আইল্যান্ড পিক জয়ের পথে
‘তেনজি, দিজ ক্লাইম্ব ইন ইনসেইনলি ডিফিকাল্ট!
ক্লাইম্ব আপ, দিজ ইজ হোয়াই ইউ আর হিয়ার’
ছোট্ট এ কথা কেমন যেন জাদুর মতো কাজ করল। মুহূর্তেই শক্তি ভর করল শরীরে। সামিট পয়েন্টে যেতে তখনো ১৫০ মিটারের মতো ৯০ ডিগ্রি খাড়া দেয়াল। এদিকে সকালের প্রথম আলো দূর পাহাড়ের পেছন থেকে রাজকীয় আভা ছড়িয়ে দিয়েছে গোটা ইমজা উপত্যকায়।
গাইড তেনজি শেরপা আমাকে পথ দেখিয়ে ধীরে ধীরে নিয়ে যাচ্ছেন চূড়ার দিকে। এত ভয়াবহ রকমের শারীরিক ও মানসিক চাপ আমি কখনো নিইনি, যেটা আইল্যান্ড পিক (৬১৬৫ মিটার) সামিট করতে গিয়ে নিয়ে ফেলেছি এতক্ষণে।
সামিট থেকে যখন চারদিকে তাকালাম, পুরো পৃথিবী যেন চোখের পলকে বদলে গেল। ৮ হাজার ৫১৬ মিটারের লোৎসে পর্বতের (পৃথিবীর চতুর্থ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ) সাউথ ফেস আমার ঠিক বুকের সামনে দিয়ে তার হিমশীতল, ভয়ানক আর রাজকীয় অবস্থান জানান দিচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে ইমজা গ্লেসিয়ার লেক, ৮ হাজার ৪৮১ মিটারের মাকালু (পৃথিবী পঞ্চম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ), ৬ হাজার ৮১২ মিটারের আমা দাবলামসহ জানা-অজানা অনিন্দ্যসুন্দর সব পর্বত।
পৃথিবীর উচ্চতম হিমালয় পর্বতমালা যেন ধরা দিয়েছে এক নতুন রূপে, যে রূপ কোনো দিন দেখা হয়নি আগে। শ্বেতশুভ্র বরফের উঁচু-নিচু উঠান আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিল। এ এক অনন্য-অসাধারণ অভিজ্ঞতা। নিজেকে জানা, নিজের সীমাবদ্ধতা বোঝা, আবার একই সঙ্গে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অনুভূতি।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নিয়মিত ভ্রমণ করছি। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে একা বেরিয়ে পড়ে নানা শহর, গ্রাম, বন্দর ঘুরে দেখাই ছিল মূলত আমার পছন্দের। এমনকি পাঁচ বছর আগেও কোনো খ্যাপাটে স্বপ্নেও ভাবিনি, একদিন আমিও প্রকৃতির সবচেয়ে দুর্গম, কঠিন আর বিপজ্জনক পথে নিজেকে আবিষ্কার করব। যদিও আমি নিয়মিত পর্বতারোহণের খোঁজ খবর রাখতাম। মোহিত হতাম তাঁদের গল্প শুনে।
২০১৭ সালে বেশ লম্বা সময় ধরে একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহরে। শ্রীনগর থেকে লাদাখ যাওয়ার পথে এক এক করে চোখের সামনে ধরা দিতে লাগল অসাধারণ সব শুভ্র পর্বত। দেখে মনে হচ্ছিল, ওরা হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায়। কিন্তু ডাকলেই তো আর হবে না, এ জন্য চাই লম্বা প্রস্তুতি। ২০২৩ সালে এসে আমার সেই স্বপ্ন বাস্তবে ধরা দিয়েছে।
এ বছরের ১৪ এপ্রিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে উড়ে গেলাম নেপালের কাঠমান্ডুতে। সেখান থেকে রামেচাপ বিমানবন্দর থেকে খেলনার মতো সাইজের বিমানে করে লুকলা, পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক বিমানবন্দর। বিমান থেকে বের হতেই গোটা লুকলা ভ্যালি আমাকে রংবেরঙের রডডেন্ড্রন ফুল আর রাজকীয় পর্বতসমেত অভিবাদন জানাল। এ যেন এক কল্পনার নগরী, তিব্বতি ভাষায় যাকে বলে ‘সাংগ্রি লা’।
লুকলা থেকে অনুমতি নিয়ে ফুল-মেঘ-পাহাড়ে ঢাকা স্বপ্নের পাথুরে পথ ধরে অবাক হতে হতে এগিয়ে যেতে থাকলাম সামনের দিকে। পাহাড়ি পথজুড়ে রডডেন্ড্রন ফুল, সাসপেনশন ব্রিজ, দূর পাহাড়ে স্বপ্নের মতো ছোট ছোট গ্রাম, অসংখ্য সবুজ-সাদা পর্বত আর পাখির মেলা।
আইল্যান্ড পিকের বেইজ ক্যাম্পে যেতে যেতে পাড়ি দিতে হয়েছে পাকডিং, নামচে বাজার, টেংবোচে, ডিংবোচে, চুখুংসহ কয়েকটি সুন্দর গ্রাম। রাস্তার প্রতিটি বাঁকে সঙ্গ দিয়েছে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর পর্বত আমা দাবলাম। দেখা মিলেছে মাউন্ট এভারেস্ট, লোৎসে, নুপৎসের মতো রাজকীয় চূড়া। এর মধ্যে দুটি দিন আলাদা করে এক্লিমাটাইজেশন (অভিযোজন) হাইক করে ফেললাম নামচে বাজারের কাছে এভারেস্ট ভিউ হোটেল ও খুমজুং গ্রামে। এক ফাঁকে ঘুরে দেখলাম খুমজুং মনেস্ট্রি, যেখানে সংরক্ষিত আছে তুষারমানবের খুলি।
ঠিক যেদিন চুখুং (বেইজ ক্যাম্পের আগে শেষ গ্রাম) পৌঁছালাম, বেশ তুষারপাত হচ্ছিল। বিকেলের দিকে তা রূপ নিল রীতিমতো ঝড়ে। কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। কাল সামিট পুশ। অথচ আজ আবহাওয়া এমন। গাইডের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটালাম। রাতের খাবার খেয়েই ঘুম। বেশ গভীর এক ঘুম দিয়ে খুব ভোরে উঠতেই দেখি ঝকঝকে সোনালি আলো। মাথা থেকে গতকালের দুশ্চিন্তা নেমে গেল। ফুরফুরে মেজাজে নাশতা করে গাইডসহ চললাম আইল্যান্ড পিক বেইজ ক্যাম্পে।
এর পরের পুরো অভিজ্ঞতা আমার জন্য আনকোরা। জীবনে প্রথম কিচেন টেন্টে খাবার খাওয়া, ক্লাইম্বারদের সঙ্গে গল্প, জীবনের প্রথম ক্লাইম্বিং বুট-ক্র্যাম্পন পরা, বরফের দেয়ালে সত্যিকারের ক্লাইম্বিং গিয়ার ব্যবহার করে ওঠানামা, পাঁচ হাজার মিটারেরও বেশি উচ্চতায় রাত কাটানো, আরও কত–কী।
ঝকঝকে আকাশ মাথার ওপরে নিয়ে ২৩ এপ্রিল দিবাগত রাত দেড়টায় গাইড তেনজি শেরপা আমাকে নিয়ে চললেন এক নতুন গন্তব্যের দিকে। নিকষ কালো অন্ধকারে, শূন্যেরও প্রায় ১৫ ডিগ্রির কম তাপমাত্রায় হেডলাইটের আলোয় আমাকে উঠতে হবে কমপক্ষে ১ হাজার ১০০ মিটার উচ্চতায়। খুব সাবধানে পা ফেলে ধীরে ধীরে পথ চললাম। ক্র্যাম্পন পয়েন্টে যখন পৌঁছালাম, তখন দূরে আলোর আভা বোঝা যাচ্ছে।
এবার পাড়ি দিতে হবে সবচেয়ে কঠিন পথ। সমুদ্রপৃষ্ঠের তুলনায় মাত্র ৪৭ শতাংশ অক্সিজেনপূর্ণ বাতাস, তুষারঢাকা উপত্যকা, বরফ আর পাথরের দেয়াল, বরফের বড় ফাটল পেরিয়ে এক এক করে পাড়ি দিতে থাকলাম কঠিন পথ। একটা ছোট্ট ভুলে হতে পারে বড় দুর্ঘটনা। কাজেই সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। এক এক করে ধীরপায়ে উঠে গেলাম শীর্ষবিন্দুতে। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৮টা বেজে ৫ মিনিট। ঝটপট কিছু ছবি তুলে এবার নেমে আসার পালা। পর্বতারোহণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ এটা।
নামতে গিয়ে টের পেলাম, শরীর বেশ দুর্বল। কাজেই খুব সন্তর্পণে নেমে আসতে হলো বেইজ ক্যাম্পে। নেমে এলাম চুখুংয়ে। সেখান থেকে ডিংবোচে। আমার ক্লাইম্বিং এজেন্ট হেমন্তের সঙ্গে দেখা করে ধন্যবাদ দিলাম তাঁর পেশাদারি আর সুন্দর সেবা প্রদানের জন্য। হেমন্তের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম টেংবোচে। পরের দিন নামচে বাজার। তারও পরদিন লুকলা। এরপর লুকলা থেকে আবার সেই খেলনাসদৃশ বিমানে চেপে ফিরে এলাম কাঠমান্ডু।
এ অভিযান আমার জীবনের চিন্তাধারায় ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। প্রকৃতিকে এবং নিজেকে চিনতে শিখিয়েছে নতুনভাবে। নিজের ক্ষুদ্রতা ও সক্ষমতা উপলব্ধি করার সুযোগ দিয়েছে বারবার। এ এক অনন্য উপলব্ধি। নতুন কিছু করার লক্ষ্যে এগোনোর মনোবল। নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবল আগ্রহ।
পর্বতারোহণ রাতারাতি ঘটে যাওয়া ব্যাপার নয়। এর জন্য চাই বছরের পর বছর ধরে নানা মানসিক ও কায়িক পরিশ্রম, প্রস্তুতি, ত্যাগ, পড়াশোনা এবং বেশ বড় অঙ্কের একটা অর্থ। সেই প্রস্তুতির গল্প নাহয় তোলা থাক অন্য কোনো এক দিনের জন্য।
আদনান খাইরুল্লাহ: শিক্ষা প্রশাসক, সংস্কৃতিকর্মী ও পর্বতারোহী