট্রলারে উঠেন। সে এক এলাহি কাণ্ড। ঘাটে ঘাটে সারি সারি ট্রলার। এখান থেকেই টাঙ্গুয়ার হাওরসহ বিভিন্ন জায়গার উদ্দেশ্যে ট্রলারগুলো ছেড়ে যায়। শুধু ট্রলার নয়, ছোট–বড় অনেক নৌকা নিয়ে সাধারণ মানুষ এখান থেকে দৈনন্দিন প্রয়োজনে এদিক–সেদিক যাতায়াত করেন। কেউ আসে বাজার করতে, কেউ আসে চিকিৎসা করতে আর কেউবা আসে কোনো দ্রব্য বিক্রি করে তার প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে। একটা নৌকা দিয়ে দিয়ে দেখলাম বর তাঁর নববধূকে নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছেন। কত আশা আর কত স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা ঘর বাঁধতে যাচ্ছেন! কিন্তু পৃথিবীটা তো বিচিত্র রঙ্গমঞ্চ। এর লীলা বোঝা দায়। কারও স্বপ্নপূরণ হয় আবার কারও স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। জানি না, তাঁরা তাঁদের ঘরে সুখ নামের সোনার হরিণটা খুঁজে পাবেন কি না।

একটা ঘাটে দেখলাম এক মা তার অবাধ্য ছেলেকে গোসল করাচ্ছেন। ছেলেটার দুষ্টুমির কোনো শেষ নাই। তবুও মা বিরক্ত হচ্ছেন না।

মামা-ভাগনের ট্রলারের দাম ১৮ লাখ টাকা

আমরা যে ট্রলারটা ভাড়া করলাম এর মালিকের সঙ্গে আমি কথা বললাম। ট্রলারের মালিক দুজন। একজনের নাম বাবুল (মামা) আর অন্য জনের নাম রাজন (ভাগনে)। বাড়ি জামালগঞ্জ উপজেলার বেলি ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে। মামা-ভাগনে দুজন মিলে ২০২১ সালে ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ট্রলারটা তৈরি করেছেন। বর্তমান বাজারমূল্য ২৫ লাখ টাকা। তারা বর্ষা মৌসুমে চার–পাঁচ মাস নৌকায় কাজ করতে পারেন। প্রতিদিন না হলেও অধিকাংশ দিন তাদের নৌকা ভাড়া হয়। খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন নৌকা থেকে আয় হয় ১০ হাজার টাকার মতো। নৌকার মালিক হিসেবে তাঁরা পান অর্ধেক। বাকি টাকা নৌকার চারজনে মাঝি (চারজনের মধ্যে মাঝি হিসেবেও তাঁরা দুজন আছেন) ভাগ করে নেন। এভাবে গত দুই বছরে তাঁরা ৯ লাখ টাকার মতো পেয়েছেন। মূলধন হাতে আসতে তাঁদের আরও বছর দুয়েক লাগবে। বছরে চার–পাঁচ মাস নৌকায় কাজ করার পর বাকি সাত–আট মাস বাড়ির কাজ করেন। তাঁদের দুজনেরই ভালো জমি আছে। জমি থেকেও তাঁরা বেশ আয় করেন। তাঁরা জানান তাঁদের এলাকার অনেকেই বর্ষাকালে নৌকায় কাজ করেন। পর্যটক বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সুযোগটা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া অনেকেই বর্ষাকালে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। অনেকেই ঢাকা বা অন্যান্য শহরে পোশাক বা অন্য কোনো কোম্পানিতে কাজ করেন। সাধারণ মানুষের বেকারত্ব আগের মতো আর নাই। একদম অলসদের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। ফলে গ্রামে এখন চুরি ডাকাতিও তেমন আর নেই। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আয়–রোজগারও নিতান্ত খারাপ না। তাই ভালোই যাচ্ছে তাঁদের দিন। তবে এবার হাওরে পানি এসেছে দেরিতে। ইতিমধ্যেই কমতেও শুরু করেছে। যার ফলে নৌকা বা ট্রলার যাঁদের আয়ের হাতিয়ার, তাঁদের একটু অসুবিধা হবে। হাওরে পানি দেরিতে আসায় মাছের উৎপাদনও কম হবে।

যা হোক, মধ্যনগর থেকে ট্যাকের ঘাটের দিকে একটু এগুলেই দুইটা হাওর। এ দুটো হাওরকে টাঙ্গুয়ার হাওরে যাওয়ার আগেই পাওয়া যায়। হাওর দুটি থেকেই কলমাকান্দা ও মধ্যনগরের সীমান্তের পাহাড়গুলো দেখা যায়। নয়নাভিরাম দৃশ্য। হাওর দুটো পেরুলেই টাঙ্গুয়ার হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওর সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত।

টাঙ্গুয়ার হাওরের শুরুতেই গোলাবাড়ি এলাকা। এখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার বন বিভাগ, যা নির্মাণ করেছিল ২০১৪ সালে। উচ্চতা ৪০ ফুট। গোলাবাড়ির হিজলবাগানের পাশেই এটি নির্মিত হয়েছে। আমরা পশ্চিম দিক থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রবেশ করি। প্রাকৃতিক সম্পদ আর সৌন্দর্যে ভরপুর টাঙ্গুয়ার হাওরকে বৈশ্বিক গুরুত্বের কারণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রামসার সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটা এখন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। মাদার ফিশারিজ খ্যাত এ হাওর মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে সংরক্ষিত। প্রতিবছর এ হাওরে উৎপাদিত হয় লাখ লাখ টন মাছ। যা হোক, ওয়াচ টাওয়ারটা টাঙ্গুয়ার হাওরের দক্ষিণে। উত্তরে মেঘালয় পাহাড়। পুবে মাইটাইন হাওর। আর ট্যাকের ঘাটটা হলো টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে পুব উত্তর কোণে।

বর্ষাকালে এ হিজল বাগানটি পর্যটকদের হৃদয়কে আকর্ষণ করার মতোই অসাধারণ। এ ওয়াচ টাওয়ার থেকে হাওরের বিস্তীর্ণ এলাকা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। কিন্তু এটা পুরোনো হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন যে পরিমাণ পর্যটক টাওয়ারে উঠেন, তাতে আমার কাছে এটিকে ঝুঁকিপূর্ণই মনে হলো। কোন দুর্ঘটনাটা না হলেই হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয় দেখা উচিত।

হাওরের সৌন্দর্য আমাকে সব সময় মোহিত করে। আর সেই হাওর যদি হয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভুমি টাঙ্গুয়ার হাওর, তবে তো কথাই নেই। ভরা বর্ষায় আকুণ্ঠ নিমজ্জিত হিজল-করচ আর বিশাল জলরাশি সমৃদ্ধ এ হাওরের যেদিকেই তাকানো যায়, সেদিকেই সৃষ্টিকর্তার সাজানো চোখধাঁধানো অপার সৌন্দর্যে একেবারে পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা। টাঙ্গুয়ার হাওর পেরিয়ে গেলেই মাইটাইন হাওর।

ট্যাকের ঘাটের যত কাছে যাওয়া যায়, ততই মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়। একদিকে দিগন্ত বিস্তৃত হাওরের বিশাল জলরাশি, তার চারপাশে প্রায় ডুবে থাকা গ্রাম, অন্যদিকে দূরে মেঘালয়ের মায়াবি পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য। এমনটি পৃথিবীর আর কোথাও থাকতে পারে, এটা আমি অন্তত বিশ্বাস চাই না। বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার হাওর থাকে মাছে পরিপূর্ণ। আর শুকনা মৌসুমে এটা যায় বোরোধানের ভান্ডার। শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসে হাজারও অতিথি পাখি। ঋতুভেদে এর সৌন্দর্যও বৈচিত্র্যে পূর্ণ।

আমরা ট্যাকেরঘাট যখন পৌঁছলাম, তখন  দুপুর হয়ে গেছে। তাহিরপুর উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নে ট্যাকেরঘাট অবস্থিত। চুনাপাথরের প্রাকৃতিক ভান্ডার রয়েছে ট্যাকেরঘাটে। সিমেন্ট শিল্পের জন্য অত্যাবশ্যকীয় এ চুনাপাথরকে ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে খনি অঞ্চল। সাধারণত প্রতিবছর নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চুনাপাথর সংগ্রহের কাজ চলে। চুনাপাথর সংগ্রহের কাজ অনেক দিন ধরে বন্ধ থাকায় এ বিষয় এখন আর দেখার সুযোগ নেই। ট্যাকেরঘাটের বড়ছড়া হচ্ছে কয়লা আমদানির ব্যবসাকেন্দ্র। এ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে বড়ছড়াতে তৈরি হয়েছে এক ভিন্ন ধারার জীবন পদ্ধতি। প্রতিবছর ভারত থেকে বৈধ উপায়ে লাখ লাখ টন কয়লা আমদানি হচ্ছে এই শুল্কস্টেশন দিয়ে।

ট্রলার থেকে নেমে লাকমা চকবাজার পেরিয়ে আমরা হেঁটে গেলাম লাকমা ছড়ায় (ঝরনায়)। এটা বাংলাদেশের সীমানাঘেঁষা ভারতের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে। জায়গাটা সুন্দর। এর পানি খুব পরিষ্কার। ছড়ার পাড়ে/পাশে বালি আর পাথর। ছড়ার তলায় অর্থাৎ পানির নিচে কোথাও কাঁদামাটি নেই।

শুধু বালি আর পাথর। আমরা ছড়ায় গোসল করলাম। খুব ভালো লাগল। আমি লক্ষ করলাম, ছড়ায় নেমে আমাদের স্কুলের শিক্ষকেরাও শিশুকিশোরদের মতো আনন্দে মেতে উঠেন। সত্যি নিজকে হারিয়ে ফেলার মতোই জায়গা এটা।

ছোট মেয়েটাকে দেখে খুব মায়া হলো

পর্যটকদের আসা–যাওয়ার ফলে ছড়ার পাশে কিছু ছোট ছোট দোকানও গড়ে উঠেছে। কেউ শরবত বিক্রি করছে, কেউবা চা-পান বিক্রি করছে, কেউ আনারস বিক্রি করছে, আর কেউবা পেয়ারা বিক্রি করছে। আমি শরবত বিক্রি করতে দেখলাম দশম শ্রেণির ছাত্র রিফাতকে। তার ভাই চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র রাহুল সহযোগিতা করছে। মাদ্রাসাছাত্রী সোনিয়া তার প্রথম শ্রেণিপড়ুয়া বোনকে নিয়ে পেয়ারা বিক্রি করছে।

ছোট মেয়েটাকে দেখে খুব মায়া হলো। আহারে! যে বয়সে একটা মেয়ে পেয়ারা, আম বা বড়ই খেতে খেতে স্কুলে বা বেড়াতে যাওয়ার কথা, সে কিনা কিছু পয়সা রোজগারের জন্য পেয়ারা বিক্রি করছে! এমন আরও অনেকেই পর্যটকদের কাছে ছোটখাটো জিনিস বিক্রি করে পর্যটকদের যেমন সহযোগিতা করছে, তেমনি নিজেরাও লাভবান হচ্ছে। লাকমা চকবাজারটা এলে পর্যটকদের জন্যই প্রাণচঞ্চল। এ বাজারে কিছু হোটেলও আছে। বিশেষ করে শুক্র শনিবারেই পর্যটকের আনাগোনাটা বেশি। এ দুই দিন বেচাকেনাও হয় বেশ। হোটেলমালিক মো. খায়রুল আলমের সঙ্গে আমার কথা হলো। তাঁর কাছ থেকে জানলাম যে পর্যটকদের অধিকাংশই খাবারের জিনিসপত্র কিনে নিয়ে আসেন এবং নৌকা/ট্রলারে রান্নার আয়োজন করে ফেলেন। ফলে হোটেলমালিকেরা খুব একটা ক্রেতা পান না। আমরা অবশ্য হোটেলেই খাই। আমরা আগে থেকেই হোটেল রবিনে বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। মালিক আ. রাজ্জাক তাঁর স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছেলেদের নিয়েই হোটেলটা চালান। খাবারের মানও ভালো। খুব ভালো লাগল যে ছেলেরা পড়াশোনাও করছে, আবার বাবাকে হোটেলে সহযোগিতা করছে।

দুপুরের খাবারের পর আমরা গেলাম নীলাদ্রি লেক দেখতে। মেঘালয়ের পাহাড় একেবারে পাশে থাকায় লেকের সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমার ধারণা শুকনা মৌসুমে লেকের সৌন্দর্য ও গুরুত্ব দুটোই বেশি থাকে। বর্ষাকালে টাঙ্গুয়ার হাওরের সুবিশাল জলরাশি দেখার পর লেকের সৌন্দর্য বাড়তি আবেদন সৃষ্টি করবে—এমনটা আশা করা যায় না। তেমনি শিমুলবাগানটা বসন্তকালে যেমন অপরূপ সৌন্দর্যের কারণ হয়ে দাঁড়াবে বর্ষাকালে, তেমনটা আশা করা ঠিক হবে না। তাই সেদিকে আর যাইনি।

এরপর আমরা গেলাম তাহিরপুর উপজেলার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ দেখতে। সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের অর্থায়নে ট্যাকেরঘাটে এটা নির্মিত হয়েছে ২০১৩ সালে। স্মৃতিসৌধটি বেশ দৃষ্টিনন্দন। এর কাছে গিয়ে দাঁড়ালে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের কথা মনে পড়ে যায়। যার ফলে আমরা পেয়েছি সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতিসৌধটি দেখার মধ্যে দিয়েই আমরা শেষ করলাম ট্যাকেরঘাট দেখার অভিযান। এরপর মোহনগঞ্জ ফেরার পালা।

হাওর এবং ট্যাকেরঘাটে ভ্রমণ করে নির্মল আনন্দ পেয়েছি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। মনকে প্রসন্ন করার জন্য এবং শহরের কোলাহলময় জীবনের একঘেয়েমি দূর করার জন্য মাঝেমধ্যে এমন ভ্রমণে বের হওয়া দরকার আছে। কিন্তু এবার ঘুরে আসার পর থেকে অন্য রকম কিছু বিষয়ও আমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আসলে আমরা সাধারণত যাই শুধু হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। আমরা যাঁরা প্রতিদিন দলে দলে ট্রলারে করে টাঙ্গুয়ার হাওর ও ট্যাকের ঘাট দেখতে যাই, তাঁদের উদ্দেশ্যই থাকে একটা দিন একটু আনন্দে কাটানো। সেখানে গিয়ে  কড়া মিউজিক বাজাই, নাচি, গাই আর ভালো ভালো খাবার খেয়ে মনপ্রাণ আনন্দে পূর্ণ করে চলে আসি। কিন্তু হাওরপাড়ের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ–বেদনার কথা কি আমরা কেউ চিন্তা করি? যে মানুষগুলো মেঘবৃষ্টি, রোদ্দুর আর ঝড়ঝঞ্ঝা মাথায় নিয়ে সারাদিন কাজ করে কোনোরকমে দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেন, আমাদের আনন্দ উল্লাস দেখে তাঁদের মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়, মহান আল্লাহ তায়ালাই তা জানেন।

আমি লক্ষ করেছি, বিশাল হাওরে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে কিছু সাধারণ মানুষ মাছ ধরছেন। আমি আগেই বলেছি, এবার পানি কম থাকায় হাওরে মাছের পরিমাণও কম হওয়ার সম্ভাবনা। তাই যাঁরা মাছ ধরছেন, তাঁরা যে বেশি মাছ পাচ্ছেন, এমনটা আশা করার কারণ নেই। সারাদিনে অল্প কিছু মাছ ধরতে পারলে হয়তো বাজারে বিক্রি করবেন। আর বিক্রয়লব্দ টাকা দিয়ে পরিবার–পরিজনের জন্য চাল–ডাল কিনবেন।

রাতে বউ-বাচ্চা আর মা-বাবাকে নিয়ে মোটা ভাত, ভর্তা, ডাল ইত্যাদি অসাধারণ মজা করে খাবেন।

এরপর আরাম করে ঘুমিয়ে পরদিন আবার যথারীতি রিজিকের অন্বেষণে বের হবেন। গ্রামে এ রকম মানুষের সংখ্যা কিন্তু মোটেও কম নয়। তাঁদের কাছে হাওরের সৌন্দর্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ কে জানে।

হাওর এলাকার গ্রামগুলোয় দেখেছি, অনেক বাড়ির সামনেই বালুর বস্তার নিরাপত্তা দেওয়া। কোনো কোনো গ্রামে দেখলাম ব্লক দিয়ে প্রটেকশন দেওয়া। সরকারি উদ্যোগে, কোনো এনজিওর মাধ্যমে অথবা নিজ উদ্যোগে হয়তো এ প্রটেকশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য নাই, তাঁরা এ ধরনের প্রটেকশনও দিতে পারেন না। তাঁরা কোনোরকমে ঘাস, গাছের ডালপালা ইত্যাদি দিয়ে ন্যূনতম প্রটেকশন দিয়ে মহান আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করে বসে থাকেন। ঝড়বৃষ্টির দিনে বড় বড় ঢেউ যখন বাড়িতে এসে আঘাত করে, তখন এসব মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে কতটা সংগ্রাম যে করতে হয়, তা বলে বোঝানো কঠিন।

আর একটা কথা না বললেই নয়। বর্ষাকালে হাওরে পর্যটকদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এতে হাওর এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানও বাড়ছে। আর্থিকভাবে লাভবানও হচ্ছেন তাঁরা। এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো দিক। কিন্তু এত অধিক হারে ইঞ্জিনচালিত নৌকার আনাগোনার ফলে আমাদের মিঠা পানির হাওরের মৎস্য সম্পদের সাধারণ বিচরণ বা প্রজননে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে কি না, তা বিবেচনা করা দরকার। বিশেষ করে প্রজননের সময়টায় (এপ্রিল ও মে মাসে) ইঞ্জিনচালিত নৌকার চলাচল অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ ও রাস্তাঘাট হওয়ায় মাছের স্বাভাবিক চলাচল এমনিতেই ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া আমরা কারেন্ট জাল ব্যবহার করে পোনামাছ আর নলামাছ নির্বিচারে যেভাবে ধরছি, তাতে মৎস্য সম্পদ এমনিতেই হুমকির সম্মুখীন। তাই এখনই সঠিক ব্যবস্থা না নিলে আমাদের প্রাকৃতিক প্রোটিনের ভান্ডারে যে ঘাটতি পড়বে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলকে ঘিরে প্রাকৃতিকভাবে, বিনা পরিকল্পনায় ও বিনা পরিশ্রমে যেভাবে পর্যটনশিল্প গড়ে উঠেছে, তাতে করে বলা যায় যে আমরা মেঘ না চাইতেই জল পেয়েছি।

এখন দরকার একটু পরিকল্পনা নিয়ে আর একটু পরিচর্যা করে এটাকে বিকশিত করা, যাতে এ এলাকাটা স্থায়ীভাবে পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়। মনে রাখতে হবে, হাওরাঞ্চলে শুধু বর্ষাকালে নয়, শুকনা মৌসুমেও অগণিত পর্যটক আসেন। সুতরাং সারা বছরের বিষয়টা মাথায় রেখে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করে, নির্দিষ্ট কিছু স্থানে প্রয়োজনীয়সংখ্যক স্বাস্যসম্মত শৌচাগার আর বিশ্রামাগার তৈরি করা। আর পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে সুন্দর করে সাজানো গেলে এর গুরুত্ব যেমন বাড়বে, হাওর এলাকার মানুষেরাও সারা বছর ধরেই এর মাধ্যমে উপকৃত হবেন। কাজটা কিন্তু খুব কঠিন নয়। শুধু দরকার একটু গোছানো সৃজনশীল পদক্ষেপের।

হাওরাঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন মানোন্নয়নের জন্য আর সবাইকে নিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের বাস্তবায়নের জন্য এটুকু কষ্ট তো আমাদের করতেই হবে।

  • লেখক: মো. মোতাহার হোসেন, প্রধান শিক্ষক, মোহনগঞ্জ পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয়, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা।