জোড়াসাঁকোয় রবি দর্শন
শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে কলকাতার বিখ্যাত হলুদ ট্যাক্সিতে চড়ে পুরোনো কলকাতার রাস্তা ধরে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছি। ছোটবেলা থেকে সাহিত্য, বেতার ও বাংলা চলচ্চিত্রের হাত ধরে কলকাতার সঙ্গে পরিচয়। আর এ পরিচয়ের পেছনে যে মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই কলকাতায় নেমেই আমার গন্তব্য ছিল সেই বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ি। পুরোনো কলকাতার কিছুটা জীর্ণ ছবি আমার কল্পনার কলকাতার সঙ্গে কেমন যেন এক বিরোধ বাধিয়ে দিতে চাইল। রাস্তার পাশে এখনো অনেক পুরোনো বাড়ির দেখা মেলে, কলকাতার রাজপথে ছুটে চলা পাবলিক বাসগুলো কেমন যেন বিবর্ণ মনে হলো। কল্পনা আর বাস্তবের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে খেতে আমরা পৌঁছে গেলাম জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ফটকের সামনে। ট্যাক্সিচালক আমাদের মূল রাস্তার পাশে ফটকের সামনে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখান থেকে কিছুটা হেঁটে গেলেই আপনারা ঠাকুরবাড়ি পৌঁছে যাবেন।’
আমরা সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি। এ রাস্তার দুপাশের জীর্ণতা যেন জানিয়ে দিতে চাইল, সময় সবার সমান নাহি যায়। অবশেষে আমি ও আমার সহকর্মী লাবণ্য সরকার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সামনে এসে হাজির হলাম। টিকিট কেটে ঠাকুরবাড়ির ভেতরে ঢুকে সিঁড়ির পাশে ব্যাগ রাখছি, সেটি দেখে এক ভদ্রমহিলা বললেন, ‘দাদা, আপনারা নিশ্চয়ই বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?’ প্রত্যুত্তরে আমি বললাম, ‘প্রাণের টানে কলকাতা শহরে নেমেই এখানে চলে এসেছি। রবি ঠাকুরের কর্মভূমি শিলাইদহের পাশেই থাকি, আজ জন্মভূমি দেখতে এলাম।’ ভদ্রমহিলা স্মিত হাসি হেসে, বললেন, ‘রবি ঠাকুর আসলেই আমাদের প্রাণের মানুষ।’
সিঁড়ির পাশে ব্যাগ রেখে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম বিখ্যাত বাড়িটির দোতলায় উঠতেই কেমন যেন নস্টালজিয়া এসে ভর করল। এই সেই বিখ্যাত বাড়ি, যে বাড়ি থেকে কত দিকপাল মানুষ বেরিয়ে এসেছেন। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আরও নামকরা কত মানুষের পদচারণে মুখরিত ছিল এই বাড়ি। বাড়িটির সঙ্গে মিশে আছে আলো-আঁধারের ছায়া। ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, আধুনিকতা যেমন মিশে আছে, তেমনই মিশে আছে জমিদারির ইতিহাস। বলা হয় বাংলার রেনেসাঁর অন্যতম পীঠস্থান ছিল এই লাল বাড়ি।
সিঁড়ির কোনায় ব্যাগ রেখে দোতলায় উঠতেই বাঁ দিকে কবিপত্নীর রান্নাঘরের দেখা মেলে। রান্নাঘরটি এখনো সযত্নে লালিত আছে। চিত্রা দেবের ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’-এ পড়েছিলাম, এই বাড়ির রান্নাঘরে নতুন নতুন খাবারের পদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলত। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আমরা কবির শোবার ঘরে যাই। জোড়াসাঁকোয় অবস্থানকালে কবি এ ঘরেই থাকতেন এবং এ ঘরেই কবি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ঘরে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি, এদিকে স্পিকারে কোমল সুরে বেজে চলেছে—
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
সুরের বাঁধনে,
তুমি জানো না, আমি তোমারে পেয়েছি
অজানা সাধনে,
আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ
সুরের বাঁধনে।
এ যেন এক মিলনের বারতা। প্রাণের মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠা এক আত্মিক মেলবন্ধন। আসলে জোড়াসাঁকোতে এসে রবি ঠাকুরকে যতটা প্রত্যক্ষ করা যায়, তার চেয়ে বেশি উপলব্ধি করা যায়। দক্ষিণের বারান্দায় পদার্পণ করতেই কবির ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। এই বারান্দার রেলিংগুলো ছিল কবির ছাত্র, আর কবি ছিলেন মাস্টার। সেই রেলিংগুলো এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু কবি নেই। এটাই মানবজীবনের এক অমোঘ সত্য, ব্যক্তির শারীরিক অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু স্মৃতিগুলো রয়ে যায়। আমরা আসলে মুহূর্তের মাঝেই বাঁচি, এই মুহূর্তগুলোই স্মৃতির কোলাজ তৈরি করে।
রবি ঠাকুরের বিশ্বভ্রমণের স্মৃতিগুলো চমৎকারভাবে সংরক্ষণ করে রাখা আছে। ভ্রমণপিপাসু মানুষ হিসেবে জোড়াসাঁকোতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি কিছুটা ঈর্ষান্বিত ছিলাম। সেই যুগে তিনি ৩০টির মতো দেশ ভ্রমণ করেছেন। এশিয়ার চীন, জাপান থেকে শুরু করে ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকার দেশেও তিনি অবলীলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। চায়না গ্যালারি, জাপান গ্যালারি, ইউএস গ্যালারি, হাঙ্গেরি গ্যালারির ছবিগুলো দেখে অনুমান করতে পারছিলাম, এই বাংলার একজন মানুষ হিসেবে তিনি নিজেকে কোন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এই গ্যালারিগুলোর পাশাপাশি চিত্রকলার গ্যালারিগুলোও কিছু সময়ের জন্য ভাবনার অলিন্দে অবগাহন করার সুযোগ করে দেয়।
খুব ইচ্ছা ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দোতলার ছাদে যাওয়ার। রবি ঠাকুর ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার মধ্য দিয়ে এই দোতলার নন্দনকাননের সঙ্গে পরিচয়। কাদম্বরী দেবী এই ছাদে নন্দনকানন গড়ে তুলেছিলেন। তবে দোতলার ছাদের সিঁড়ির দরজা তালাবদ্ধ থাকায় সে সুযোগ মেলেনি।
ঠাকুরবাড়ি পরিদর্শনের সময় প্রচুর বিদেশির দেখা মিলল। এক বাঙালি ভদ্রলোক ফ্রান্সে অভিবাসী হয়েছেন। তিনি তাঁর দুই মেয়েকে বাঙালির শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে ঠাকুরবাড়ি নিয়ে এসেছেন। মেয়ে দুটো ভালোই বাংলা বলতে পারে। ওদের কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা রবি ঠাকুরকে কীভাবে চেনো? ওরা বলল, ‘আমাদের বাবা রবি ঠাকুরকে চিনিয়েছেন, আর আমরা বাসায় রবীন্দ্রসংগীত শুনি। এই গানের মধ্য দিয়েই কবির সঙ্গে আমাদের বড় পরিচয়।’ আসলেই রবি ঠাকুর তাঁর গানের মধ্য দিয়েই বাঙালির প্রাণের সঙ্গে এক অন্য রকম আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। আর তাই আমরা যখন দোতলা প্রদক্ষিণ শেষে নিচে নেমে আসছি, তখন আমাদের কানে ভেসে আসছে সেই চিরচেনা সুর—
যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা-কেনা, মিটিয়ে দেব লেনা-দেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে—
তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে।
এই গানের সুরে সুর মিলিয়ে কে যেন ভেতর থেকে আনমনে বলে উঠল, কবি ছিলেন, কবি আছেন, কবি থাকবেন বাঙালির পরম্পরা হয়ে।
* লেখক: সুব্রত মল্লিক, সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, কুষ্টিয়া।