শিলং ভ্রমণ: যেখানে ঝরনা আপনাকে খুঁজবে
অনেকেই শিলংকে প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড বলেন। সবুজে ঘেরা পাহাড়, আকা-বাঁকা উঁচু-নিচু পথ, সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে যেতে পারেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে। অনেক দিন ধরে বন্ধুদের মুখে শুনে আসছিলাম শিলংয়ের সৌন্দর্যের কথা। কিন্তু সময়–সুজোগ করতে না পারায় যেতে পারছিলাম না, হঠাৎ বাল্যবন্ধু আইনজীবী মুর্শেদ আর ঢাকার বন্ধু শরিফের উৎসাহে দেখার সুযোগ হলো। হবিগঞ্জ শহর থেকে বাসে করে সিলেটের তামাবিল সীমান্ত দিয়ে ভারতের ডাউকি বাজারে গেলাম। তিন হাজার রুপি দিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করে আমরা রওনা হলাম শিলংয়ের উদ্দেশে।
বাংলাদেশে যেমন ঝরনা খুঁজে বের করে দেখতে যেতে হয় মেঘালয়ে, এখানে এর পুরোটাই বিপরীত। চলার পথে আপনার মনে হতেই পারে, ঝরনাই আপনাকে দেখতে এসেছে। ছোট–বড় মিলিয়ে এখানে যে কত ঝরনা রয়েছে, তার হিসাব হয়তো কারও কাছেই নেই।
ঝকঝকে রোদ, হঠাৎ অন্ধকার, ঝুমবৃষ্টি। এরপর একপশলা মেঘ এসে আপনাকে ভিজিয়ে যেতেই পারে। মেঘালয়ের প্রকৃতিটাই যেন এমন। জুন থেকে আগস্ট, অর্থাৎ বর্ষায় শিলং ভ্রমণের উপযুক্ত সময়।
যাওয়ার সময় ঘুরে যেতে পারেন এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলাইনং থেকে। এটি মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসিয়া পাহাড় জেলার একটি গ্রাম। এখানে যাওয়ার পথেই দেখা মিলবে অনেকগুলো ঝরনার। চোখ পড়লে সেখানে আপনি নিজেই থেমে যাবেন। তবে বৃষ্টি না হলে ঝরনায় পানির পরিমাণ খুবই কম থাকে।
এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলাইনং
ঝরনা আর মাওলাইনং দেখার সঙ্গে সঙ্গে চেরাপুঞ্জি যেতে পথের দুই পাশে দেখা মিলবে উঁচু–নিচু অনেক পাহাড়ের। মনে হবে, সব পাহাড়ের মধ্যে আপনি সবচেয়ে উঁচু পাহাড় দিয়েই যাচ্ছেন। চেরাপুঞ্জিতে থাকার জন্য অনেক হোটেল ও হোমস্টে সার্ভিস রয়েছে। যাওয়ার আগে অ্যাগোডা, মেক মাই ট্রিপ বা বুকিং ডটকম থেকে বুকিং দিয়ে যাওয়াই ভালো। কারণ, সেখানে হোটেল ও হোমস্টে সার্ভিসগুলো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে। কোথাও একসঙ্গে এসব পাবেন না। তাই গিয়ে খুঁজতে চাইলে ভ্রমণের আনন্দ অনেকটাই নষ্ট হতে পারে। কারণ, ডাউকি থেকে সব দর্শনীয় স্থান দেখে চেরাপুঞ্জি যেতে যেতে তিন-চারটা বেজে যাবে।
হোটেল বা হোমস্টে সার্ভিস নিতে দুজনের জন্য প্রতি রাতে খরচ হতে পারে দুই হাজার থেকে দুই হাজার পাঁচ শ রুপি। ডাউকি বাজার থেকে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে চেরাপুঞ্জিতে যেতে ট্যাক্সি ভাড়া নেবে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার রুপি।
সকালে উঠেই হোটেলে চেকআউট করে সরাসরি চলে গেলাম সেভেন সিস্টার ফলস দেখতে, এটি চেরাপুঞ্জির সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা। বৃষ্টি হলে এর সৌন্দর্য আপনাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই জলপ্রপাতের উচ্চতা ১ হাজার ৪৮৪ মিটার।
চেরাপুঞ্জির স্থানীয় নাম সোহরা বা সোরা। সেভেন সিস্টার ফলস দেখে যেতে পারেন মোসামাই গুহা, যার ভেতরের চারপাশে শুধুই পাথর। এই প্রাকৃতিক গুহায় প্রবেশের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে। চেরাপুঞ্জিতে সেভেন সিস্টার ফলস ও মোসামাই গুহা দেখার পর কয়েকটি ঝরনা দেখতে পারেন। এখানেও অনেকগুলো বড় ঝরনা রয়েছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবেন, তা ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কারণ, এসব জায়গা দেখা শেষ করে যেতে পারেন শিলংয়ে।
চেরাপুঞ্জি থেকে সব দর্শনীয় স্থান দেখে শিলংয়ে যেতে যেতে বেলা দুই-তিনটা বেজে যাবে। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে শিলংয়ে যেতে ট্যাক্সি ভাড়া নেবে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার রুপি। শিলংয়ে গিয়ে পছন্দ করে হোটেল ঠিক করে নিতে পারেন। শিলংয়ের পুলিশ বাজারের পাশের হোটেলগুলোতেই পর্যটকেরা বেশি থাকেন। এখানকার সেন্টার পয়েন্টের পাশে অনেক হোটেল রয়েছে।
শিলংগের সৌন্দর্যের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। পাহাড়ের ওপর সবুজ উঁচু–নিচু মাঠ। মাঠের তিন পাশে মেঘের ভেলা। সবুজ মাঠে বসে চায়ে চুমুক দিতেই একপশলা মেঘ এসে আপনাকে ভিজিয়ে দিতে পারে।
শিলং শহরের পাশের উমিয়াম লেক, এলিফ্যান্ট জলপ্রপাত, শিলং ভিউপয়েন্ট, গলফ লিংক, ওয়ার্ডস লেক ঘুরে আসতে পারেন। এ ছাড়া গাড়ির চালকের সঙ্গে চুক্তি করে স্পটগুলো নির্ধারণ করতে পারবেন। শুধু লাইট লুম দেখতে চাইলে ট্যাক্সি খরচ পড়বে ১ হাজার ৫০০ রুপি। সঙ্গে অন্যান্য জায়গা দেখতে চাইলে দুই হাজার পাঁচ শ থেকে তিন হাজার রুপি খরচ হবে।
সব জায়গা দেখা শেষ করে শপিং করতে পারেন। শিলংয়ে পুলিশ বাজারেই বিশাল নামের একটা সুপারশপ আছে, সেখান থেকে শপিং করতে পারেন। এ ছাড়া আশপাশে অনেক হকার্স মার্কেট রয়েছে। এখানকার দোকানদার ও বিক্রেতার ৮০ শতাংশই খাসিয়া সম্প্রদায়ের নারী। এদের দেখতে অনেকটা চীনের মানুষের মতো লাগে।
কেনাকাটা শেষে একটু সিনেমা দেখে নিতে পারেন। শিলংয়ে একটি ভালো সিনেপ্লেক্স রয়েছে। অঞ্জলি নামের এই সিনেপ্লেক্সে পুলিশ বাজার থেকে হেঁটে যেতে ১৫ মিনিট সময় লাগবে। আর ট্যাক্সিতে যেতে ১০০ থেকে ১৫০ রুপি ভাড়া নেবে।
মেঘালয়ের আরেকটি সুন্দর জায়গা হলো ডাউকি। ডাউকি সীমান্তে আসার আগে স্নোনেংপেডেং যেতে পারেন। স্নোনেংপেডেংয়ের স্বচ্ছ পানির নদী আপনাকে মুগ্ধ করবেই। চাইলে নৌকা নিয়ে ঘুরতে পারেন।
শিলং থেকে স্নোনেংপেডেং হয়ে ডাউকি সীমান্তে আসতে ট্যাক্সিতে খরচ হবে দুই হাজার পাঁচ শ থেকে তিন হাজার রুপি। সবশেষে বিকেল ৫টার মধ্যে ইমিগ্রেশন শেষ করে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবেন।
চাকরির সুবাদে অনেকগুলো দেশ ভ্রমণ করার সুযোগ আমার হয়েছে। কিন্তু আমার বাসা থেকে খুবই কাছে এত সুন্দর জায়গা ভ্রমণ করার স্মৃতি আমার মনে চিরজাগরূক হয়ে থাকবে।
দরকারি তথ্য—
১.
ভারতের মেঘালয়ের শিলং ভ্রমণের জন্য আপনার পাসপোর্টে ৬ মাসের মেয়াদসহ বাই রোড ডাউকি পোর্ট দিয়ে ভিসা থাকতে হবে।
২.
ভ্রমণকর ৫০০ টাকা ঢাকা, সিলেট বা তামাবিল সীমান্তের সোনালী ব্যাংকে দিতে পারেন। তবে ঢাকা থেকে যাঁরা যাবেন, তাঁরা ঢাকায় দিয়ে গেলে অথবা হবিগঞ্জের চুনারুঘাট সোনালী ব্যাংকের শাখায় দিয়ে গেলে কম সময়ে ইমিগ্রেশন শেষ করতে পারবেন।
৩.
ভারত ভ্রমণের জন্য ডলার বা টাকা নিয়ে যেতে পারেন। ইমিগ্রেশন শেষ করে ডাউকি বাজার থেকে রুপি করে নিতে পারেন। শিলংয়ের চেয়ে ডাউকি বাজারে ভালো রেট পাবেন।
৪.
সব জায়গায় ট্যাক্সি নেওয়ার আগে দামাদামি করবেন। কমপক্ষে তিনজনের সঙ্গে কথা বলবেন। সব জায়গার মানুষ বাংলা মোটামুটি বোঝেন।
৫.
মেঘালয়ে যাওয়ার আগে অবশ্যই হোটেল বুকিং দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন।
৬.
মেঘালয় ভ্রমণের জন্য চারজনের দল হলে সবচেয়ে ভালো। কারণ, এক ট্যাক্সিতে চারজনের জায়গা হওয়াতে যাতায়াত খরচ কমবে।
কীভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে সিলেটে বাস, ট্রেন বা আকাশপথে যেতে পারেন। সিলেট থেকে বাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা গাড়িতে যেতে হবে তামাবিল সীমান্তে।
খাবারদাবার
মেঘালয়ের সব জায়গায় ভেজ ও নন–ভেজ থালি পাওয়া যায়। এ ছাড়া মেনু থেকে পছন্দ অনুযায়ী খাবার নিতে পারেন। তবে খাবারের স্বাদ বাংলাদেশের খাবারের চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন। এ জন্য জায়গাভেদে ভিন্ন ভিন্ন রেস্টুরেন্টের খাবার টেস্ট করতে পারেন।
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]