সুন্দরবনের রূপগাথা

ছবি: লেখক

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ বাংলাদেশের যে কটা সৌন্দর্য এখনো টিকে আছে, সুন্দরবন তার মধ্যে অবশ্যই অন্যতম! পাঠ্যবই, গল্পের বই বা সংবাদপত্রের কল্যাণে যতটুকু জেনেছি, তাতে কাজের কাজ একটাই হয়েছে, মনের গহিনে একটা লক্ষ্য নির্ধারণ হয়েছে, আর সেটা হলো, আমাকে সুন্দরবন যেতে হবে। কিন্তু সবাই যেভাবে সুন্দরবন দেখে, আমি চেয়েছিলাম ভিন্নভাবে দেখতে! সুযোগ যে হাতেনাতে চলে আসবে, তা কল্পনাতেও ভাবিনি! জিকু জানাল সুন্দরবন যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে! তবে গতানুগতিক নয় মোটেই, সুন্দরবনে ক্যাম্পিং করা হবে।

যেখানে বিপদের ভয়, সেখানেই আমার যেতে হয়। এর মানে এই নয় আমি খুব সাহসী। বরং ভয়ের কারণে নিজ বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ খুব উপভোগ করি! নিঃসন্দেহে বনের ভেতর ক্যাম্পিং করা হলে তা আমার মধ্যে আলাদা একটা উত্তেজনা নিয়ে আসবে। সত্যি বলতে, আমি সেই সুযোগ হেলায় ফেলায় হারাতে চাইনি! জিকুকে বললাম, আমি আছি। এবার পরিকল্পনা সাজাও। আমার মতো এমন কিছু পাগল আছে, যাদের পাগলামিতে সফর প্রস্তুত হয়ে গেল।

কথা বলছি গত বছরের এমন এক সময়ের।

আমরা নিজেদের দেখতে পেলাম সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে। উদ্দেশ বাগেরহাটের শরণখোলায় রায়েন্দা, বাদল চত্বরের পাঁচ রাস্তার মোড়। পৌঁছালাম মধ্য রাতে। আগেই হোটেল ঠিক করা ছিল। মনে আছে, সেই রাতে বিশ্বকাপের ব্রাজিলের প্রথম খেলা ছিল! তাই গ্রামবাসী সবাই জেগে ছিলেন। গ্রামের আনন্দ ভিন্ন। বাজারের মধ্যে রাস্তার পাশে একটা টেলিভিশন। আর তার চারপাশে চেয়ার, বেঞ্চ বা ইট বিছিয়ে গ্যালারি বানানো হলো। জানালা দিয়ে সেই দৃশ্য দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। রোমাঞ্চিত আমি হোটেল থেকে বের হয়ে সেই ভিড়ে হারিয়ে গেলাম।

ছবি: লেখক

খেলা শেষে হোটেলে ফিরে হালকা ঘুম দিলাম। সকালে উঠেই চটজলদি রওনা! চলে গেলাম নৌকাঘাটে। সাহা মিষ্টান্ন ভান্ডারে নাশতা করলাম। এই দোকানের পরোটা আলাদা রকম, আর অবশ্যই স্বাদ আছে! তার চেয়েও বেশি স্বাদ মিষ্টির। আমরা কয়েক প্রকারের মিষ্টির স্বাদ নিলাম। নৌকা ঘাটের সঙ্গেই আছে। গোলপাতার ছাউনি দেওয়া চায়ের দোকান। হতাশ হলাম, এখানের সাধারণ চায়ের দোকানে দুধ চা পাওয়া যায় না। তবে চা ভালো ছিল।

সব করতে করতে আমাদের বেশ সময় লাগল। শেষমেশ নৌকা ছাড়ল। যদিও আমরা গত রাত থেকে বেশ কিছু ছবি তুলেছি। তবে এবার ছবি তোলার হার একটু বেড়ে গেল বৈকি। এর মূল কারণ হলো, কিছুদিন আগেই মুক্তি পাওয়া ‘হাওয়া’ সিনেমার নৌকার মতো বেশ কিছু নৌকা এখানে শোভা পাচ্ছিল। তাই ক্যামেরায় বন্দী করার লোভ কেউ সামলাতে পারেনি।

খানিক পরেই আমরা মূল নদীতে চলে এলাম। এবার লম্বা পথ। ইঞ্জিনের শব্দটা মোটেই মধুর ছিল না। মানিয়ে নিয়েছিলাম। রাতে হালকা ঠান্ডা থাকলেও দিনে সূর্যের ধমক বেশ ভালোই খাচ্ছিলাম। তাই সবাই মাথা মণ্ড পেঁচিয়ে নিচ্ছিল গামছা বা ক্যাপে। বেশ কিছু সময়ের পর সুন্দরবন দেখা গেল। যদিও আমাদের গন্তব্যে যেতে আরও সময় লাগবে।

ছবি: লেখক

আমরা প্রথম যে অংশে নামলাম, সেই অংশে বাঘ আর হরিণ ছাড়া আর সব আছে। মূলত সুন্দরবনের কিছু বিশেষ গাছ এখানে বেশ ভালো ভাবে দেখা যায়। তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘টাইগার ফার্ন’। এই গাছের সবুজ পাতার রঙের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে হলুদাভ বা সোনালি রঙের ছটা। তাই এই গাছে বাঘ খুব সহজে লুকিয়ে থাকতে পারে। এ ছাড়া বনের এই অংশে সব গাছ দেখে বেশ মুগ্ধ হয়েছি। মাথা উঁচু করে এক একটা গাছ নিজের আলাদা একটা পরিচয় দিচ্ছে। উপভোগ্য ছিল সময়টা!

এখানে বেশি সময় ব্যয় করিনি। নৌকা নিয়ে বের হয়ে এলাম অন্য অংশে, যার নাম ‘বর্গী’। বন বিভাগের এ স্পটে ডিঙি নৌকা করে বনের ভেতরে গেলাম। নৌপথের সঙ্গে দুই পাড়ের দূরত্ব ছিল বড়জোর এক গজ। তাই ব্যাপারটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে বুকের হালকা ঢিপঢিপ শব্দ টের পাচ্ছিলাম। কারণ, বাঘ চাইলেই একলাফে নৌকায় এসে বলতে পারে, ‘আমারে নিবা মাঝি, লগে?’

ডিঙির পর্ব শেষ করলাম। এখানেই একটা পুকুর আছে। বেশ কিছুদিন আগে ‘প্রথম আলো’য় দেখেছিলাম ছবিসহ খবরে। এই পুকুরে এসে বাঘ বিশ্রাম নিচ্ছিল। তাই বাধ্য হয়েই বন বিভাগের লোকজন ঘরের মধ্যে স্বেচ্ছায় বন্দী ছিলেন। আমাদের তাঁরা যখন বলেছিলেন, এখানে বাঘের আনাগোনা আছে। আমরা বিশ্বাস করিনি আসলে। পত্রিকায় ছবি দেখে ওই মুহূর্তের কথা ভেবে এখনো ভিরমি খাই। তবে বিকেল পর্যন্ত সেখানে সময় কাটালাম! বিকেলের শুরুটা সেখানে হালকা মিহি বাতাস। একটা বেঞ্চে বসে কবি হয়ে যাওয়ার জন্য বেশ উপযুক্ত পরিবেশ! সেই পরিবেশ থেকে ছুটি নিয়ে আবার রওনা হলাম আমাদের দিনের শেষ লক্ষ্যে, অর্থাৎ যেখানে আমরা ক্যাম্পিং করব। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

ছবি: লেখক

বিশাল সুন্দরবনের সত্যিকারের সৌন্দর্য আসলে এবার শুরু। পড়তি বিকেলে আবছা আবছা আলোয় নদীর পাড়ে বনের মধ্যে কোনো এক বানরের উঁকি দেওয়া, অথবা আমাদের দেখতে পেয়েই হরিণের ভোঁ দৌড়ে বনে হারিয়ে যাওয়া; এমনকি ধবল বকের কথা আলাদা করে বলব না। আমি বলব একটা নিস্তব্ধতার কথা। কেমন যেন একটা নীরবতা এক এক করে বেরিয়ে আসছিল বনের ভেতর থেকে, যা থেকে আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল ভয়ংকর এক রাতের।

আমরা যখন গন্তব্যে পৌঁছালাম, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত তখন। তাঁবু খাটানো খুব অল্প সময়েই হয়ে গেল। নৌকায় রান্নার কাজ চলছে। হালকা ঠান্ডা আর ওপরে পরিষ্কার আকাশ। সেখানে অঙ্কিত হয়ে আছে অসংখ্য তারা। আমি এত এত তারা একসঙ্গে কখনো দেখিনি। স্পষ্ট ছিল সপ্তর্ষি। স্পষ্ট ছিল কালপুরুষ। তারা-দর্শন শেষে সবাই মিলে রাতের খাবার উপভোগ করে একসঙ্গে গল্প করলাম ঘণ্টাখানেক।

ছবি: লেখক

এবার আসি আসল কথায়, যেখানে ক্যাম্প করেছি, তার পাশেই সরু জলপথ। অপর পাশেই সুন্দরবনের শুরু। মধ্যে ব্যবধান হলো মাত্র আট থেকে নয় গজ। বনের এ অংশে একটা বেঙ্গল টাইগার আছে এবং অবশ্যই তার আনাগোনা আছে। তার মানে আজ রাত আমরা বাঘের চোয়ালের নাগালে রাত কাটাব।

যতক্ষণ গল্পে ছিলাম, ভালোই ছিলাম। যখন সিদ্ধান্ত এল, এবার ঘুমাতে হবে, তখন ভয় শুরু হলো।

রাজ্যের যত অজানা ভয় আজ আমাদের ওপর ভর করল। আমরা সবাই সাহসী হওয়ার ভান ধরে নিজেদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। একসময় ঘুম দিলাম। রাত পেরিয়ে ভোর হলো। ভোরে তাঁবু অল্প অল্প খুলে যখন বাইরের আলো দেখলাম, আমি বলব, মুগ্ধতার সব পেয়েছি এখানে। কুয়াশা আর ধোঁয়াশা চারপাশ! বাইরে এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বনের দিকে তাকিয়েছিলাম!

পাশের তাঁবুর লাবণ্য আপু নাকি একদম ঘুমাতে পারেননি। বিকট শব্দ হচ্ছিল নাকি। তবে সেটা অবশ্যই বাঘের নয়। ঘুমের ঘোরে মানুষের নাকের ডাক। আমরা সবাই বেশ হাসলাম। হয়তো বাঘ নিজেও এ নাক ডাকার শব্দ শুনে আসেনি আশপাশে। কাছেই ছিল বেশ কিছু গোলপাতার গাছ। তাদের সঙ্গে চোখে চোখে আলাপ করলাম! ছবিও তুললাম দলগতভাবে।

অল্প কিছু হেঁটে একটা নৌকা নিলাম, তা দিয়ে অপর পাশে পৌঁছালাম। বাগেরহাটের এ অংশ হলো চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী টহল ফাঁড়ি। কর্মকর্তাদের থেকে অনুমতি নিয়ে গাইডসহ হাঁটা দিলাম এবার গহিন বনের ভেতর। এবার পেলাম আসল বনের দেখা। এক ফুট রাস্তা যদি আরামে হাঁটা যেত। পুরো বন যেন জিলাপির প্যাঁচ। লতাগুল্ম দিয়ে এমনভাবে হিজিবিজি হয়ে আছে, পাঁচ মিনিট হাঁটতে না হাঁটতেই হাঁপিয়ে গেলাম। আর বুঝলাম, এখানে যদি বাঘের দেখা পাই! তবে একদম রক্ষা নেই। কারণ, আমাদের হাঁপানো রাস্তায় বাঘ কাঁপিয়ে যাবে খুব সাধারণভাবেই।

ছবি: লেখক

এর চেয়েও ভয়ংকর ছিল মশা। পিচ্চি মশা, কিন্তু এর অত্যাচার বেশ যন্ত্রণাদায়ক। পথে সাপের বাসা দেখলাম। ভাগ্যিস সাপ নেই। আমরাও আর বেশিক্ষণ থাকলাম না। ফিরে এলাম আবার ক্যাম্পে একই পথে। তাঁবু গুছিয়ে নৌকায় উঠলাম। সকালের নাশতা সেরে নিলাম। এবার লম্বা পথ। বনের বেশ কয়েকটা অংশে যাব। যেখানে হরিণ আর বানর দেখা যাবে খুব কাছে থেকে। মানুষের জীবনও দেখা যাবে। এখানকার প্রত্যেক মানুষের জীবন এই সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। কেউ কাঁকড়া ধরেন, কেউ মধু সংগ্রহ করেন আর কেউ লাকড়ি।

সুন্দরবনে লেখকের সেলফি
লেখকের সেলফি

আগের দিনের মতো আজকেও সূর্য বেশ যন্ত্রণা দিল। লম্বা সময় ধরে নৌকা দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখানে সূর্যাস্তটা অনেক দিন মনে থাকবে। আমাদের সবার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। আর ওই দিকে নিভতে যাওয়া সূর্য আমাদের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে যেন শেষ বিদায় দিচ্ছিল। সিদ্ধান্ত হলো, ফিরতি পথে রওনা দেব, অর্থাৎ রায়েন্দায়। এই ফিরতি পথে নৌকার ছাউনির ওপর শুয়ে শেষবারের মতো রাতের আকাশ দেখে নিলাম।  অনেক রাত আসবে আগামী জীবনে, এই রাত তো আর আসবে না।

রায়েন্দা থেকেই ভোরে বাস ছেড়ে যাবে। তাই খুব অল্প সময়। একটা মুহূর্তও মিস করতে চাই না।

শেষ সময়ে সবার মন খুব খারাপ ছিল। যে যার মতো আবার মিলিয়ে যাব নিজ নিজ ব্যস্ততায়, এসব ভেবেই হয়তো! তবে যখন ইচ্ছা হবে, মনের গহিনে অবশ্যই হানা দেবে এই দুই দিনের সব স্মৃতি।
এক ভয়ংকর সুন্দরতম বন হলো সুন্দরবন, দুই দিনের উপলব্ধি আমার। এক অনন্য উপলব্ধি!