ঋষিকেশে মানসিক প্রশান্তির খোঁজে
মানুষের মন বড্ড বিচিত্র। সময়ের সঙ্গে মানুষের মননে, চৈতন্যে, ভাবনার অলিন্দে বদল আসতে থাকে। বলা হয়, পরিবর্তনই জগৎ-সংসারের নিয়ম। পরিবর্তন আছে বলেই পৃথিবী অনেক সুন্দর, মানুষের জীবন বৈচিত্র্যময়। জীবনবোধের এ বৈচিত্র্যকে উপলব্ধি করতে গত ডিসেম্বরে আমার সহকর্মী লাবন্য সরকারকে সঙ্গে নিয়ে ‘ইয়োগা রাজধানী’খ্যাত ঋষিকেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলাম। দিল্লি থেকে ট্রেনে চড়ে প্রথমে আমরা হরিদ্বারে যাই। হরিদ্বার হিন্দুদের এক অন্যতম তীর্থক্ষেত্র। এটি ভারতের উত্তরাখন্ডে।
হরিদ্বার থেকে বাসে ৩০ কিলোমিটারের দূরত্বে ঋষিকেশ অবস্থিত। ঘন বনের মধ্য দিয়ে আমাদের বাস এগিয়ে চলেছে ঋষিকেশের দিকে। ডিসেম্বরে প্রকৃতির দিকে কান পাতলে পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়, অনেক গাছের পাতা হলুদ হয়ে সবুজের মাঝে এক অন্য রকম আভা ছড়িয়ে চলেছে। প্রকৃতির এ রংবদলের সুরে অবগাহন করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম ঋষিকেশে।
হরিদ্বার থেকে আমাদের একজন বলেছিলেন, গুরুদুয়ারাতে গিয়ে উঠলে আমরা বিনা পয়সায় থাকতে পারব। তাঁর কথামতো আমরা প্রথমে গুরুদুয়ারাতে যাই, কিন্তু সেদিন ওদের একটা বিশেষ অনুষ্ঠান থাকাতে আমরা ওখানে থাকার জায়গা পাইনি। তবে, দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম বিনা পয়সায়। নিজেরা প্লেট নিয়ে সেটি পরিষ্কার করে মাথায় কাপড় বেঁধে বসে পড়ি খাবারের লাইনে। প্রথমে তরকারি দেওয়ার পর রুটি দেওয়া হলো। রুটি দেওয়ার সময় আমি এক হাত বাড়িয়ে দিলে সেই মানুষটি আমার ওপর খানিকটা রুষ্ট হলেন। আমি ভুল বুঝতে পেরে পরে দুই হাত বাড়িয়ে দিলে তিনি খুশি হলেন। আসলে এটাই হলো সংস্কৃতির বৈচিত্র্য। ভ্রমণের ফলে সংস্কৃতির এ বৈচিত্র্যময়তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে নানা ভাবে, যেটি মানুষকে ঋদ্ধ করে, মননকে পরিশীলিত করে।
আমরা হোটেলে ব্যাগপত্র রেখে বেরিয়ে পড়ি ঋশিকেশ দর্শনে। ঋশিকেশ আসলে প্রকৃতি দর্শনের চেয়ে অন্তরের উপলব্ধিকে বেশি জাগরুক করে তোলে। দুই পাশে পাহাড়, পাহাড়ের বুকজুড়ে নানান রকম সবুজ গাছের আনাগোনা, ঠিক তার মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গার শান্ত শীতল জলধারা। গঙ্গার বুকজুড়ে ছোটবড় পাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, সেই পাথরকে অতিক্রম করে গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপন্ন বরফগলা জলের ধারা ক্রমাগত ছুটে চলেছে সমতলের দিকে।
আমরা রাম ঝুলা পেরিয়ে গঙ্গার ওপারে চলে আসি (এখানে গঙ্গা নদীর ওপর তিনটি ব্রিজ আছে, যেটি রাম ঝুলা, লক্ষণ ঝুলা ও জানকী ঝুলা নামে পরিচিত। রামায়ণ অনুসারে এ তিন নাম রাখা)। পাহাড়ি ঘন বনের মাঝে পাকা রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট বাড়ি। কিছু বাড়ি দেখে সেই প্রাচীন ভারতের তপোবনের মতো মনে হয়। মনে হচ্ছে, এ বাড়িতেই বসে হয়তো কোনো ধ্যানমগ্ন ঋষি তাঁর জীবনবোধের উপলব্ধিকে খুঁজে পেতেন।
আমরা ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছি। যতই সামনে এগোতে থাকি, ততই গঙ্গার জলের ধারার কলকল ধ্বনিতে মুগ্ধ হতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে একটি জায়গায় এসে গঙ্গার ধারে বসার জায়গা পেয়ে যাই। জায়গাটিতে বসে প্রকৃতিকে খুব আপনভাবে উপলব্ধি করা যায়। দুই পাশে পাহাড়ি ঘন জঙ্গল, তার ঠিক নিচেই খরস্রোতা গঙ্গার স্নিগ্ধ জলধারার দিকে তাকিয়ে থাকলে ভেতরে কেমন যেন একটা পরিবর্তন এসে ভর করে। প্রকৃতির সঙ্গে এক অদ্ভুত সখ্য গড়ে ওঠে, মনে প্রশান্তি এসে ভর করে। ঠিক সেই মুহূর্তে জাগতিক সব চিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে কে যেন ভেতর থেকে জীবনের জয়গান গেয়ে ওঠে। মনে হতে থাকে, জীবনও যেন গঙ্গার মতো বহতা এক নদী, যেখানে সুখ আছে, দুঃখ আছে, উত্থান আছে, পতন আছে, চড়াই আছে, উতরাই আছে।
প্রকৃতির এই নির্জনতাকে উপভোগ করে আমরা লক্ষণ ঝুলা পেরিয়ে চলে আসি গঙ্গা ঘাটে গঙ্গা আরতি দেখার জন্য। ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, শীতের হিমেল হাওয়া বয়ে চলেছে গঙ্গার ওপর দিয়ে, নদীর জলের কুলকুল শব্দ কর্ণকুহরে এসে প্রশান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে চলেছে। ঠিক তার মধ্যেই শুরু হয় গঙ্গা আরতি। নদীর পাড়ে হাজারো ভক্তের সমাগম। তাঁরা ভক্তির অর্ঘ্য নিয়ে মা গঙ্গার সামনে হাজির হয়েছেন। ধর্ম-প্রকৃতি আর মানুষের ভক্তির মেলবন্ধনে এক অন্য রকম আধ্যাত্মিক পরিবেশ তৈরি হয় ওই সময়টুকুর জন্য।
ঋশিকেশে আধ্যাত্মিক ভাবনার পাশাপাশি ভ্রমণকে উপভোগ করার নানান আয়োজন আছে। এখানে নিশ্চিন্তে ট্রেকিং করা যায়, ওয়াটার রাফটিং-এর মাধ্যমে জীবনের উচ্ছলতার স্বাদ নেওয়া যায়। আর তাই তো এখানে হাজারো পর্যটকের দেখা মেলে, যাদের একটা বড় অংশ পশ্চিমা দেশের নাগরিক। অনেকেই জীবন উপভোগ করতে এসেছেন, আবার অনেকেই জীবনকে অন্যভাবে উপলব্ধির জন্য এখানে এসে দিনের পর দিন অতিবাহিত করছেন। আত্মোপলব্ধির খোঁজে গঙ্গার পাড়ে বসে ধ্যানমগ্ন হয়ে জীবনের গূঢ় রহস্য খুঁজে চলেছেন অবিরত।
*লেখক: সুব্রত মল্লিক, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, কুষ্টিয়া।