বাগেরহাটের পথে—প্রশিক্ষণ, প্রকৃতি আর স্মৃতির গল্প

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

২৮ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে আমরা যাত্রা শুরু করি। ঢাকার দোহার হয়ে পদ্মার পাড়ে গিয়ে সূর্যের আলো আর হাওয়ার ছোঁয়ায় মনে হলো প্রকৃতির এক অদ্ভুত সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে চারদিকে। সামনে এগোতেই জানালার বাইরে দেখা মেলে সবুজে ঘেরা গ্রাম, খোলা মাঠ আর বিস্তীর্ণ জলাভূমি। সেই পথ ধরে আমাদের গন্তব্য বাগেরহাট। মূল উদ্দেশ্য SOS Children’s Villages Bangladesh আয়োজিত দুই দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর পর বুঝলাম, এই সফর শুধু শেখার নয়; বরং জীবনের ঝুলিতে যোগ হয়ে থাকবে অসংখ্য রঙিন স্মৃতি।

প্রথম দিন: প্রশিক্ষণ ও মতবিনিময়

বাগেরহাটে পৌঁছে দুপুরের খাবার খাওয়ার পর আমরা অংশ নিলাম প্রশিক্ষণ কর্মশালায়। মূল বিষয়বস্তু ছিল Climate Resilient Agricultural Opportunities; অর্থাৎ কীভাবে কৃষির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের মধ্যেও অভিযোজনক্ষমতার আরও বৃদ্ধি করা যায় এবং কৃষির নতুন সম্ভাবনার দিকগুলোকে সম্প্রসারিত করা যায়; সেটিই ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। SOS Youth Children- Village-Cum- Training Center–এর প্রজেক্ট কো–অর্ডিনেটর শামীম রেজা ভাই শুরুতেই তাঁদের ট্রেনিং সেন্টার সম্পর্কে ধারণা দিতে লাগলেন এবং একই সঙ্গে কৃষির ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে থাকলেন। পরবর্তী সময়ে এই কর্মশালার প্রধান অতিথি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তন্ময় দত্ত তাঁর মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে থাকলেন। তাঁর কথায় উঠে আসে কৃষকেরা কীভাবে লবণসহিষ্ণু ফসল, খরা প্রতিরোধী ধান কিংবা নতুন সেচব্যবস্থার মাধ্যমে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের জন্য শুধু হুমকি নয়; বরং এটি নতুন ধরনের অভিযোজন এর পথও দেখাচ্ছে। এ ছাড়া প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কৃষির নানা বাস্তব সমস্যা ও সমাধান নিয়ে সরাসরি মতবিনিময়ের সুযোগ পান। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন প্রযুক্তি নিয়ে, কেউ আবার কৃষি ও বাজার ব্যবস্থাপনার মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে মতামত দিলেন। আলোচনা শুধু একমুখী ছিল না, বরং জ্ঞান বিনিময় আর বাস্তব অভিজ্ঞতার এক মেলবন্ধন ঘটেছিল সেখানে।

দ্বিতীয় দিন: প্রকৃতির সৌন্দর্য ও ইতিহাসের নিদর্শন

পরদিন সকালে নাশতা করার পর শুরু হয় আমাদের দ্বিতীয় দিনের প্রশিক্ষণ। শুরুতেই আমাদের কাছে এই চ্যারিটি অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি খাতে কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে, এ বিষয়ে আরও বিশদভাবে প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে দেখানো হয়। একই সঙ্গে অভিযোজনের দিকগুলো সম্পর্কেও আমাদের ধারণা দেওয়া হয় এবং ভবিষ্যতে গবেষণার সুযোগ ও ক্যারিয়ার গাইডলাইন নিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানতে পারি। এরপর প্রশিক্ষণ শেষ হলে আমরা সবাই মিলে ট্রেনিং সেন্টারটি ঘুরে দেখতে শুরু করি।

১০ একর জায়গার ওপর নির্মিত এ ট্রেনিং সেন্টারে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগলের খামার এবং এর পাশাপাশি সবজি ও মৎস্য চাষ হয়। এককথায়, কৃষি বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সবকিছুই রয়েছে এই ট্রেনিং সেন্টারে। পুরো এলাকাতেই রয়েছে ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিপোকার শব্দ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বাস্তুসংস্থানের এক অনন্য পরিবেশ। পুরো জায়গা ঘুরে দেখার পর আমরা রওনা হলাম বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী ষাট গম্বুজ মসজিদ দেখার উদ্দেশে। ভেতরে প্রবেশের পর বিশ্বঐতিহ্যের এই স্থাপনা বর্তমান সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে নিয়ে গেল একদম অতীতে। বিস্তীর্ণ সবুজ এই মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাচীন মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করলাম, ইতিহাসও টেকসই হতে পারে, যদি মানুষ তা আগলে রাখে। শুক্রবারের জুমার নামাজ শেষ করে মসজিদের শীতল প্রাঙ্গণে হেঁটে বেড়ানোর সময় মনে হলো, স্থাপত্য শুধু ইটপাথরের কাজ নয়; বরং এর ভেতর আছে মানুষের স্বপ্ন, বিশ্বাস আর যুগের পর টিকে থাকার গল্প। ঘোরাঘুরি শেষ করে বেলা দুইটার সময় আমরা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ফিরে এলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই মিলে আমারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম।

সম্পর্ক আর স্মৃতির গল্প

প্রশিক্ষণে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ছিল নতুন অনেক বিষয় সম্পর্কে জানতে পারা এবং একে অপরের সঙ্গে তৈরি হওয়া সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। প্রশিক্ষণ আর ভ্রমণের ফাঁকে ফাঁকে তৈরি হয়েছে নতুন সম্পর্ক, জন্ম নিয়েছে বন্ধুত্ব। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের নিয়ে একসঙ্গে বসে কথা বলেছি কৃষি, পরিবেশ ভবিষ্যতের স্বপ্ন আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে। কেউ বলেছেন নিজের গ্রামের গল্প, কেউ শুনিয়েছেন ছোট্ট কোনো সাফল্যের অভিজ্ঞতা। এই কথোপকথনগুলো শুধু তথ্যের আদান-প্রদানই ছিল না; বরং একে অপরকে জানা–বোঝার আর কাছাকাছি আসার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। ভ্রমণের পথে একসঙ্গে ছবি তোলা, মাঠের সবুজে হেঁটে বেড়ানো, পুকুরপাড়ে বসে থাকা কিংবা দুপুরে খাবার টেবিলে হাসাহাসি—সবকিছু মিলিয়ে যেন তৈরি হয়েছিল এক পরিবারের মতো পরিবেশ। আর এসব ছোট ছোট মুহূর্তই ভ্রমণকে করে তুলেছে আরও প্রাণবন্ত।

ফিরে দেখার মুহূর্ত

বাগেরহাটে এই দুই দিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালা আমার কাছে শুধুই একটি শিক্ষণীয় বিষয় ছিল না; বরং এটি ছিল পরস্পরের মধ্যে আইডিয়া শেয়ারিংয়ের এক দারুণ সুযোগ। এখানে আমরা যেমন শিখেছি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া কৃষির সম্ভাবনার দিকগুলো, তেমনি পেয়েছি প্রকৃতির স্পর্শ, ইতিহাসের ছোঁয়া আর সহপাঠীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার অন্য সুযোগ। এই ট্রেনিং আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে, শিক্ষা কেবল বই আর শ্রেণিকক্ষের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং প্রকৃত শিক্ষা পাওয়া যায় মানুষের সঙ্গে মিশে, ইতিহাসের ছায়ায় আর প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে। দিন শেষে আমি শিখেছি দায়িত্বশীল হতে, ভিন্নভাবে ভাবতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য এক পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখতে।

*লেখক: এ বি এম সিয়াম আহমেদ, শিক্ষার্থী, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ