সাজেক ভ্যালি: পাহাড়, মেঘ আর স্মৃতির গল্প

স্কুলবন্ধুদের সঙ্গে এখন আর আগের মতো আড্ডা জোটে না। যাদের সঙ্গে একসময় প্রতিদিনের হাসি-ঠাট্টা ভাগাভাগি করতাম, তারা এখন দেখা দেয় কেবল কোনো বিয়ের দাওয়াতে। এমনই এক বিয়েবাড়ির আড্ডায় হঠাৎই মাথায় এল পরিকল্পনা চল, একদিন রাঙামাটিতে ডে ট্যুর দিই। সেই হুটহাট সিদ্ধান্তই আমাদের নতুন ভ্রমণগল্পের সূচনা।

রাঙামাটি বাদ দিয়ে কয়েকজনের প্রস্তাবে গন্তব্য বদলে গেল সাজেকে। তারপর শুরু হলো কে যাবে, কে পারবে না—এই অস্থিরতা। তবু অবশেষে সিদ্ধান্ত পাকাপাকি হলো, ১১ জনের দল তৈরি হলো। যাত্রার দিন ভোরে হাড়কাঁপানো হাওয়ায় আমরা কয়েকজন অক্সিজেন মোড়ে জড়ো হলাম। হাতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, চোখ–মুখে ভ্রমণের উত্তেজনা। আরেকটু পর বাকি তিনজন উঠবে সরকারহাট থেকে। ঠিক সাড়ে ছয়টায় শান্তি পরিবহনের বাস ছেড়ে দিল, আমরা সবাই মিলে রওনা হলাম খাগড়াছড়ির পথে।

বাস চলতে থাকে। কুয়াশামোড়া জানালার ফাঁক দিয়ে ভোরের সূর্যের মোলায়েম আলো গায়ে এসে লাগে। পাহাড়ি বাতাসে ভেসে আসা ঠান্ডা পরশ আমাদের উচ্ছ্বাস আরও বাড়িয়ে দেয়। মুহূর্তেই মনে হলো—সত্যিই তো, কত দিন পর এমন একসঙ্গে ভ্রমণে যাচ্ছি!

খাগড়াছড়িতে নেমেই তাড়াহুড়া। সকালবেলার নাশতা করার ফুরসত নেই। কারণ, সাজেক যেতে হলে সেনাবাহিনীর স্লট ধরতেই হবে, না হলে পুরো প্ল্যান ভেস্তে যাবে। তাই আর দেরি না করে আমরা তাড়াহুড়া করে ঠিক করলাম চান্দের গাড়ি। মুহূর্তেই শুরু হলো পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে আমাদের যাত্রা।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

দুই পাশে সবুজে ঢাকা পাহাড়, কোথাও ভাঙাচোরা রাস্তা। ঝাঁকুনি খেতে খেতে, খুনসুটি করতে করতে আমরা এগোতে থাকলাম। অবশেষে পৌঁছালাম বাঘাইহাট আর্মি ক্যাম্পে। ক্যাম্পে পৌঁছেই দেখি সারি সারি গাড়ির লাইন। এটা দেখে নিজেদের মধ্যে একটু প্রশান্তি নেমে এল। একটু চা-পানি খেয়ে নেওয়ার সময় পাওয়া গেল। একদিকে চা-শিঙাড়া দিয়ে সকালের নাশতার পর্ব চলছে, অন্যদিকে ড্রাইভার তাঁর যাবতীয় ফরমালিটি সারতে ব্যস্ত। সবকিছু শেষে, কিছু ছবি তুলে আমরা চান্দের গাড়িতে উঠে যাই।

এবার তবে যাওয়া যাক। সাজেক—আমাদের মূল গন্তব্যে।

চান্দের গাড়ি হ্যাঁচকা টানে উঠতে থাকে আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পথে। দুই পাশে শুধু পাহাড় আর পাহাড়, দূরে মেঘে ঢাকা সবুজের রাজত্ব। মাঝেমধ্যে রাস্তা এমন খাড়া উঠে যায়, মনে হয় গাড়ি এবার বুঝি পিছলেই যাবে। কিন্তু সেই ভয়কে হার মানিয়ে, ঝাঁকুনি আর উল্লাসে ভরপুর যাত্রার শেষে অবশেষে আমরা পৌঁছে গেলাম সাজেক ভ্যালির দরজায়।

কোন রিসোর্টে উঠব, কোথায় খাব—সবকিছু ঠিক করে রেখেছিলাম আমি আর ফারুক। তাই আর কোনো ঝামেলা ছাড়াই সরাসরি রিসোর্টে চলে গেলাম। কিন্তু সেখানেই শুরু হলো নতুন কাণ্ড—রুম নিয়ে কাড়াকাড়ি। যেহেতু ১১ জনের দলকে দুই রুমে ভাগ হয়ে থাকতে হবে, তাই কে কোন রুমে যাবে, তা নিয়ে ছোটখাটো দ্বন্দ্ব। কারও মতে এই রুমের ভিউ ভালো, কারও মতে ওই রুমের ডেকোরেশন দারুণ। শেষ পর্যন্ত অনেক হাসাহাসি আর ঠাট্টার মধ্যে পাঁচজন এক রুমে, ছয়জন অন্য রুমে ভাগ হয়ে গেলাম।

এরপর শুরু হলো ফ্রেশ হওয়ার পালা। ভ্রমণের ধকল, পাহাড়ি ধুলাবালু আর ঠান্ডা বাতাসে গোসল শেষে একরকম নতুন প্রাণ ফিরে পেলাম সবাই। তবে শরীরের চেয়ে পেটের দাবি তখন বেশি জোরালো হয়ে উঠেছিল। ক্ষুধার টান সামলাতে আর দেরি না করে আমরা সবাই নির্ধারিত রেস্তোরাঁর দিকে রওনা দিলাম।

সেখানে টেবিলে সাজানো ছিল ভর্তা, পাহাড়ি মুরগি আর গরম ভাত। চারপাশে মেঘের আস্তর, ওপরে ঠান্ডা হাওয়া—এ রকম পরিবেশে সেই খাবার হয়ে উঠল সত্যিই অমৃতময়।

খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই আমাদের পরবর্তী গন্তব্য হলো সাজেকের সবচেয়ে বিখ্যাত কংলাক পাহাড়। হাঁটতে হাঁটতে যাত্রা শুরু হলো। পথে চোখে পড়ল সাজেকের একমাত্র মসজিদ, দুপাশে বিস্তৃত পাহাড়ের সারি, আর সাজেকের বুকজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাহারি রিসোর্টগুলোর দৃশ্য।

হাঁটতে হাঁটতে সাজেককে পেছনে ফেলে আমরা ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম কংলাকের চূড়ায়। চারপাশে দিগন্তজোড়া পাহাড়, নিচে মেঘের ভেলা, আর সামনে সূর্যের ডুবো ডুবো আলো। আমরা বসে পড়লাম পাহাড়ের চূড়ায় এক কাপ হাতে চায়ের টেবিলে। হাতে ধোঁয়া ওঠা কাপ, আর চোখের সামনে সূর্যাস্তের নরম আভা মুহূর্তগুলো যেন কবিতার মতো।

কিছুক্ষণ থেকে আমরা আবার নেমে এলাম নিচে। এবার লক্ষ্য লুসাই গ্রাম। তাড়াহুড়া করে চান্দের গাড়িতে উঠে বসি। তারপর সরাসরি লুসাই গ্রামের সামনে পৌঁছে টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম। গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল লুসাইদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা মানুষজন, দোকানপাট আর সরল জীবনযাপন। গ্রামজুড়ে আমরা অবাধে ঘুরে বেড়ালাম, ছবি তুললাম, হাসি-আড্ডায় মেতে উঠলাম। বিকেলের রং ঢেকে এল সন্ধ্যার আবহে।

সন্ধ্যা হতেই সাজেকে জেগে ওঠে ঝাল নাশতার পসরা। ব্যাম্বু চায়ের কাপে হাত দিয়ে গরম চুমুক খেতে খেতে, আর ঝাল নাশতার স্বাদ নিতে নিতে আমরা যেন অন্য এক আবহে মিলেমিশে যাই।

নাশতা শেষ করে রুমে ফিরে ফ্রেশ হওয়ার পরপরই শুরু হলো আড্ডা। গান, নাচ আর বন্ধুত্বের উল্লাসে সবাই মেতে উঠল। রাতের খাবারের জন্য বের হতেই চোখে পড়ল একটি রেস্তোরাঁ, যেখানে রাস্তায় বসে অনেকেই গান করছে। পরিচিত সুর, পরিচিত গান সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে গেয়ে উঠলাম।

খাবার শেষে রাতের সাজেকের আলো, পাহাড়ের আবহ আর হালকা কুয়াশাঘেরা রাস্তায় আমরা ঘুরে বেড়ালাম। এখানে-সেখানে চক্কর, আরও কয়েক কাপ চা আর আড্ডা মুহূর্তগুলো যেন থেমে যায় না।

পরদিন ভোরবেলা আমরা ঘুম ভেঙে উঠলাম। রিসোর্টের ছাদে উঠে খোলা আকাশ, পাহাড়ের নরম আলো আর মৃদু কুয়াশা ছবি আর ভিডিওতে মুহূর্তগুলো ধরে রাখলাম। সঙ্গে ব্যাগ গোছানো। কারণ, সকালের স্লটেই আমাদের খাগড়াছড়ির পথে ফিরতে হবে।

খিচুড়ি দিয়ে সকালের নাশতা শেষ করে আবারও হেঁটে গেলাম সাজেক জিরো পয়েন্টের দিকে। শেষবারের জন্য পাহাড়, হাওয়া আর সেই নরম আলোয় ভরা দৃশ্যটি চোখে রাখলাম। এরপর ফিরে যাওয়ার সময়। ব্যাগ হাতে রিসোর্ট ছেড়ে চান্দের গাড়িতে উঠলাম। আবার সেই পাহাড়ি পথ, উঁচু-নিচু রাস্তা, দুই পাশে পাহাড়—সবই যেন বিদায়ের গান গাইছিল।

খাগড়াছড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে। দুপুরের খাবার শেষে ফেরার বাস নিয়ে সবাই চিন্তিত কোন বাসে যাব, টিকিট পাব কি না। শেষমেশ লোকাল বাসের টিকিট কেটে আমরা আলুটিলা পাহাড় ও গুহার দিকে যায়। পুরো বিকেলটা আড্ডায় কাটিয়ে দেওয়ার পর বাস কাউন্টারে ফিরি।

বাস ছাড়তেই একটু পরে সবার চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এল। ঘুম ভেঙে যখন চোখ খুললাম, তখন বুঝলাম আমরা প্রায় বাড়ির কাছে। কেউ নামবে সরকারহাট, কেউ তো শহরে।

বিদায়ের পালা।

সাজেকের সবুজগর্ভ আর মেঘের নরম চাদরে ঢাকা পথকে আমরা বিদায় জানালাম। বন্ধুদের হাসি, পাহাড়ের গন্ধ আর স্মৃতির সোনালি আলো হৃদয়ের অলিন্দে চিরস্থায়ী হয়ে থাকল।