যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ৩৮ দিন
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ৩৮ দিনের সফরটা আমার জীবনে এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা হয়ে রইল। এর আগে গত বছর অক্টোবরেও এসেছিলাম এখানে। এবার এলাম জুলাই মাসের একেবারে শুরুতে প্রিয় ছেলের সংসারে, নতুন বউমার ভালোবাসায় ঘেরা এক উষ্ণ পরিবেশে। এই সফর কেবল ভ্রমণ নয়, বরং পরিবারের টানে ফিরে আসা, হৃদয়ের টানেই যাত্রা। মূলত ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস আর সান দিয়েগো শহরে ছিলাম আমাদের মেয়ে আর ছেলের কাছেই।
সান দিয়েগোতে প্রথম আসার পর থেকেই শহরটি আমার ভেতরে এক বিশেষ জায়গা দখল করে নিয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরের নীল ঢেউ, চারপাশের সবুজ পাহাড়, রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ আর প্রাণচঞ্চল মানুষ—সব মিলিয়ে এই শহর যেন এক প্রশান্তির আশ্রয়। মনে হয়, এখানে সময় যেন ধীরে বয়ে চলে; প্রতিটি ভোর আর প্রতিটি সন্ধ্যা নিয়ে আসে নতুন সৌন্দর্যের বার্তা।
ক্যালিফোর্নিয়ার বৈচিত্র্যই তাকে আলাদা করে তোলে। উত্তর দিকে রয়েছে তুষারাবৃত পর্বত, মাঝখানে বিস্তৃত মরুভূমি, আর দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে অসংখ্য সমুদ্রসৈকত। একই দিনে কেউ চাইলে পাহাড়ে স্কি করতে পারে, আবার সন্ধ্যায় চলে যেতে পারে সমুদ্রসৈকতে সূর্যাস্ত দেখতে—এই অনন্য অভিজ্ঞতাই ক্যালিফোর্নিয়াকে অন্য সব স্টেট থেকে আলাদা করে।
সান দিয়েগো শহরটি ইতিহাস ও আধুনিকতার এক চমৎকার সমন্বয়। ১৫৪২ সালে স্প্যানিশ অভিযাত্রী কাব্রিয়ো প্রথম এখানে আসেন, আর ১৬০২ সালে নামকরণ হয় ‘সান দিয়েগো’। একসময় স্পেন ও মেক্সিকোর শাসনে থাকা এ অঞ্চল ১৮৪৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হয়। আজ এটি প্রযুক্তি, সামুদ্রিক গবেষণা, জীববিজ্ঞান ও পর্যটনের এক বিশ্বনন্দিত কেন্দ্র।
শহরের অন্যতম আকর্ষণ এর আবহাওয়া—সারা বছরই নাতিশীতোষ্ণ। এখানে বিশাল সবুজ পার্ক, পাহাড়ি ট্রেইল, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বাগান আর অসংখ্য সৈকত শহরটিকে করে তুলেছে প্রাণবন্ত। একদিকে রয়েছে পুরোনো স্প্যানিশ স্থাপত্য, অন্যদিকে আধুনিক কাচের টাওয়ার—দুটো একসঙ্গে মিলেমিশে দিয়েছে সান দিয়েগোকে তার স্বতন্ত্র রূপ।
আমার সফরের সবচেয়ে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল সান দিয়েগোতে ইউএসএস মিডওয়ে মিউজিয়াম ঘুরে দেখা। এটি আসলে একটি বিশাল যুদ্ধজাহাজ, যা ১৯৪৫ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত মার্কিন নৌবাহিনীতে সক্রিয় ছিল। কোরিয়া যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও উপসাগরীয় যুদ্ধের মতো বহু গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে অংশ নিয়েছে এই জাহাজ। আজ এটি একটি ভাসমান জাদুঘর।
জাহাজের শতাধিক কক্ষ ঘুরে দেখা যায়—হ্যাঙ্গার ডেক, কন্ট্রোল রুম, রান্নাঘর, চিকিৎসাকক্ষ থেকে শুরু করে অফিস কেবিন পর্যন্ত। বাস্তব যুদ্ধবিমানগুলোর ককপিটে বসে মনে হয়, যেন আমরাও কোনো এক মিশনে উড়ে যাচ্ছি। সাবেক নৌ সেনারা এখানে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করেন, দর্শনার্থীদের শোনান যুদ্ধক্ষেত্রের গল্প ও জাহাজের জীবনের স্মৃতি। সবচেয়ে মুগ্ধকর মুহূর্ত ছিল জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা—পেছনে প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউ, সামনে শহরের আলো আর মাথার ওপরে লাল-সোনালি আকাশ।
সান দিয়েগো ছাড়াও ক্যালিফোর্নিয়ার নানা সৌন্দর্য চোখে পড়েছে। লস অ্যাঞ্জেলেসের উজ্জ্বল নগরজীবন, হলিউডের ঝলমলে পরিবেশ, আর সমুদ্রতীরের সান্তা মনিকা পিয়ারের সন্ধ্যা—এক ভিন্ন অনুভূতি দিয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার আরেক বৈশিষ্ট্য হলো এখানকার বহুজাতিক সংস্কৃতি। এশীয়, লাতিন, ইউরোপীয়সহ বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ এখানে বসবাস করে, যা খাবারদাবার, উৎসব আর আচার-অনুষ্ঠানে এনে দিয়েছে এক অপূর্ব বৈচিত্র্য।
পরিবারের সঙ্গ এ সফরকে আরও গভীর অর্থ দিয়েছে। মেয়ের সঙ্গে এক দিনের ভ্রমণ যেন আনন্দকে দ্বিগুণ করে তুলেছিল। আমরা উপলব্ধি করেছি, ইতিহাস যেমন মানুষকে শেখায়, তেমনি পারিবারিক বন্ধনও মানুষকে আরও কাছে টেনে আনে।
আমার কাছে ক্যালিফোর্নিয়া কেবল একটি ভ্রমণস্থল নয়, এটি এক জীবন্ত অনুভূতি। প্রকৃতি, ইতিহাস আর মানুষের উষ্ণতা মিলিয়ে এই স্টেট প্রতিবারই আমাকে নতুনভাবে মুগ্ধ করে।
এই ৩৮ দিনের সফর যেন মনে করিয়ে দিল, ভ্রমণ শুধু চোখে দেখার জন্য নয়, এটি হৃদয়ে গেঁথে রাখার মতো এক অভিজ্ঞতা। ক্যালিফোর্নিয়ার আলো-হাওয়া, পরিবারের ভালোবাসা আর ইতিহাসের ছোঁয়া আমাকে সমৃদ্ধ করেছে, যা থেকে যাবে অনেক দিন।