নদীর পাড়ে এক বেলা

সময় তখন সবেমাত্র ভোর। পূর্ব আকাশে সুযি৵ মামা উঁকি দিতে শুরু করেছে। এদিকে শন শন গতিতে চলতে শুরু করল গাড়ি। গাড়িভর্তি একঝাঁক উদ্দীপ্ত তারুণ্যে। যাদের চোখেমুখে হাস্যোজ্জ্বল প্রাণবন্ত প্রতিচ্ছবি। ক্লাসরুমের একঘেয়েমি পাঠদানে তারা যেন হাঁপিয়ে উঠেছিল। সেই একঘেয়েমি কাটাতে সেই সঙ্গে বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে জানতে আয়োজন করা হয়েছে কোর্সভিত্তিক ফিল্ড ট্যুর।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের অনার্স তৃতীয় বর্ষে ‘উন্নয়ন যোগাযোগ’ নামে একটি কোর্স রয়েছে। শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন যোগাযোগের বাস্তবায়ন স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করাতেই কোর্স শিক্ষক প্রভাষক শবনম ফেরদৌসীর তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয় দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পগুলোর একটিতে, যার নাম পদ্মা সেতু।

একটি দেশের মান পরিমাপ করা হয় তার অর্থনীতি, যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন ব্যবস্থার দ্বারা। একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম একটি সূচক হলো উন্নয়ন যোগাযোগ। আর এ জন্য প্রতিটি দেশ চায় দ্রুত যোগাযোগের সঙ্গে থাকতে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের উন্নয়ন যোগাযোগেরই বাস্তবায়িত রূপ।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল একটি দেশ। নদীমাতৃক এ দেশটিতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য নদী। তাই যাতায়াত ব্যবস্থায় আমাদের নৌপথের আশ্রয় নিতে হয়। আর নৌপথে আমাদের সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় প্রতিনিয়তই বিভিন্ন ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। আর তাই এ যাতায়াতব্যবস্থাকে গতিশীল করতে প্রয়োজন হয় সেতুর। তাই স্বভাবতই এদেশের যোগাযোগব্যবস্থায় সেতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেতু থাকলে নদীর দুই দিকের মানুষের যোগাযোগব্যবস্থায় যেমন উন্নতি হয়, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি হওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ঘটে।  

দেশের প্রধান তিনটি নদী হলো পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। এগুলো মধ্যে মেঘনা ও যমুনা নদীর ওপর ইতিমধ্যেই সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি ছিল শুধু পদ্মা নদী। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের লোকজনকে পদ্মা নদী পেরিয়ে রাজধানীসহ পুরো দেশের সঙ্গে প্রতিটি ক্ষেত্রে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। আর এতে করে ওই অঞ্চলগুলো যেন অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। আর এ সমস্যা সমাধানে সরকার সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর অবশেষে আলোর মুখ দেখে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। পদ্মা সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে দেশের যোগাযোগব্যবস্থা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে।

নেদারল্যান্ডসভিত্তিক এক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ এক টাকা খরচের বিপরীতে দুই টাকা লাভবান হবে। (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো)
সেতু পেরিয়ে গাড়ি ছুটে চলল শরীয়তপুরের জাজিরা ঘাট এলাকায়। সময়টা তখন ঠিক সকাল গড়িয়ে দুপুর নামার পথে। ক্লান্ত সূর্যটা হেলে পড়তে শুরু করেছে পশ্চিমাকাশে। জলে চোখ ফেরালেই তীক্ষ্ণ আলোর ঝলকানির দৃশ্য। আকাশের রক্তিম রঙে নদীর জল যেন রঙিন হয়ে উঠেছে। নদীর বুকে খেলা করছে জোয়ার–ভাটার স্রোত । যে স্রোতের কুল কুল ধ্বনিতে তৈরি হয়েছে ঢেউ। ঢেউয়ের আঘাতে নদীর পাড় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

এদিকে সূর্যের চিকচিক আলো যেন ঢেউয়ের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে। ঝিলিমিলি ঢেউ খেলানো সেই সোনারঙের জলে নৌকা ভেসে যাওয়ার দৃশ্য যেন সবাইকে যেন মুগ্ধ করেছিল। কিছু সময়ের জন্য পদ্মা পাড় শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। পদ্মার ঠান্ডা শীতল হাওয়া যেন তাদের রোমাঞ্চিত করে তোলে। কেউবা প্রাণ খুলে সেই দৃশ্য উপভোগ করছিল, কেউবা আবার ছবি তুলে সেই মুহূর্তটা স্মরণীয় করে রাখছিল।
নদী পাড়ে সর্বত্রই বিরাজ করে এক নৈসর্গিক নীরবতা। নদীর তীর ঘেঁষে বাতাসের স্রোত সাঁতরে উড়ে চলে সাদা বক আর গাঙচিলের ঝাঁক। বিস্তৃত পদ্মা নদীর তীর আর স্বর্গীয় আভায় পুলকিত পরিবেশ দেখে যেন দুচোখর তৃষ্ণা মেটে না। বিশ্বস্রষ্টা নিজেকে আড়ালে রেখে এই মোহময় সৌন্দর্যের মধ্যে মানুষকে যেন ডুবিয়ে রেখেছে।

ফেরি ঘাটে যেতেই দেখলাম ঘাটে যেন কান্নার রোল পড়েছে। ফেরিগুলো যেন মানুষের পদচারণায় মুখরিত হবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কেউ নেই। ঘাট কেন্দ্রীক জীবীকা নির্বাহ করা মানুষ গুলোর চোখেমুখে যেন এক ধরনের হতাশা বাসা বেঁধেছে। পদ্মা সেতু একদিকে যেমন আনন্দ বয়ে এনেছে , পাশাপাশি বয়ে এনেছে এক সমগ্র দুংখ। যে দু:খের সাক্ষী ফেরি ঘাটের দোকানি, কুলিরা। এমনি আক্ষেপ জানাচ্ছিলে ঘাটে ঝালমুড়ি ও ফুচকা বিক্রেতারা। আবুল মিয়া পেশায় আখের রস বিক্রেতা। তিনি বলেন, আগের মতো আর ঘাটে মানুষ আসে না। আর রস কেউ কেনে না। এখন সবাই ওই পদ্মা সেতু দিয়ে যায়।

বাঙালি জাতির জন্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে নন্দিত বাস্তবতা হলো পদ্মা সেতু। বিশ্বের দরবারে যুগ থেকে যুগান্তরে সক্ষমতার অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকবে এ সেতু। প্রমত্তা পদ্মার ওপর মহাসেতু নির্মাণের যুগব্যাপী মহাযজ্ঞের পর জাতি স্বপ্ন ছুঁতে সক্ষম হয়েছে। শ্রমিক থেকে প্রকৌশলী সবাই যেন সেই মহাযজ্ঞের বাস্তবায়ন ঘটাতেই উঠেপড়ে লেগেছিল এক মহাযুদ্ধে। ঝড়-বৃষ্টি এমনকি করোনা মহামারিও তাদের দমাতে পারেনি। তাদের চোখেমুখে ছিল ইতিহাস রচনার অদম্য ক্ষুধা। ভ্রমণপিপাসু শিক্ষার্থীরা বলেন, একসময় পদ্মা সেতু ছিল মানুষের কল্পনায়। নানা চড়াই– উতরাই পেরিয়ে অবশেষে আজ তার বাস্তবায়ন ঘটেছে। এর মধ্যে দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এখন আর ফেরির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টার ফেরিঘাটে অপেক্ষায় থাকতে হবে না। দক্ষিণ অঞ্চলের কৃষিপণ্যে খুব সহজেই সারা দেশে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। বাণিজ্যিক ঘাটতি কমে যাবে। কৃষকদের অবস্থার উন্নতি সাধিত হবে। দক্ষিণ অঞ্চলে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠবে। যা ওই এলাকার জীবনযাত্রা আরও উন্নত করবে। সর্বোপরি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটবে।

পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের চিত্র স্বচক্ষে অনুধাবন করতেই উন্নয়ন যোগাযোগ কোর্সের শিক্ষার্থীদের এ ভ্রমণ। পদ্মার উপরে সেতু নির্মাণের ফলে দুই পাড়ের জনজীবনে কতটুকু প্রভাবিত হয়েছে তার একটি দৃষ্টান্ত উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে শিক্ষার্থীরা। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে মানুষ এখন আর ফেরি ঘাটে যাচ্ছে না। এতে করে ফেরিঘাট এলাকার হোটেল ও দোকানগুলোতে বিক্রি কমেছে। অচল হয়ে পড়েছেন দোকানিরা। যাত্রীর অভাবে ফেরি মালিকদের অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে তারাও সারথি তাঁদের বাদ রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ জন্য তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার বিশেষ প্রয়োজন। পরিশেষে, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মিল-ফ্যাক্টরি গড়ে উঠবে। বিদেশিরা ওই এলাকায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করবেন। এতে গতিশীল হবে অর্থনীতির চাকা। ব্যবসা-বাণিজ্যে আসবে নতুন গতি। উন্নত হবে দেশ ও দেশের মান। পূরণ হবে দেশের স্বপ্ন ,যা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখবে।

*লেখক: ইমন ইসলাম, শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়