ঘুরে এলাম কলকাতা, দেখলাম কত কিছু
এ বছরের ৩ অক্টোবরে ঢাকার আরামবাগ থেকে শ্যামলী এনআর ট্র্যাভেলসের ইন্টারন্যাশনাল বাস সার্ভিসে আমি রওনা দিই সরাসরি কলকাতার উদ্দেশে। প্রায় তিন ঘণ্টা পর আমরা ভোর ছয়টায় পৌঁছে গেলাম বেনাপোল স্থলবন্দরে। ফ্রেশ হওয়ার পর আমরা আমাদের পাসপোর্ট ও ট্র্যাভেল ট্যাক্স, পোর্ট ফি পরিশোধ করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমার সব ডকুমেন্ট চেক করার পর আমরা অপেক্ষা করলাম দুই দেশের জিরো পয়েন্টে। কিছুক্ষণ পর আমরা আমাদের সবকিছু নিয়ে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) অফিসে প্রবেশ করলাম। এখানেও আমাদের সব ডকুমেন্ট দেখে কিছু প্রশ্ন করল, তারপর প্রবেশ করলাম ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায়। সেখানে বাংলাদেশের টাকাগুলো আমি ভারতের রুপিতে পরিবর্তন করে নিলাম।
এরপর বাসচালকের সহকারী শংকর দাদার কথামতো বাসে উঠে রওনা দিলাম কলকাতার উদ্দেশে। দুই ঘণ্টা পর আমরা সকালের খাবারের জন্য বিরতি দিলাম ফুড পার্ক রেস্তোরাঁয়, যা কলকাতার দত্তপুকুর নামে একটি স্থানে ছিল। খাবার শেষ করে আমরা আবার রওনা দিলাম কলকাতায়। বেলা দুইটায় আমরা পৌছে গেলাম আমাদের গন্তব্য স্থানে, বাস থেকে নেমে আমাদের লাগেজ নিয়ে আমি থাকার জায়গার জন্য হোটেল খুঁজছিলাম। মাকুইস্ট স্টিট থেকে দুই মিনিট দূরত্বে আমি পেয়ে গেলাম আলসানা গেস্ট হাউজ নামের আবাসিক হোটেলে।
বিকেলে পার্ক স্টিট থেকে পৌঁছে গেলাম কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় ও নান্দনিক স্থান নন্দনে। একটি বিকেলকে প্রাণবন্ত করতে যা যা লাগে, তার সব কিছু পাওয়া যায় এখানে। আমাদের বাংলাদেশের সেগুনবাগিচার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মতো নন্দন। এখানকার পরিসরটি বিশাল আকারের, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি, রবীন্দ্রসদন, লেক, চারুকলা ভবন, ক্যান্টিন, বিভিন্ন পানির ফোয়ারা, বাগানসহ আরও অনেক কিছু আছে এ স্থানে। বাংলা মুভি এবং নাটক দেখার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা ভবন। বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য, যা সন্ধ্যার আলোতে এক অপরূপ দৃশ্য ধারণ করে। ক্যান্টিনে তাদের জনপ্রিয় কয়েকটি স্ট্রিট ফুড খেয়ে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চলে গেলাম নকশিকাঁথার প্রদর্শনী দেখতে। এর কিছু সময় পর মুভি দেখতে ঢুকে গেলাম নন্দনে। হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বড় উৎসবের পাঁচ দিন আগে যাওয়ার কারণে কলকাতা ছিল সাজ সাজ রব। রাস্তার দুই পাশে আলোকসজ্জা, হাজার রকমের সাজবাতি, ব্যানার, গেট। কলকাতার কয়েকটি বিষয় আমাকে অবাক করেছে একটি হলো, এখানে আপনি আপনার ইচ্ছামতো দৈনন্দিন দ্রব্যসামগ্রী নিতে পারবেন। প্রয়োজনে এক টুকরা মাছ, রাস্তায় লাল সিগনাল দেখামাত্র সবাই অটোমেটিক দাঁড়িয়ে যাবে, ১২ থেকে ১৫ রকমের মিক্স ফল আপনি খেতে পারবেন মাত্র ৫০ টাকায়। মুভি দেখে হাঁটতে শুরু করলাম রাতের কলকাতাকে দেখার জন্য—গুরুত্বপূর্ণ শপিং মল এবং মোড়ে মোড়ে এখানে আপনি দেখতে পাবেন স্ট্রিট সিঙ্গার, গিটার হাতে গান গাইছেন তাঁরা। রাতে রাস্তার দুপাশে পেয়ে যাবেন স্টিট খাবার, যা মোখরোচক ও টেস্টি। রাতের কলকাতার সৌন্দর্য্য উপভোগের পর আমি রওনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশে রাত তখন ১১টা। প্রথম দিনের পরিভ্রমণ এখানেই শেষ করলাম।
দ্বিতীয় দিনে ভোর ৫টায় বের হলাম, উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি, হাওড়া ব্রিজ ও হাওড়া স্টেশন, স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি, মেট্রোরেল, শিয়ালদা স্টেশন, মাদার ওয়াক্স মিউজিয়াম, ইকো পার্ক, বিশ্ব বাংলা গেট, নিউমার্কেটসহ বিবিধ স্থান। উল্লেখিত স্থানগুলোকে নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। এ জন্য আমি সংক্ষেপে সারমর্ম লিখছি সব স্থান নিয়ে। ভোরে বের হয়েছি হাওড়া ব্রিজে নেমে দুই চোখ ভরে দেখলাম সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিগুলোকে। শত শত মানুষ কাজের সন্ধানে বের হচ্ছে, পৃথিবীর মানুষ দ্বারা সৃষ্ট সৃষ্টিগুলোর মধ্যে এ হাওড়া ব্রিজটি একটি, মাঝখানে কোনো পিলার ছাড়া একটি ব্রিজ এটি, প্রতিদিন লাখ লাখ ভারী যানবাহনের ওপর দিয়ে যাতায়াত করে। ব্রিজের এক পাশেই অবস্থিত হাওড়া স্টেশন, যা আমার দেখা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সুন্দর স্টেশন। দেখতে যেন আস্ত একটি বিশাল রাজপ্রাসাদ। পাশে গঙ্গা নদী বয়ে চলেছে নিরবধি। ব্রিজের নিচ দিয়ে ফুল বাজারের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে খুঁজে বের করলাম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মস্থান জোড়াসাকো ঠাকুরবাড়ি।
পথে দেখতে পেলাম কলকাতার অন্যতম একটি মন্দির শ্রী বৈকুণ্ঠনাথ মন্দির, যা দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের আদলে তৈরি। তারপর আমি স্থানীয় ব্যাক্তিদের সহযোগিতায় পৌঁছে গেলাম স্বামী বিবেকানন্দ জন্মস্থান যা রামকৃষ্ণœমিশনে, স্বামী বিবেকানন্দের পৈত্রিক বাসভবন ও সাংস্কৃকিতকেন্দ্র নামে এখানে পরিচিত। এখানে একটি জাদুঘর রয়েছে, অনেক ভোরে যাওয়ার কারণে আমি জাদুঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। তারপর চলে গেলাম শিয়ালদাহ স্টেশন বাংলাদেশ থেকে আগত বেশির ভাগ পর্যটকে স্টেশন দিয়েই কলকাতায় প্রবেশ করে। স্টেশন থেকে আমি মেট্রোরেলের জন্য পাশেই মাটির নিচের অবস্থিত শিয়ালদহ মেট্রোরেল এ গেলাম। টিকিট কেটে অপেক্ষা করলাম স্টেশনে, ৭ মিনিট পর চলে এল ট্রেন, বাংলাদেশের মেট্রোরেলের মতোই কলকাতার মেট্রো। সল্ট লেকে নেমে আমি দুপুরের খাবার খেয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম মাদার ওয়াক্স মিউজিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। ১ ঘণ্টা পর আমি কলকাতার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এ মিউজিয়ামে প্রবেশ করলাম। আধুনিক বিশ্ব যে কত এগিয়ে গেছে, তা আমরা কিছুটা কল্পনা করতে পারি এখানে প্রবেশ করলে। এবার আপনাদের নিয়ে যাব কলকাতা শহরের সবচেয়ে বড় জায়গাজুড়ে অবস্থিত ইকো পার্কে। আপনি এ পার্ক পুরোটি ভালোভাবে দেখতে চাইলে সারাটি দিন এখানে থাকতে হবে। তা না হলে এখানকার সকল আয়োজন উপভোগ করতে পারবেন না। আমি লেক এবং বিশ্বের সপ্তাশ্চর্য সাইটটি দেখেছি শুধু তিন ঘণ্টায়। যা এ পার্কেও ২০ ভাগের ৫ ভাগ হতে পারে। আসার পথে আমি বাসে করে নেমেছি বিশ্ব বাংলা গেট। এখানের চারপাশটি দারুণ। বিশাল একটি ঝুলন্ত রেস্তোরাঁ রয়েছে এখানে। এবার সরাসরি চলে গেলাম কলকাতার সবচেয়ে জনবহুল স্থান নিউমার্কেটে। ১২-১৪ প্রকারের শুকনা ফল খেয়ে আমি চলে গেলাম শ্রীলেদারের শোরুমে। সেখান থেকে একটি কেডস, একটি বেল ও একটি ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে চলে এলাম কসমেটিকের দোকানে। ফ্রেশ হয়ে মদিনা মসজিদের পাশের মুসলিম হোটেল থেকে রাতের খাবার শেষ করে, মির্জা গালিব স্ট্রিটের চারপাশে ৩০ মিনিট হাঁটার পর আমি বিশ্রাম নিতে চলে গেলাম হোটেল আলসানা গেস্ট হাউজ।
তৃতীয় দিন পরিকল্পনা মতো মান্না দের কফি হাউস, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উদ্যান, প্রেসিডেন্সি কলেজ, শ্রী অরবিন্দ পাঠমন্দির, কলকাতা বইয়ের রাজ্য, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, সংস্কৃত কলেজ, হিন্দু স্কুল, পুটিরামের মিষ্টি খাওয়া, কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত স্ট্রিট ফুড টেস্ট করব, ঐতিহাসিক টাম্পে ও ঠেলা রিকশায় চড়াসহ বিবিধ ঐতিহাসিক স্থাপনা পরিদর্শন করব। উল্লেখিত সব স্থানে ঘুরে ঘুরে রাত ১০টায় আমি কলকাতা মাকুইস্ট স্ট্রিটের বিখ্যাত মুসলিম হোটেল আবদুল খালেক হোটেলে গিয়ে রাতের খাবার খেয়ে, রাস্তার পাশে একটি টংদোকানের মাটির তৈরি কাপে কলকাতার চান্দুরি চা খেয়ে আমি ঘুমানোর জন্য চলে গেলাম হোটেলে।
প্রিয় পাঠক, আজ আপনাদের বলব কলকাতা শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু পর্যটক স্থান নিয়ে। কলকাতা ভ্রমণের চতুর্থ দিনের প্রথমে আমি চলে গেলাম দুটি ঐতিহাসিক মসজিদ দেখতে। ১. নাখোদা মসজিদ ও ২. টিপু সুলতান মসজিদ। ভোরে দুটি মসজিদ দেখার পর আমি মোহনকুঞ্জ, একুশে উদ্যান এবং হাজি মহসীন স্কয়ার পার্ক পরিদর্শন করি। তারপর আমি চলে যায় কলকাতা সায়েন্স সিটি দেখার উদ্দেশ্য, সায়েন্স সিটির পাশেই আমি সকালের নাশতা সেরে প্রবেশ করি সেখানের থ্রিডি শোগুলো দেখার জন্য, সায়েন্স সিটির বাইরের সৌন্দর্য উপভোগ করি, পার্কের ভেতরে রয়েছিল শিক্ষণীয় বিভিন্ন ইভেন্ট, যা থেকে আগত দর্শনার্থীরা সায়েন্সের বিভিন্ন অ্যাকটিভিটি শিখতে পারবে। প্রাচীন মানব ইতিহাসের ওপর এখানে একটি শো দেখানো হয়, যা থেকে অনেক প্রাচীন মানব ইতিহাস জানানো হয় আগত সবাইকে। দুই ঘণ্টা এখানে থেকে বের হয়ে রওনা দিলাম কলকাতার সবচেয়ে বড় পর্যটনকেন্দ্র মহারানী ভিক্টোরিয়া প্যালেজ পরিদর্শনে। সম্পূর্ণ সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি এ ভিক্টোরিয়া প্যালেসের চারপাশ যেমন প্রাকৃতিক গাছগাছালি দিয়ে পরিপূর্ণ, তেমনি এর ভেতরের জাদুঘর এবং সৌন্দর্য্য অপূর্ব এবং আর্কষণীয়। প্রতিদিন এ ভিক্টোরিয়া প্যালেস দেখতে হাজারো দর্শনার্থী এখানে প্রবেশ করেন। ভিক্টোরিয়া প্যালেসের দরবার হলে চলছিল ১০ দিনব্যাপী দুর্গোউৎসব, ৪-১৩ অক্টোবর ২০২৪। প্যালেসের সৌন্দর্য দেখার পর আমি চলে গেলাম তার পাশেই রানী ভিক্টোরিয়ার প্রার্থনার স্থান সেন্ট পল ক্যাথিড্রাল গির্জায়। কলকাতার অন্যতম দর্শনীয় স্থান এটি। ভারতের অন্যতম পুরাতন গির্জা এটি। এর পাশেই রয়েছে বিড়লা তারামণ্ডল যা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম তারামণ্ডল এখানে মহাকাশের ওপর একটি ডকুমেন্টরি দেখানো হয়, যা থেকে আগত দর্শনার্থীরা মহাকাশের জানা অজানা অনেক বিষয় জানতে পারেন। এগুলো দেখার পর আমি সন্ধ্যায় চলে গেলাম রুমে। ফ্রেশ হয়ে নাশতা করে বের হলাম, রাতের হাওড়া বিজে লঞ্চ ভ্রমণের উদেশ্যে। আমার হোটেল থেকে হাওড়া ব্রিজ ২০ রুপি ভাড়া। বাস থেকে নেমে আমি লঞ্চ টিকিট কেটে রওনা দিলাম গঙ্গা নদী ও বিশ্বের অবাক করা হাওড়া ব্রিজের রাতের রূপ উপভোগ করতে। শীতল হাওয়া বইছে নদীর দুই পাশে ব্যস্ত নগরী। এ ঘাটের লোক ও ঘাটে এবং ও ঘাটের লোক যাচ্ছে অন্য ঘাটে। রাত ১০টায় ফিরলাম।
শেষ দিন কলকাতায় সকাল ৯টায় রওনা দিব কলকাতা নেতাজী সুবাস দত্ত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ স্থান থেকে চলে যাব আগরতলা রাজা বীরবিক্রম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। সে স্থান থেকে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থবন্দর হয়ে রেলস্টেশন থেকে কুমিল্লা শহরে। এভাবেই শেষ করলাম আমার ঐতিহাসিক ‘কলিকাতা ভ্রমণ ২০২৪’।
*লেখক: ফিরোজ হোসেন ফাইন, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট
*নাগরিক সংবাদে, লেখা, ছবি ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন আপনিও। [email protected]এ পাঠঅতে পারবেন