মাতামুহুরী নদী ঘেঁষে মিরিঞ্জা ভ্যালির পাহাড়ে রাতদিন

১ হাজার ৮০০ ফুট উঁচু বান্দরবানের ‘মিরিঞ্জা ভ্যালি’র জুমঘরে রাত কাটিয়ে সকালে পাহাড় থেকে মেঘ জয় করার চমৎকার অভিজ্ঞতা হলো। ৯ জনের ট্যুর টিম নিয়ে রাত ১২টার দিকে কুমিল্লা থেকে রওনা হলাম। পুরো রাত গাড়িতে গান, গল্প শুনতে শুনতে সময় কেটে গেল। শেষ রাতের তন্দ্রায় অনেকেই ঘুমের ঘোরে। হুট করে যখন ঘুম ভাঙাল, তখন পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চলছে। দুই পাশে বৃক্ষে ঘেরা উঁচু-নিচু পাহাড় আবছায়া সূর্যের কিরণে মনোমুগ্ধকর মেঘের হাতছানিতে এক অপূর্ব সৌন্দর্য তৈরি করেছে।

গাড়ি চলতে চলতে ইয়াংছা আর্মি ক্যাম্পের চেকপোস্টের সামনে দাঁড়ায়। চেকপোস্টে পরিচয়পত্র জমা দিয়ে প্রবেশের অনুমতি পেলাম। সেখানের একটা হোটেলেই সকালের নাশতা সেরে নিয়েছিলাম। তারপর সরাসরি সকাল সাড়ে সাতটার দিকে আসি মিরিঞ্জা ভ্যালিতে। কৌতূহলবশত রাস্তার পাশে একটা উঁচু পাহাড়ে উঠতেই সবাই আনন্দে মেতে ওঠে—নীল আকাশ আর পাহাড়ের ঘা ঘেঁষে মেঘের জমা থাকা বিভিন্ন ধাঁচ দেখে। এত অপূর্ব দৃশ্য যেন শুধু বাংলাদেশের মিরিঞ্জা ভ্যালিতেই দেখা যায়! আমরা আগেই একটা জুমঘর বুক করে নিয়েছিলাম। সেখানে দুপুরের খাবার, রাতের বারবিকিউ ও পরের দিন সকালের নাশতার ব্যবস্থা ছিল। মিরিঞ্জা ভ্যালির পাহাড়ে উঠে রেস্ট করার পর বিকেলে গেলাম মাতামুহুরী নদীর তীরে। নদীর দুই পাশে মারমা, ম্রো এবং পাশাপাশি বাঙালিরাও বসবাস করেন। তাঁদের জীবনবৈচিত্র্য ও আঙিনা খুবই সাদামাটা, দারুণ।

তাঁদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আমাদের কিছুটা বিমোহিতও করেছে। মাতামুহুরী নদীতে পানিতে স্রোত কম হলেও নদীর দুই তীরে নানা রকম ফসলের সমারোহে সবুজ ও সজীবতার ছোঁয়া পেয়েছি। এমনকি অল্প পানির নদীতে নেমে আমরা গোসলও করেছি।

সেখান থেকে সন্ধ্যায় যখন মিরিঞ্জা ভ্যালির জুমঘরে পৌঁছাই, তখন অন্ধকারে জুমঘরের ফুঁটা দিয়ে আকাশে তাকিয়ে বেশ মুগ্ধ হই। আকাশজুড়ে তারার মেলা। রাতে কনকনে ঠান্ডায় গান, আড্ডা আর দুষ্টুমিতে সময়টা কাটল। রাতের ঘুমটা পাহাড়ের চূড়ায় জুমঘরের বারান্দায় তীব্র শীতে জড়সড় অবস্থায় কেটেছে। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন চোখ মেলি, তখন বেশ বিস্মিত—সবুজে ঘেরা পাহাড়, কুয়াশা আর মেঘের সহাবস্থানে পাহাড়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। মনে হচ্ছে, পাহাড়ের স্বর্গে বসবাস করছিলাম। সূর্যের আলো যত প্রখর হচ্ছিল, তত সৌন্দর্যের রূপ, আকৃতি বদলাচ্ছিল। মহান স্রষ্টার কী অনবদ্য সৃষ্টি! আমাদের সিজান ভাই এসব দৃশ্য দেখার পর কত রকম টার্ম ব্যবহার করছিলেন।

বন্ধু টুটুল তো মুগ্ধ হয়ে ‘ইনসেইন’, ‘চার্মিং’, ‘ওয়ান্ডারফুল’ শব্দ ব্যবহার করছিল। সকালটা ঘুরে বেড়িয়েছি পুরো মিরিঞ্জা ভ্যালির এই পাহাড় থেকে ওই পাহাড়ে। সেখানের পথে পথে অনেক আদিবাসী পেঁপে, কলা, ডাব, আখ ও অন্যান্য ফল বিক্রি করছিলেন পর্যটকদের জন্য। আমরা একটা পাহাড়ের টং থেকে চা নিয়ে জানালার ধারে বসে সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম আর কয়েকটা ফটো নিচ্ছিলাম।

ঘুরে বেড়িয়ে আসার সময় মনে হচ্ছিল, সুইজারল্যান্ডের গ্রেট সেন্ট বার্নার্ড পাসের মতো সুন্দর আমাদের মিরিঞ্জা ভ্যালি। ভ্রমণপিপাসু মানুষ যাঁরা মিরিঞ্জা ভ্যালি ভ্রমণ করতে চান, তাঁরা আগে থেকেই জুমঘর ভাড়া নিয়ে সব কনফার্ম করে যাবেন। পাশাপাশি টয়লেট, ওয়াশরুম ও খাবারের প্যাকেজ সম্পর্কেও সম্পূর্ণ জেনে যাবেন। আর সঙ্গে করে মাস্ক, পানি, টিস্যু ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস সরকার, প্রশাসন এবং সবার সার্বিক সচেতন ও সহযোগিতায় মিরিঞ্জা ভ্যালি এবং বান্দরবানের অন্য পর্যটনকেন্দ্রগুলো একদিন বিশ্বের মানুষের কাছে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পাবে তার আপন সৌন্দর্যের জন্য। আসার সময় মিরিঞ্জা ভ্যালিকে বিদায় জানিয়ে ছলছল দৃষ্টিতে আঁকাবাঁকা পাহাড়ের রাস্তায় গাড়ির কাচ দিয়ে সৌন্দর্যঘেরা পথ উপভোগ করতে করতে আসছিলাম। আর মনে মনে ভাবতে থাকলাম, কী স্মরণীয় এক ভ্রমণ ছিল, যা স্মৃতি হয়ে সামনের দিনগুলোর জন্য দারুণ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।

*লেখক: মো. সাঈদ আহমেদ রিফাত, শিক্ষার্থী গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

**নাগরিক সংবাদ-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]