ঘুরে এলাম সুন্দরবন

ছবি: লেখক

আমার বাড়ির পাশে সুন্দরবন নাকি সুন্দরবনের পাশে আমার বাড়ি, এ নিয়ে মজা চলতেই পারে। যা-ই হোক, আপাতত মেনে নিলাম সুন্দরবনের পাশেই আমার বাড়ি। হ্যাঁ, পৃথিবীর বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন থেকে ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে বাড়ি হওয়ায় সুন্দরবনের পাশে আমার বাড়ি বললে পাঠক নিশ্চয় রাগ করবেন না।

যাত্রা শুরু

বেলা ১১টার দিকে বিপ্লব দাদার বাইকে দুজন রওনা দিলাম। কখনো পিচঢালা রাস্তা আবার একটু পরে ইটের রাস্তা। মাথার ওপর শরতের নীল আকাশ। সেই আকাশে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ। দুই পাশ দিয়ে ধানখেত, আবার মাঝে মাঝে মাছের ঘের। এভাবে গ্রামীণ জনপদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমাদের বাইক এগিয়ে চলেছে। ও হ্যাঁ, পাঠকদের একটা কথা জানাতে ভুলে গিয়েছি। সুন্দরবনের পাশে বাড়ি হওয়ায় অফিসের ছুটিতে গ্রামে এলে মাঝেমধ্যে সুন্দরবন ঘুরে আসা আমার একটা শখও বলতে পারেন। তবে আজ যাচ্ছি বিশেষ একটা উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে। বেশি ভণিতা না করে বলেই ফেলি, গোলফলের গুড় আনতে।

সহকর্মী তারিক ভাই বেশ কয়েক দিন ধরে এই গুড় সংগ্রহ করার জোর তাগিদ আমাকে দিয়েছেন। শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের কথা রাখতেই মূলত এবার আমার সুন্দরবনে যাত্রা। এই উদ্দেশে সুন্দরবনটাও আরেকবার দেখে আসা যাবে। এভাবে রাস্তার দুই পাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে প্রায় ৫০ মিনিটের মধ্যে আমরা সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে অবস্থিত বানিয়াখালী লঞ্চঘাটে এসে উপস্থিত হলাম। কিছু কিছু জায়গার ইটের রাস্তা খারাপ থাকার কারণে আমাদের কিছুটা বিলম্ব হলো, নাহলে ২৫-৩০ মিনিটের মধ্যে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যেতাম। মাঝখানে নদী, নদীর ওপারেই দেখা যাচ্ছে ঘন সবুজ গাছে আচ্ছাদিত আমাদের গর্ব, অহংকার মায়াবী সুন্দরবন।ঃ

ছবি: লেখক

নৌকাভ্রমণ

সুন্দরবনের এপার দাঁড়িয়ে আমরা একটা নৌকার অপেক্ষায় ছিলাম। যাতে ওপার সুন্দরবনের গাছগুলো ছুঁয়ে আসা যায়। বেশ কয়েকটি নৌকার মাঝিকে বলেও খুব বেশি সুবিধা হলো না। তাঁরা যেতে রাজি হলেন না। অবশেষে আমাদের এ অবস্থা দেখে একজন মাঝি আমাদের ডেকে তাঁর নৌকায় চড়ে ঘুরে দেখার জন্য বললেন। আমাদের খুশি আর দেখে কে! চটজলদি লাফিয়ে উঠলাম। দাঁড় বাওয়া নৌকা, মাঝি দাঁড় বেয়ে চলেছেন এই পাড় থেকে ওই পাড়ে। মাঝির কাছে জানতে পারলাম, নদের নাম কপোতাক্ষ। এটা কিন্তু আগে আমাদের জানা ছিল না। সুন্দরবনের এপারে এসে গাছগুলো ছুঁয়ে দেখলাম। দাঁড় বাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসছে না। এক অদ্ভুত সুন্দর নীরবতা, সেখানে গিয়ে উপলব্ধি না করলে যেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ওপরের নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের ভেলা, সেই নীল-সাদা মিলে জলের নিচে মায়াবী এক সৌন্দর্যের রং তৈরি করেছে। সুন্দরবন যে আসলেই সুন্দর, সেটা অনুভব করার জন্য অবশ্যই একবার এখানে আসা উচিত। কপোতাক্ষ নদের এক পাশে কেউ কেউ আবার ছোট ছোট নৌকা নিয়ে কেওড়া ফল সংগ্রহ করছেন বলে মনে হলো। নীরবতা ভেঙে একটা ইঞ্জিনচালিত নৌকা আমাদের নৌকাটি ক্রস করে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই আবার সেই শান্ত পরিবেশ। বনের ভেতর থেকে মাঝেমধ্যে অজানা পাখির ডাকাডাকির শব্দ কানে আসছে। আমরা অনেক ছবি তুললাম, ভিডিও করলাম। ঘণ্টাখানিক ঘোরাঘুরি শেষে এবার কূলে ফিরে এলাম। নৌকার মাঝিকে কিছু বকশিশ দিয়ে বানিয়াখালী লঞ্চঘাটে এসে দাঁড়াই। কয়েকজনকে দেখলাম, লঞ্চঘাটসংলগ্ন নদে মনের আনন্দে গোসল করছেন। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এবার আর গোসল করার সাধ পূর্ণ হলো না। তবু এই অল্প সময়ে পৃথিবীর বৃহত্তর এই ম্যানগ্রোভ বনের যে সৌন্দর্য উপভোগ করলাম, সেটা মনের মণিকোঠায় অনেক দিন অম্লান হয়ে থাকবে।

ফেরার পালা

এবার ফেরার পালা। শরতের দুপুরের তপ্ত গরমে পুড়তে পুড়তে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। বাজার থেকে কয়েকটা কলা কিনে কিছুটা ক্ষুধা নিবারণ করে সুন্দরবনসংলগ্ন জনবসতির কোল ঘেঁষে আমাদের বাইক এগিয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে আমার বন্ধু, গর্ব সুন্দরবন। এ সেই সুন্দরবন, যে কিনা প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়ের সময় এ উপকূলবাসীর জন্য বুক চিতিয়ে লড়ে যায়। যা-ই হোক, প্রিয় পাঠক, শুরুতেই বলেছিলাম, এবার সুন্দরবন যাওয়ার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। গোলফলের গুড় সংগ্রহ করা।

ছবি: লেখক

কিন্তু সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা অনেক মানুষের কাছে শুনে যেটা বুঝলাম, গোলফল দিয়ে আসলে গুড় তৈরি সম্ভব নয়। তাঁদের ভাষ্যমতে, গোলফলের গুড় বলতে বাস্তবে নাকি কিছুই নেই! তাই বাইকে বসে মনে মনে ভাবছিলাম, তাহলে ঢাকায় বসে গোলফলের গুড় বলে যে জিনিস দিয়ে পিঠা তৈরি করে খেলাম, সেটা আসলেই কী ছিল? বড় একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল। যা-ই হোক, গোলফলের গুড়ের সন্ধান নাইবা পেলাম, সুন্দরবনের যে সৌন্দর্য আমরা উপভোগ করলাম, সেটা আমাদের গোলফলের গুড়ের অতৃপ্তি অনেকাংশেই মিটিয়ে দিল।

ছবি: সংগৃহীত

যেভাবে যাবেন

সুন্দরবনে বৈধভাবে পর্যটকেরা বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন অংশ দিয়ে ঢুকতে পারেন। আমরা যে অংশ দিয়ে গিয়েছিলাম সেভাবে এ রকম সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ করতে চাইলে খুলনা থেকে লঞ্চযোগে শান্তা ঘাটে নেমে সেখান থেকে মোটরসাইকেলে করে গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে বানিয়াখালী ঘাটে চলে আসতে পারবেন। অথবা খুলনা থেকে সরাসরি লঞ্চযোগে বানিয়াখালী লঞ্চঘাটে নামতে পারবেন। তারপর সেখান থেকে ছোট নৌকা ভাড়া করে উপভোগ করতে পারবেন সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য!

*লেখক: প্রীতম মণ্ডল, ব্যাংক কর্মকর্তা