প্রাচীন জমিদারবাড়ির নিঃসঙ্গ প্রহরী
নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামে দাঁড়িয়ে আছে এক শতাব্দীপ্রাচীন স্থাপত্য—লক্ষ্মণ সাহার জমিদারবাড়ি। সময়ের আঘাতে জীর্ণ হলেও, এখনো যেন কালের সাক্ষী হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। চারপাশে ধানখেত, খোলা বাতাস আর নৈঃশব্দ্যের ভেতরেও বাড়িটির দেয়াল যেন আপন কণ্ঠে বলে চলে অতীতের গল্প—একসময়ের ঐশ্বর্য, আভিজাত্য আর নান্দনিকতার ইতিহাস।
জমিদার লক্ষ্মণ সাহা ছিলেন এই জমিদার বংশের মূল গোড়াপত্তনকারী। তবে কবে নাগাদ এই জমিদার বংশ এবং জমিদারবাড়িটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তার সঠিক তথ্য জানা যায়নি। এই জমিদার পরিবার অন্য এক জমিদারির আওতাভুক্ত ছোট জমিদার ছিল। তবে তাদের কখনোই যে জমিদারের অধীনে ছিল বা ব্রিটিশ সরকারকেও খাজনা দিতে হয়নি, কারণ এই জমিদারি এলাকা ভারত উপমহাদেশের মধ্যে একমাত্র ওয়াক্ফ হিসেবে ঘোষিত ছিল।
লক্ষ্মণ সাহার তিন পুত্রসন্তান ছিল। তাঁদের মধ্যে ছোট ছেলে দেশভাগের সময় ভারতে চলে যান। এরপর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প কিছুদিন আগে বড় ছেলেও ভারতে চলে যান। থেকে যান মেজো ছেলে, যাঁর একমাত্র পুত্র ছিলেন বৌদ্ধ নারায়ণ সাহা। পরবর্তীকালে তিনিই আহম্মদ আলী উকিলের কাছে উক্ত বাড়ি বিক্রি করে দেন। আহম্মদ আলী পেশায় একজন উকিল ছিলেন বলে বর্তমানে অনেকে বাড়িটিকে উকিলবাড়ি নামেও চেনেন।
মোগল আমলের জমিদার লক্ষ্মণ সাহা বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন নিপুণ কারুকাজে। ২৪টি কক্ষবিশিষ্ট এই প্রাসাদ গড়ে উঠেছিল এক পূর্ণাঙ্গ শৈল্পিক রূপে। লাল ইটের দালান, কারুকার্যমণ্ডিত দরজা-জানালা, উঁচু প্রাচীর আর সুনিপুণ ছাদের নকশা—সব মিলিয়ে স্থাপনাটি যেন এক জীবন্ত স্থাপত্যকাব্য। বাড়িটির পাশে রয়েছে একটি ছোট কিন্তু অনিন্দ্যসুন্দর মন্দির, যার দেয়ালজুড়ে আজও টিকে আছে সূক্ষ্ম অলংকরণ। আরেক পাশে রয়েছে অর্ধনির্মিত একটি প্রাচীন দালান—সম্ভবত অসমাপ্ত কোনো স্বপ্নের নিঃশব্দ সাক্ষী হয়ে আছে সেটিও।
বাড়ির পেছনে বিস্তৃত এক বাগান, চারদিকে উঁচু প্রাচীর। আছে প্রশস্ত পুকুর আর পাথর বাঁধানো ঘাট—যেখানে একসময় জমিদার পরিবারের পূজা–অর্চনা ও আচার–অনুষ্ঠান হতো। এখন সেই পুকুরে পানির জায়গা দখল করে নিয়েছে কচুরিপানা। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে সেই সৌন্দর্য, যেন ইতিহাসের বুক থেকে মুছে যাচ্ছে এক অমূল্য অধ্যায়।
দুঃখের বিষয়, এই জমিদারবাড়ি সংরক্ষণের কোনো সরকারি উদ্যোগ নেই। বর্তমানে এটি পরিণত হয়েছে অবহেলা, নেশাখোরদের আড্ডা এবং ছিনতাইয়ের আতঙ্কে ভরা এক পরিত্যক্ত স্থানে। অথচ বাড়িটি ঘিরে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। ঢাকার অদূরেই অবস্থিত এই মনোরম জায়গা যদি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তবে এখানে ভিড় জমবে দর্শনার্থী, ফটোগ্রাফার ও চলচ্চিত্র নির্মাতাদের। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও স্থাপত্যের সংমিশ্রণে এটি হয়ে উঠতে পারে এক অনন্য ঐতিহ্যবাহী স্থান।
আমাদের বাংলায় ঐতিহাসিক দুর্গ, প্রাসাদ বা স্মৃতিস্তম্ভ প্রায় বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই। অতীতের চিহ্নগুলো যদি আমরা নষ্ট হতে দিই, তবে ভবিষ্যতের জন্য আমরা কী রেখে যাব?
লেখক: নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়