অন্নপূর্ণার পথে–প্রান্তরে

থরং লা পাসে ৯ বাংলাদেশির ট্র্যাকিং দল।
ছবি: আরাফাত রহমান

‘হৃদয় আমার উড়ছে রেশমের মতো, পাহাড়ি হাওয়ায়
উড়ব নাকি পাহাড়চূড়ায় বসে থাকব? ভাবছি আমি তাই!’
নেপালের পাহাড়-পর্বতের পথে যেতে যেতে গাড়িতে ‘রেশম ফিরিরি’ নামের একটা জনপ্রিয় গান অহরহই শোনা যায়। গানের প্রথম দুই লাইনে যে অনুভূতি ব্যক্ত করা হয়েছে, অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্র্যাকে গেলে কিছুক্ষণ পরপরই মাথায় এই গানের লাইন ঘুরতে থাকে। এমনই এক অনুভূতিকে সঙ্গী করে গত ২০ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত ৯ জনের একটা বাংলাদেশি দল শেষ করলাম অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্র্যাক।

অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্র্যাকের যাত্রা শুরু হয়েছিল কাঠমান্ডু থেকে বেসিশহরে যাওয়ার মাধ্যমে। তবে ছুটির কারণে হাতে সময় কম থাকায় আমরা পরের দিন বেসিশহর থেকে চামে পর্যন্ত পথটুকুও গাড়িতে গেলাম।

তৃতীয় দিন থেকে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। কখনো পাহাড়ের বুকে পাথর বিছানো পথে, কখনোবা পাহাড়ের কিনারা ধরে। তবে দূর থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল শ্বেতশুভ্র বরফে মোড়ানো পর্বতের চূড়াগুলো। সাত থেকে আট ঘণ্টা হেঁটে আমরা চামে থেকে যখন আপার পিসাংয়ে (৩ হাজার ২৫০ মিটার) পৌঁছলাম, শুরু হলো তুষারপাত। দেখতে পেলাম, ঠিক সামনেই মেঘের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে অন্নপূর্ণা-২ পর্বতের চূড়া।

নেপালের মানাং গ্রাম।
ছবি: আরাফাত রহমান

পরদিন সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন অন্নপূর্ণা-২ পর্বতের চূড়া স্পর্শ করল, আমরা সবাই সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেদিকে। সঙ্গে ক্যামেরা থাকায় ঝটপট বেশ কিছু ছবিও তুলে ফেলা হলো। সম্মোহন কাটার পর হাঁটতে শুরু করলাম মানাংয়ের (৩ হাজার ৫১৯ মিটার) উদ্দেশে। যেতে যেতে পথের এক পাশে উঁচু পাহাড় আর অন্য পাশে বরফে আবৃত সুউচ্চ পর্বতমালা সঙ্গ দিল। মানাং পৌঁছানোর আগেই শুরু হলো তুষারপাত আর ঝোড়ো বাতাস। বহু কষ্টে আমরা শেষ পথটুকু পাড়ি দিয়ে মানাং পৌঁছে টি-হাউসের হিটারের চারপাশে গোল হয়ে বসে নিজেদের উষ্ণ করায় ব্যস্ত হলাম।

মানাং পৌঁছে আমাদের এক দিন থাকতে হয়েছে। কারণ, মানাং থাকার পরের দিন ৪ হাজার ৬০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত আইস লেক দেখে আবার মানাংয়ে ফিরতে হবে। পরের দিন সকালে আকাশ ছিল মেঘলা। এর মধ্যেই আমরা আইস লেকের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করলাম। তবে ৪ হাজার ১০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত ওঠার পর বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ফিরতে হলো মানাংয়ে।

পুরো ট্র্যাকিংয়ে এ রকম বিরূপ আবহাওয়া সামলাতে হয়েছে আমাদের। যদিও এবারের ট্র্যাকিং ছিল গ্রীষ্মকালীন ট্র্যাক; কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয়ের আবহাওয়ার ধরন বদলে গেছে গত কয়েক বছরে। গ্রীষ্মে তীব্র শীত থাকছে; আবার অক্টোবরের মতো শুকনা মাসেও ভরা বর্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে ট্র্যাকারদের।

মানাং ফিরে এসে কিছুটা মন খারাপ লাগলেও পরের দিন সকালে সূর্যমামার দেখা পেয়ে মন ভালো হয় গেল। সূর্যের আলোয় মানাং থেকে দেখতে পেলাম মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৭ হাজার ৫৫৫ মিটার উচ্চতার অন্নপূর্ণা-৩ এবং ৭ হাজার ৪৫৫ মিটার উচ্চতার গঙ্গাপূর্ণা পর্বতচূড়া।

দারুণ আপ্লুত হয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ি পথে। কখনো শুকনো সে পথ, কখনো বরফে পিচ্ছিল হয়ে আছে, আবার কখনো কর্দমাক্ত! হঠাৎ হয়তো সামনে পড়ে গেল একটা সাসপেনশন ব্রিজ। তার নিচ দিয়ে প্রচণ্ড শব্দে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে আর দূরে তিলিচো পর্বতচূড়ার হাতছানি নিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম অনিন্দ্যসুন্দর গ্রাম শ্রী খারকাতে (৪ হাজার ৮০ মিটার)।

অন্নপূর্ণা-২ চূড়ার সামনে বাংলাদেশি ট্র্যাকিং দল।
ছবি: আরাফাত রহমান

শ্রী খারকা থেকে আমাদের পরবর্তী উদ্দেশ্য ছিল তিলিচো বেইস ক্যাম্প। সেখানে যাওয়ার রাস্তাটা খুব সহজ মনে হলেও একটা পর্যায়ে আমাদের পাড়ি দিতে হলো ভূমিধস হয়—এমন একটা অঞ্চল। খুবই সংকীর্ণ সে পথ, ওপরে তাকালে শুধু বড় বড় বোল্ডার দেখা যায়। একটা পর্যায়ে মনে হলো যেন ইস্টার দ্বীপের মোয়াই ভাস্কর্য দেখছি। নিচে তাকালে মনে হয়, এই বুঝি কয়েক হাজার ফুট নিচে পড়ে যাব। দূরে তাকালে মনে হবে আপনি মোনালিসার চিত্রকর্মে মোনালিসার পেছনের দৃশ্যটি দেখতে পাচ্ছেন। এই বিপৎসংকুল পথ পার হয়ে তিলিচো পর্বতচূড়া দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম তিলিচো বেইজ ক্যাম্পে।

তিলিচো বেইজ ক্যাম্পে পৌঁছে আমরা ভালো করে বিশ্রাম নিলাম। কারণ, পরের দিন খুব চ্যালেঞ্জিং একটা দিন ছিল। খুব ভোরে উঠে যেতে হবে ৪ হাজার ৯২০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত তিলিচো লেক দেখতে। সেখান থেকে তিলিচো বেইজ ক্যাম্পে ফিরে আবার দুপুরের পর শ্রী খারকার উদ্দেশে যাত্রা আছে। তিলিচো লেক যাওয়ার রাস্তায় ফের ভূমিধসপ্রবণ অঞ্চলের দেখা মিলল।

এমনকি আমার ঠিক তিন ফুট সামনে বেশ বড় আকারের এক পাথর এমন সজোরে আছড়ে পড়ে নিচের দিকে চলে গেল যে আমি মিনিট দুয়েক স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন বিপৎসংকুল রাস্তা ধরে তিলিচো লেকের কাছাকাছি যখন পৌঁছালাম, তখন চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ। গ্রীষ্মকালে যে নীল পানির তিলিচো হ্রদ দেখা যায়, সেটিও জমে বরফ হয়ে আছে।

তিলিচো হ্রদে ওঠানামা করে ট্র্যাকিংয়ের শেষ দিনের সবচেয়ে কঠিন অংশের (থরং লা পাস) জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গেল সবারই। তিলিচো থেকে শ্রী খারকা ফিরে আমরা পরের দিন হাঁটতে শুরু করলাম ইয়াক খারকার উদ্দেশ্যে। আগের দিন সারা রাত তুষারপাত হওয়ায় পুরো পথই বরফে ঢাকা ছিল। ঠিক রাস্তার ডান পাশে সঙ্গ দিচ্ছিল অন্নপূর্ণা-৩ ও গঙ্গাপূর্ণা পর্বত। সেই সঙ্গে রাস্তায় দেখা মিলল প্রচুর লোমশ ইয়াক ও ঘোড়ার। একইভাবে ইয়াক খারকা থেকে আমরা ২৯ এপ্রিল পৌঁছে গেলাম থরং ফেদিতে (৪ হাজার ৫৪০ মিটার)। কিছুক্ষণ পরেই শুরু হলো তুষারপাত, তাপমাত্রা তখন মাইনাস ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

পরের দিনটা ছিল ট্র্যাকিংয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন দিন। আমাদের লক্ষ্য ছিল ৫ হাজার ৪১৬ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত থরং লা পাস পার হয়ে মুক্তিনাথে (৩ হাজার ৭০০ মিটার) পৌঁছানো। থরং লা পাসে যেতে প্রথমে আমাদের থরং ফেদি থেকে বেশ খাড়া একটা পাথুরে পাহাড় বেয়ে ৪ হাজার ৮৮০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত হাই ক্যাম্পে যেতে হবে। এরপর সেখান থেকে থরং লা পাস। ভোর চারটায় মাথায় হেডলাইট নিয়ে আমরা যখন হাঁটতে শুরু করেছি, তখন তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সঙ্গে প্রচণ্ড তুষারঝড়। তারপরও মনোবল শক্ত করে আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছলাম হাই ক্যাম্পে।

হাই ক্যাম্পে পৌঁছে দেখি, বিদেশি অনেক দলের সদস্যদের অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেছে। একটা দলের সঙ্গে থাকা নেপালি গাইডরা বলছিল, এই আবহাওয়ায় তারা থরং লা পাস পার হতে চায় না! তাদের কথাবার্তায় কিছুটা ভড়কে গেলেও আমাদের দলের সবাই মিলে সিদ্ধান্ত হলো আমরা থরং লা পাস পার হব। আবার হাঁটা শুরু করলাম। তুষারঝড়ের কারণে ১০ ফুট দূরের কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। পথে দেখলাম অনেক ট্র্যাকার অসুস্থ হয়ে ফেরত যাচ্ছে, নয়তো ঘোড়ার সাহায্য নিচ্ছে। এভাবে আবহাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেলা সাড়ে ১১টায় আমরা থরং লা পাসে পৌঁছালাম।

প্রচণ্ড বাতাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে দ্রুত কয়েকটা ছবি নিতে পারলাম আমরা। তারপর শুরু হলো মুক্তিনাথের উদ্দেশ্যে নামা। নামার পথে প্রথমে বেশ খানিকটা পথ বরফে ঢাকা, এরপর পুরোটাই ছিল কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। ফলে মনে হচ্ছিল, অনন্তকাল ধরে যেন আমরা হাঁটছি ঠিকই, কিন্তু পথ শেষ হচ্ছে না! শেষে বিকেল চারটার দিকে আমরা লোকালয়ের দেখা পেলাম। সেখানে কিছু খেয়েদেয়ে আবার হাঁটা শুরু করে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আমরা পৌঁছালাম মুক্তিনাথে।

অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্র্যাকিংয়ে শরীর ও মনের এক কঠিন পরীক্ষা নিয়েছে। তবে ট্র্যাকটা শেষ করতে পেরে সবার অন্য রকম এক আনন্দও কাজ করেছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন টি-হাউসে কাটানো সময়গুলো সারা জীবন মনে রাখার মতো কিছু স্মৃতি তৈরি করেছে। প্রতিদিন ট্র্যাক শেষ করে দেওয়া আড্ডাগুলো পরের দিন হাঁটা শুরু করতে প্রেরণা জুগিয়েছে সবাইকে। টি-হাউসগুলো পরিচালনা করা পরিবারের সদস্যদের চমৎকার পারিবারিক বন্ধন মুগ্ধ করেছে বারবার। সারা দিন কাজ শেষে তারা যখন একসঙ্গে বসে আড্ডা দেয়, তখন অন্য কোনো টেবিলে বসে সেই আড্ডাগুলো দেখতেও খুব ভালো লাগে। ভাষার ব্যবধান যেন সেখানে কোনো দেয়াল তৈরি করতে পারে না।

ট্র্যাকিং করতে গিয়ে প্রতিদিনের হাঁটা শেষ করে ক্লান্তিতে বারবার মনে হয়েছে, এবারই শেষ, আর কোনো ট্র্যাকিং নয়। কিন্তু ট্র্যাকিং শেষ করে জন–অরণ্যে ফেরত এসে নির্জন পাহাড় আর রহস্যময় পর্বতের জন্য আবেগ তৈরি হয়। মনে হয়, আহা, কী সময়টাই না ফেলে এসেছি! তখন সবুজ পাহাড় আর সাদা বরফে ঢাকা পর্বতের ডাক উপেক্ষা করে ঘরে বসে থাকা দায় হয়ে যায়। সেই ডাক আবার শুনতে পাচ্ছি কানে। আরেকটা গল্প লিখতে তাই বোধ হয় খুব বেশি দেরি হবে না।

  • লেখক: আরাফাত রহমান: গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক