ঘুরে বেড়িয়ে এলাম চন্দ্রনাথ থেকে
ঘড়ির কাঁটা বলছে রাত তখন সাড়ে ১০টা। সাইরেনের শব্দে বিদায় নিচ্ছি নগরী থেকে। ট্রেন রাতের অন্ধকার ভেদ করে দ্রুত চলে যাচ্ছে, আমাদের গন্তব্য সীতাকুণ্ড।
পরদিন সকাল আটটায় কুয়াশাভেজা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড স্টেশনে পা রাখলাম। এখানে সবার খাবার শেষ করে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে সরাসরি চলে গেলাম চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে। এখান থেকেই শুরু হলো আমাদের অভিযান।
এখন আমাদের সামনে নতুন অভিজ্ঞতার দরজা খোলা। পাহাড়ের সৌন্দর্য, সজীব প্রকৃতি আর অভিযান যেন আমাদের প্রতীক্ষায় ছিল।
প্রতিদিন সকালে ঘরে বসে আমি ভাবতাম, কবে যাব পাহাড়ে! সবুজে ঘেরা পাহাড়, বাঁকা পথ এবং মিষ্টি রোদ—এসব যেন আমার স্বপ্নের দেশ। মায়ের অনুমতি পাওয়ার পর আমি আর দেরি না করে সোজা চলে গেলাম সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে।
শুরুর দিকের রাস্তা অনেকটা সমতল। নয়নাভিরাম এই পাহাড়ি দৃশ্যের মধ্যে আমরা হেঁটে চলেছি। চন্দ্রনাথ পাহাড় সীতাকুণ্ড বাজার থেকে চার কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত আর এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই অপূর্ব।
চন্দ্রনাথ পাহাড় ট্র্যাকিংয়ের জন্য একটি আদর্শ জায়গা। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, নির্জনতার মাঝে সবুজ গাছপালা, পশুপাখির ডাক এবং শীতল বাতাসের সঙ্গে আপনি পাবেন এক পাহাড়সম মানসিক প্রশান্তি।
দুর্গম পাহাড়ি পথে হাঁটা আমার পছন্দ। যদিও ১ হাজার ১৫২ ফুট ওপরে ওঠা কঠিন ছিল, তবু আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল ওই চূড়ায় পৌঁছানো। রাস্তার দুই পাশে ছিল নানান দৃশ্য।
তবে সতর্ক থাকুন; আপনাকে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে। এক পাশে পাহাড়ের গা ঘেঁষে, আরেক পাশে খাদ রয়েছে। একবার পা ফসকালেই পড়ে যেতে হতে পারে ১ হাজার ১৫২ ফুট নিচে। তাই সাহস ও সতর্কতার সঙ্গে এগোতে হবে।
কিছু জায়গায় পথটা এতটাই সরু যে দুজনের একসঙ্গে ওঠানামা করা প্রায় অসম্ভব। মাঝেমধ্যে আপনি পাবেন প্রাচীনকালের তৈরি সিঁড়ি, যার ওপরে রয়েছে নামফলক—কী সালে এবং কে সেগুলো নির্মাণ করেছিলেন। চারদিকে নীরব-নিস্তব্ধ পরিবেশ, মাঝেমধ্যে শুনতে পাবেন চেনা-অচেনা পাখির ডাক। এখানে দেখতে পাবেন ঝরনাও, যা সংগীতের মতো অনুভূতি দেয়।
পাহাড়ের চূড়ায় আছে মন্দির। প্রতিবছর এই মন্দিরে শিবরাত্রি তথা শিবচতুর্দশী তিথিতে বিশেষ পূজা হয়। ভারত, নেপাল, ভুটান থেকেও আসেন অনেকেই।
পাহাড়ের একটু গভীরে গেলে চোখে পড়বে জুমখেত এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে চাষ করা ফুলের বাগান। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত চন্দ্রনাথ মন্দির। যাওয়ার পথে ছোট একটি ঝরনা দেখা যায়, যার কাছ থেকে পাহাড়ে ওঠার পথ দুটি দিকে চলে গেছে।
ডান পাশের পথটিতে পুরোটা জুড়ে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে আর বাঁ পাশের পথটি সম্পূর্ণ পাহাড়ি। এত কঠিন পথ পাড়ি দিতে হলেও, আশপাশের সবুজে ঘেরা অকৃত্রিম মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।
পাহাড়ে ওঠার ফাঁকে ফাঁকে আপনি প্রকৃতির সঙ্গে নিজের ছবি তুলতে পারেন। মাঝেমধ্যে থেমে বিশ্রাম নিতে পারবেন চায়ের দোকানে, যেখানে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। তবে চন্দ্রনাথ মন্দিরের ওপরে ওঠার পর আশপাশের দৃশ্য দেখলে সব কষ্ট ভুলে যাবেন। চারপাশের সবুজ যেন কোনো শিল্পীর নিপুণ হাতে রংতুলিতে আঁকা। এখান থেকে সীতাকুণ্ডের প্রায় পুরোটাই দেখা যাবে। দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে, এক ঐশ্বরিক অনুভূতি আপনাকে মুহূর্তেই জুড়িয়ে দেবে।
কীভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে বাসে অথবা ট্রেনে সীতাকুণ্ড যেতে পারেন। সীতাকুণ্ড কাঁচাবাজার ও সীতাকুণ্ড থানা–সংলগ্ন এলাকায় কিছু মানসম্মত আবাসিক হোটেল রয়েছে, চাইলে সেখানে থাকতে পারেন।