বিশ্ব যুব উৎসবে রাশিয়া ভ্রমণ অভিজ্ঞতা–৩
এবারে আবাসনের ব্যবস্থা হলো দিমিত্রভস্কি হাইওয়ের ঢাউস এস কে রয়্যাল হোটেলে। মস্কো রিজিওনে বাংলাদেশসহ ২৬টা দেশের ছেলেমেয়ে অংশ নিচ্ছে। ১২-১৫ মার্চ একটানা শুধু মস্কোর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ। প্রথমদিন ১২ তারিখে শুরুতেই আমাদের বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয় জাদোরঝনি প্রাইভেট মিউজিয়ামে, যেখানে সংরক্ষিত আছে সোভিয়েত আমলের নানা অস্ত্রসস্ত্র ও দুষ্প্রাপ্য সব গাড়ির সংগ্রহ। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্তালিনের ব্যবহার করা জি আই এস-১১৫ মডেলের সেই বিখ্যাত বুলেটপ্রুফ কার।
এরপর গেলাম নিউ জেরুজালেম মিউজিয়াম যেখানে নানা পুরাকীর্তি আর অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের আদ্যোপান্ত অতি যত্নে সংরক্ষিত রয়েছে। এদিনের সর্বশেষ গন্তব্য সিরোতার চিজ ফ্যাক্টরি, যেখানে বিশাল ফার্মহাউজ ও চিজ তৈরির নানা কৌশল দেখা তো হলোই, সঙ্গে লাঞ্চ সেরে নেয়া হলো ওদের বিখ্যাত লাঞ্চ মেনু দিয়ে। এ ফার্মে চাক্ষুষ দেখলাম বিভিন্ন গবাদি প্রাণী কীভাবে বরফ শীতল আবহাওয়াতেও অভিযোজন করে নিয়েছে। এখানে দুজন সোভিয়েত আমলের ভদ্রমহিলার দেখা পেয়ে মনের কৌতূহল ঝেড়ে নানান আলাপ শুরু করে দিলাম। জিগ্যেস করলাম স্তালিনকে নিয়ে তাঁদের মুল্যায়ন কী, পুতিনকে নিয়ে তাঁরা কী ভাবেন আর চলমান ইউক্রেন অভিযান নিয়েইবা তাঁদের মতামত কী।
১৩ তারিখ শুরুতেই যাওয়া হলো মস্কো মিলিটারি মিউজিয়াম ও ক্যাথিড্রালে, যেখানে ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের চালানো গণহত্যা ও রুশদের হাতে শোচনীয় পরাজয়ের ইতিহাস। সংরক্ষিত রয়েছে সেই আমলের নানা অস্ত্র ও নিদর্শন। এরপর ট্যাংক মিউজিয়ামে দেখা হলো দুই বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার হওয়া ও আটককৃত এবং রাশিয়ার আবিষ্কৃত কালজয়ী নানা ট্যাংক। ট্যাংকের গায়ে গুলির ক্ষত হাত দিতে মনে হলো ইতিহাস ছুঁয়ে দেখছি। এ দিনের সর্বশেষ আকর্ষণ ছিল সোভিয়েত পার্টিসান ভিলেজ ভ্রমণ, যেখানে সুযোগ হলো একজন সোভিয়েত সৈনিকের ইউনিফর্ম পরিধান ও সৈনিকের দুপুরের খাবার খেয়ে দেখার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার। পথিমধ্যে গাইডের থেকে শোনা হলো সোভিয়েত আমলে মিখাইল কালাশনিকভ কীভাবে ‘একে-৪৭’ রাইফেল আবিষ্কার করলেন আর কীভাবেইবা গোটা দুনিয়ায় এটা জনপ্রিয়তার শিখরে উঠে এল।
১৪ মার্চ এল সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত দিন। বলা হয়ে থাকে যে রাশিয়া ভ্রমণ করল অথচ রেড স্কয়ার ভ্রমণ করেনি, সে আসলে রাশিয়ার কিছুই ভ্রমণ করেনি। রুশ ইতিহাস মিউজিয়াম আর রেড স্কয়ার ভ্রমণে আমার যেন রাশিয়া ভ্রমণের ষোলকলা পূর্ণ হলো। লাল-সাদা কারুকার্যময় সুরম্য অট্টালিকা, যার পরতে পরতে ইতিহাস কথা বলে। আহ! সোভিয়েত ইউনিয়ন, লেনিন…কার্ল মার্ক্সের স্বপ্ন! লাউডস্পিকারে লেনিনের ভাষণ চলছে। মনে হলো যেন ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।’ পাশেই রুশ প্রেসিডেন্টের বাসভবন ক্রেমলিন। ইটারনাল ফ্লেম মনুমেন্ট এ স্ট্যাচুর মতো পালা করে তিনজন সৈনিক সারাক্ষণ দাড়িয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ দেওয়া নাম না জানা সৈনিকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন, যা দেখতে ভিড় করেছেন শতশত পর্যটক। তবে এ দিন কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই ফিরতে হলো। পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় লেনিনের সংরক্ষিত মরদেহ দেখার সুযোগ মিলল না।
শেষদিন ১৫ মার্চ দেখা হল বিখ্যাত অল রাশিয়া এক্সিবিশন সেন্টার যেখানে মূলত মানবিতিহাসে রাশিয়ার অবদান আর বর্তমান রাশিয়া বিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ নানা খাতে কোথায় কী করছে, সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এখানে বিশেষভাবে দেখা হলো মহাকাশে সফলভাবে অবতরণকারী প্রথম ব্যক্তি ইয়ুরি গ্যাগারিনের স্পেসস্যুট ও ভোস্টক-১ রকেটের রেপ্লিকা। ঝাঁকে ঝাঁকে দেখলাম রুশদের নতুন প্রজন্ম অর্থাৎ স্কুলের বাচ্চারা এসব প্রবল কৌতূহলের সঙ্গে দেখছে। কেউবা শিখছে রোবট শিক্ষকের থেকে।
মাঝে একদিন তো হারিয়েই গেলাম মস্কোর এক আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো স্টেশনে। উল্লেখ্য, এই মেট্রোর ‘পার্ক পোবেডি’ স্টেশনটি মাটির ৮৪ মিটার গভীরে অবস্থিত, যা পৃথিবীর তৃতীয় গভীরতম স্টেশন। পুরো শহর যেন এক পাতালপুরী। পরে জানতে পারলাম লাইনগুলো কেন এত গভীরে করা হয়েছে। যেন যুদ্ধ লাগলে এগুলোকে বাঙ্কার হিসাবে ব্যবহার করা যায়। সোভিয়েত স্টাইলের অসাধারণ কারুকার্যের নান্দনিকতায় এই সাবওয়ের ৪৪টা স্টেশন কালচারাল হেরিটেজ সাইট হিসেবে তালিকাভুক্ত! কী নেই এখানে! শপিং মল থেকে শুরু করে সব কিছুই। হারিয়ে গিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা এক অবস্থায় আমার ফেস্টিভ্যাল আইডি আর হোটেল কার্ড দেখিয়ে সাহায্য চাইতেই জনৈক রুশ ভদ্রলোক তটস্থ হয়ে পড়লেন আমাকে সাহায্য করতে। বেশির ভাগ রাশিয়ানের মতো তিনিও ইংরেজি জানেন না তো ফোনের ট্রান্সেলেটর ব্যবহার করে দ্বিপাক্ষিক কথাবার্তা চলল। এদিকে আমার ফোনের চার্জ প্রায় শেষ জেনে তিনি তৎপর হলেন ফোন চার্জ এরিয়া খুঁজে দিতে। ততক্ষণে প্রায় আধাঘণ্টা শেষ। তাঁর দেরি হয়ে যাচ্ছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন সমস্যা নেই। অতঃপর আমাকে সঠিক ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েই তারপর তিনি বিদায় নিলেন। সম্পূর্ণ অচেনা একজন ব্যক্তির জন্য নিঃস্বার্থে এতটা উদারতা! এই ঘটনা আমার আজীবনের মুগ্ধতা হয়ে থাকবে।
আর এরই মধ্য দিয়ে শেষ হল আমার প্রায় ২০ দিনের রুশ ভ্রমণ। সাম্রাজ্য বলছি, কারণ, দুই মহাদেশ বিস্তৃত এই দেশ আজও এত বিশাল আর এত বিচিত্র যে ২০ দিনে এর খুব সামান্যই বোঝা বা জানা সম্ভব। অসাধারণ সব খাবারের আতিথেয়তা (যদিও বাঙালি হিসেবে রান্নায় ঝালের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি কিন্তু কিচ্ছু করার নেই এটাই দুনিয়ার ওদিককার রন্ধনপ্রণালি ও খাদ্যাভ্যাস), থাকার জন্য আগাগোড়া সিঙ্গেল অকুপেন্সি রুম, রোজার মধ্যে মুসলিমদের জন্য ইফতার ও সাহ্রির ব্যবস্থা রাখা (এমনকি বিদায় নেয়ার রাতে সাহ্রির জন্য প্রত্যেকের গাড়িতে পার্সেল দিয়ে দেওয়ার মতো সৌজন্যতা শুধু মুগ্ধতাই সৃষ্টি করেছে) আর সঙ্গে ‘মাতৃওস্কা’সহ নানা গিফট ও সুভ্যেনির আইটেম তো রইলই।
আমার জন্য এ ভ্রমণ জীবন সম্পর্কে বহু নতুন চিন্তাভাবনার খোরাক হয়ে এসেছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কত মুখের সঙ্গে পরিচয় আর কত বিচিত্র তাঁদের জীবনের গল্প! শেষ
*লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
*নাগরিক সংবাদ–এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]