চিনামাটির পাহাড়ে
পৃথিবীর যান্ত্রিক কোলাহলে আবদ্ধ আমাদের জনজীবন। এই কোলাহল পেরিয়ে সবাই চায় প্রকৃতিতে হারিয়ে যেতে। সেসব প্রকৃতিপ্রেমীর জন্য অন্যতম আদর্শ স্থান হলো বিজয়পুর চিনামাটির পাহাড়। এটি পাহাড়, নদী ও ঐতিহ্যবাহী স্থানে ভরপুর প্রকৃতির রাজ্য। অপরূপ লীলাভূমি সুসং দুর্গাপুরে অবস্থিত। সেখানে গেলে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্যে মুগ্ধ হবেন যে-কেউ।
চারদিকে সবুজ গাছগাছালি। আর তারই মধ্যে দেখতে পাবেন একটি সাদা মাটির পাহাড়। রয়েছে ১৬৩টি সাদা মাটির টিলা। তবে একে সাদা মাটি বলে আখ্যায়িত করলেও চিনামাটি পুরোপুরি সাদা নয়। বরং কোথাও দেখতে পাবেন লালচে, ধূসর, হালকা নীলাভ, গোলাপি, ঈষৎ বেগুনি, হলুদ কিংবা টিয়া রঙেরও। বিচিত্র রঙের মাটির সংমিশ্রণে পাহাড়গুলোর নিচে রয়েছে আবার স্বচ্ছ নীল পানির হ্রদ। আর বিস্তৃত মাঠজুড়ে সবুজের সমারোহ।
অনেকগুলো পাহাড় কেটে মাটি উত্তোলন করায় সৃষ্ট বড় বড় গর্ত বা ঢালুতে বৃষ্টির পানি জমে তৈরি হয়েছে এই স্বচ্ছ নীল পানির হ্রদ, যা নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের প্রধান কারণ। চিনামাটির পাহাড়ের কাছেই রয়েছে কমলার বাগান, বিজিবি ক্যাম্প ও নয়নাভিরাম আরও দর্শনীয় স্থান। বর্তমানে চিনামাটি উত্তোলন বন্ধ থাকায় এটি পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম একটি পর্যটন এলাকায়। মানুষ প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করে, প্রকৃতির রাজ্য সুসং দুর্গাপুরের অপরূপ লীলাভূমি চিনামাটির পাহাড় দেখে সময়কে উপভোগ করছে।
বিজয়পুর চিনামাটির পাহাড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম হিসেবে পরিচিত হলেও এটির রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অতুলনীয় গুরুত্ব। এটি টারশিয়ারি যুগের পাহাড়ের অন্তর্ভুক্ত। তখন থেকেই বেশ জনপ্রিয়। মূলত সাদা মাটি হলেও চিনামাটি বলার কারণ হলো, চীন দেশের মানুষেরা প্রথম ব্যবহার করেছিল এই মাটি। এটি একদম মিহি নরম ট্যালকম পাউডারের মতো, যা সিরামিকশিল্পের প্রধান কাঁচামাল। ১৯৫৭ সাল থেকে এই চিনামাটি উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। প্রথম কোহিনূর অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে চিনামাটি উত্তোলন শুরু করে ১৯৬০ সালে। এই বিজয়পুরে ১৯৬৪ থেকে ৬৫ সালের দিকে ১৩টি কূপ খনন করা হয়। ১৯৭৩ সালে বিসিআইসি সে কাজে অংশগ্রহণ করে। ধীরে ধীরে বেড়ে মোট ৯টি প্রতিষ্ঠান চিনামাটি উত্তোলনের কাজে জড়িত হয়।
বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের অন্যতম খনিজ অঞ্চল বিজয়পুর। পুরো এলাকা ঘিরে ছোট-বড় টিলা বা পাহাড় ও সমতল ভূমি মিলিয়ে দৈর্ঘ্যে ১৫ দশমিক ৫ কিলোমিটার ও প্রস্থে ৬০০ মিটার খনিজ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এ পর্যন্ত ৫ লাখ মেট্রিক টন মাটি উত্তোলন করা হয়েছে। মজুত আছে ১৩ দশমিক ৭৭ লাখ মেট্রিক টন। উল্লেখ্য, প্রাকৃতিক সম্পদটিকে জিআই স্বীকৃতি দিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছিল নেত্রকোনা জেলা প্রশাসনের কার্যালয়, যা ২০২১ সালে এসে স্বীকৃতি পায়।