মালয়েশিয়ার লাংকাউইয়ে চার দিন: প্রকৃতি, পাহাড় ও সমুদ্রের অপার অভিজ্ঞতা

লাংকাউইয়ে থ্রিডি আর্ট গ্যালারিতে ডাইনোসরের মুখ থেকে পালানোর নাটকীয় দৃশ্যছবি: লেখকের পাঠানো

মালয়েশিয়ার অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন গন্তব্য লাংকাউই। ইউনেসকো–স্বীকৃত গ্লোবাল জিওপার্কের অন্তর্ভুক্ত এই দ্বীপপুঞ্জ প্রকৃতি ও অ্যাডভেঞ্চারের এক অপূর্ব সমন্বয়। সম্প্রতি চার দিনের সফরে ঘুরে দেখা হয়েছে এই স্বপ্নময় গন্তব্য, যেখানে পাহাড়, সৈকত ও ইতিহাস একসঙ্গে মিশে আছে।

যাত্রা ও প্রথম অভিজ্ঞতা

লাংকাউইয়ে পৌঁছানোর পর বিমানবন্দর থেকে একটি ট্যাক্সি নিয়ে সরাসরি হোটেলে পৌঁছে যাই। এরপরই শুরু হয় প্রকৃতির সঙ্গে এক গভীর আত্মিক যোগাযোগ। সৈকতের হিম বাতাস আর চারপাশের প্রশান্ত পরিবেশ যেন আগমনের প্রথম মুহূর্তেই মুগ্ধ করে।

লাংকাউইয়ে দ্বীপে পিয়ারে ভিড়ছে নৌকাগুলো। চারপাশে পাহাড় আর নীল জলরাশি
ছবি: লেখকের পাঠানো

চেনাং বিচের সন্ধ্যা ও ফায়ার শো

প্রথম সন্ধ্যাটি কাটে লাংকাউইয়ের বিখ্যাত পান্তাই চেনাং বিচে। সমুদ্রের ধারে বিনা মূল্যে আয়োজিত ফায়ার শো দর্শনার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি করে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। পর্যটকদের সুবিধার্থে সেখানে থাকা রেস্টুরেন্ট থেকে মাত্র একটি ড্রিংক অর্ডার করলেই সিটে বসে উপভোগ করা যায় শোটি। আগুন আর মিউজিকের মিশেলে তৈরি শোটি চলে প্রায় রাত ১টা পর্যন্ত।

স্কাই ক্যাব ও স্কাই ব্রিজ: রোমাঞ্চের নতুন সংজ্ঞা

পরদিন সকালে লাংকাউই স্কাই ক্যাবের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। প্রায় ২ হাজার ৩২৩ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত গুনুং ম্যাট সিনক্যাং পাহাড়ের চূড়ায় যাওয়ার এই কেবল কার–যাত্রা পর্যটকদের জন্য এক দারুণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। সমুদ্র, পাহাড় ও সবুজ বন—একসঙ্গে উপভোগ করার সুযোগ তৈরি হয় পুরো পথজুড়ে।

চূড়ায় উঠে দেখা যায় স্কাই ব্রিজ, বিশ্বের অন্যতম উঁচু ঝুলন্ত সাসপেনশন ব্রিজ। জানা যায়, ব্রিজটির পুরো স্টিল স্ট্রাকচার গ্রাউন্ডে তৈরি করে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে পাহাড়ের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। এটিকে ধরে রেখেছে একটিমাত্র টাওয়ার ও স্ট্রং ক্যাবল। এখানেই শুটিং হয়েছে বলিউডের জনপ্রিয় সিনেমা শাহরুখ অভিনীত ‘ডন’-এর শেষ দৃশ্য।

লাংকাউইয়ে ঈগল দেখা
ছবি: লেখকের পাঠানো

থ্রিডি আর্ট গ্যালারিতে বাস্তব ও কল্পনার মিলন

স্কাই ব্রিজ ঘুরে এসে নিচে নামার পর দর্শনার্থীরা প্রবেশ করেন থ্রিডি আর্ট গ্যালারিতে। সেখানে বিশাল পেইন্টিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললে মনে হয়, যেন বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার জগতে পা রাখা হয়েছে।

স্কাই ক্যাবে চড়ে নীল জলরাশি আর পাহাড়, প্রকৃতি উপভোগ করেন পর্যটকেরা
ছবি: লেখকের পাঠানো

আইল্যান্ড হপিং: নীল জলের বুকে সবুজ পাহাড়ের রাজ্য

পরদিন সকালেই বুক করা হয় আইল্যান্ড হপিং ট্যুর। গাড়ি করে পৌঁছে যাওয়া হয় পিয়ারে, সেখান থেকে বোটে চড়ে একে একে ঘোরা হয় বেশ কয়েকটি দ্বীপে। এর মধ্যে প্রেগন্যান্ট মেইডেন আইল্যান্ড ছিল অন্যতম। দ্বীপটির একটি পাহাড়কে দূর থেকে দেখতে মনে হয় গর্ভবতী নারী শুয়ে আছেন।

পরে যাওয়া হয় ঈগল ওয়াচিং স্পটে, যেখানে আকাশ থেকে নেমে আসে একঝাঁক ঈগল—পর্যটকদের জন্য চরম রোমাঞ্চকর এক মুহূর্ত।

এখানেই জানা যায় ‘লাংকাউই’ নামটির উৎপত্তি—‘হেলাং’ অর্থ ঈগল, আর ‘কাউই’ মানে লালচে বাদামি রং। এখানকার আকাশে ওড়া ঈগলের রং থেকেই নামকরণ হয়েছে দ্বীপটির।

চেনাং বিচের ফায়ার শো দর্শনার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি করে এক অনন্য অভিজ্ঞতা
ছবি: লেখকের সৌজন্য

শেষ বিকেল: ফিরে দেখা চার দিনের ভ্রমণ

লাংকাউই ভ্রমণের শেষ বিকেলটি কাটে পান্তাই চেনাং বিচে। হোটেলের পাশেই অবস্থিত এই সৈকত পর্যটকদের মধ্যে দিন শেষে প্রশান্তির অনুভূতি এনে দেয়। সাদা বালু, নীল পানি আর নরম বাতাস যেন বিদায়ের আগেই হৃদয়ে গেঁথে যায়।

কেউ সমুদ্রে নেমে স্নান করছেন, কেউ–বা চুপচাপ বসে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন—সবার মধ্যেই একধরনের আবেগ কাজ করছে। পরদিন সকালে ফিরে আসার প্রস্তুতি থাকলেও মনের মধ্যে রয়ে যায় একরাশ তৃপ্তি ও স্মৃতি।

চার দিনের এই ভ্রমণে লাংকাউই শুধু একটি স্থান নয়, হয়ে উঠেছে এক অনুভূতির নাম। প্রকৃতি, ইতিহাস, আর রোমাঞ্চ একসঙ্গে যাঁদের আকর্ষণ করে—তাঁদের জন্য নিঃসন্দেহে এটি একটি আদর্শ গন্তব্য।

লাংকাউইয়ে স্কাই ব্রিজে ক্যামরাবন্দী লেখকসহ বন্ধুরা
ছবি: লেখকের পাঠানো