আন্দামানের পোর্টব্লেয়ারে কয়েকটা দিন যেভাবে কাটল

Md. Rashedul Alam Rasel

গত বছর অক্টোবরে গেলাম ভারত মহাসাগরে অবস্থিত আন্দামান ও নিকোবারের রাজধানী পোর্টব্লেয়ারে। ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রার কোল ঘেঁষে এ দ্বীপাঞ্চল অনেকের কাছে পরিচিত ‘কালাপানির দ্বীপ’ নামে। ইংরেজদের কারাগার কুখ্যাত ‘সেলুলার জেল’ রয়েছে এই দ্বীপে যেখানে ভারতের স্বাধীনতাকামী রাজবন্দীদের জাহাজে করে শাস্তিস্বরূপ পাঠানো হতো জনমানবহীন, পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা হিংস্র শ্বাপদসরিসৃপসংকুল এ দ্বীপে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত এই বিপ্লবীদের একদিন এখানেই ইহলীলা সাঙ্গ হতো। অনেকে সাজাভোগের পর আর ভারতবর্ষে জন্মভূমিতে ফেরৎ যাননি। এখানেই স্থানীয়দের বিয়ে করে রয়ে গেছেন। তাঁদের সন্তানেরা ‘লোকাল বরণ’ বা এই দ্বীপে জন্ম নেওয়া মানবগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। এদের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। তাঁদের রয়েছে ‘লোকাল বরণ অ্যাসোসিয়েশন।’ অনেকে নির্বাচিত হয়েছে স্থানীয় পঞ্চায়েত, গ্রামপ্রধান ইত্যাদি। চাষবাস, কৃষিকাজ, পশুপালন করে চলে তাঁদের জীবন।

চেন্নাইয়ের পদুচেরিতে গিয়েছিলাম একটি কনফারেন্সে যোগ দিতে। ভাবলাম এত কাছে এলাম, একটু কষ্ট করে মাত্র দুই ঘণ্টার উড়োজাহাজে জার্নি, আন্দামানে যাই না কেন। জাহাজেও যাওয়া যায়। সময় লাগে দুই দিন। কিছুটা মনোটোনাস, সঙ্গে সি-রোলিংও আছেই। আবার কোলকাতা থেকে জাহাজে বা প্লেনেও যাওয়া যায় পোর্টব্লেয়ারে।

আন্দামান ও নিকোবার একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। রাজধানী পোর্টব্লেয়ার বিমানবন্দরের অনেকটা পুরনো তেজগাঁও বিমানবন্দরের মতো। খুব একটা প্লেন ওঠা-নামা করে না। বেশ ঘরোয়া ঘরোয় ভাব। এয়ার ইন্ডিয়ার বড় জাহাজ ছাড়াও রয়েছে ইন্ডিগো, স্পাইসজেট ইত্যাদি।

বিমানবন্দরের ফর্মালিটিজ দ্রুত সেরে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম ঝলমলে বিকেল। একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা চেপে আগেই বুকিং করা একটা এয়ার বিএন্ডবি হোটেলে চেক ইন করলাম। বিমানবন্দরের পাশেই। পোর্টব্লেয়ারের সুবিধা হলো যত্রতত্র বাংলায় কথা বলা যায়। পশ্চিম বাংলার অনেক মানুষ এখানে বসতি গেড়েছেন। খাওয়াদাওয়া বাংলাদেশের মতোই। ডাল-ভাত মাছ রয়েছে।

আন্দামানের জঙ্গলে বেশ কয়েকটি কৃষ্ণকায় আদিম জনগোষ্ঠী প্রায় ৬০ হাজার বছর ধরে বসবাস করছেন। মনে করা হয়, এরা আফ্রিকা থেকে এসেছে এবং এখনও পূর্বের জীবনধারা, সংস্কৃতি বজায় রেখেছে। এরা হচ্ছে জারওয়া, অংগী, গ্রেট আন্দামানিজ, নিকোবারী, সম্পেন, সেন্টিনালিজ ইত্যাদি। এরা প্রধানত, জঙ্গলের ফলমূল, জীবজন্তু, শুকর, গাছের মধু, নদীর মাছ কাঁচা খেতে অভ্যস্ত। এরা প্রচুর শক্তিশালী এবং আধা-উলঙ্গ থাকে। আমরা ওদের বলি ‘অসভ্য’, ‘জংলী’। ওরাও আমাদের মতো মানুষদের মনে করে অসভ্য। সম্প্রতি ওরা জ্বালানী কাঠের ব্যবহার শিখেছে এবং মাংস ঝলসে খাচ্ছে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সময় এদের ওপর বেশ গবেষণা করেছিলাম। প্রস্তর যুগের এ মানুষেরা পরিবর্তনে বিশ্বাস করে না। এরা ‘সভ্য মানুষদের’ রোগ-জীবাণুকে খুব ভয় পায়। কারণ, ওদের রোগ প্রতিরোধের কোনো টিকা-অষুধ নেওয়া হয় নাই। হাম, যক্ষা, ম্যালেরিয়া, এইডস—এসব রোগের কোনো প্রতিষেধক এদের নেই। একবার হাম জ্বরে প্রকোপে অনেক মানুষ মারা যায়। এ জন্যই ‘সভ্য জগতের’ ট্যুরিস্ট, পুলিশ, ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি এদের জঙ্গলে ঢুকলেই বিষাক্ত তীর দিয়ে আক্রমণ করে।

পোর্টব্লেয়ারে দিন সাতেক ছিলাম। এবার ওদের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ঢোকার সুযোগ হলো। ‘আন্দামান ট্রাংক রোড’ জারওয়াদের জন্য ‘সংরক্ষিত এলাকা’র মাঝবরাবর চলে গেছে। পোর্টব্লেয়ার থেকে জিরকাটাং চেক পোস্ট পেরিয়ে বারাটাং চলে গেছে। একদম উত্তরে গেলে পাওয়া যাবে মায়াবন্দর, কদমতলা নামক শহরতলী। নব্বই কিলো এগিয়ে গেলে পাওয়া গেল বারকাটাং। সুন্দর পিচ ঢালা পথ। দুই পাশে সুউচ্চ গাছের সারি। পুলিশের নিরাপত্তা ছাড়া পর্যটকদের চলাচল নিষিদ্ধ। জারওয়াদের সঙ্গে কথা বলা, হ্যান্ডশেক করা, ছবি তোলা, কোনো খাবার দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

পথে দেখা হলে, একজন মধ্যবয়সী জারওয়া মানুষ লাকড়ির বোঝা ঘাড়ে নিয়ে পথ পার হচ্ছেন। অর্থাৎ রান্না করা খাবার খেতে এরা অভ্যস্ত হচ্ছে। দুজন জারওয়া কিশোর-কিশোরী টি-শার্ট পরে হাঁটছে। ভারত সরকার এদের রেশন দিচ্ছে। পোশাক পরিচ্ছদ দিচ্ছে এবং ক্রমেই এ জারওয়া জনগোষ্ঠী সমাজের মূল ধারার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।

মিশলে ক্ষতি কী? সিদ্ধান্ত এদেরকেই নিতে হবে। তবে বিচ্ছিন্ন সেন্টিনেল দ্বীপে বসবাসরত সেন্টিনেলিজরা এখনও স্বকীয়তা বজায় রেখে চলছে। কোনো পর্যটক এ বিচ্ছিন্ন দ্বীপে প্রবেশের চেষ্টা করলে বিষাক্ত তীর দিয়ে হত্যা করা হয়। এরা সংখ্যায় মাত্র জনা ৪০ হতে পারে।  ওরা জানে ‘সভ্য’ জগতের সংস্পর্শে আসলে ছোঁয়াচে রোগ ভোগে ওরা একসময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

পোর্টব্লেয়ার শহরটি ভারতের অন্য যে কোনো ছোট শহরের মতোই। গাড়ি, স্কুটার, স্কুটি চলছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে বসবাস করছে। আন্দামান প্রধানত পর্যটক এলাকা হিসেবে খুব জনপ্রিয়। পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা শহরটিতে অনেক  স্বল্প খরচের হোটেল রয়েছে। সাদা ভাত, মাছ, তরকারি সবই পাওয়া যায়। আমি গেলাম রস আইল্যান্ড, হ্যাভলক আইল্যান্ড, রাধানগর সৈকতে এক দিনের জন্য বেড়াতে। হ্যাভলকে এসে আমার তো চোখ ছানাবড়া। বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) অনেক শরণার্থী এখানে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে বসবাস করছেন। রাস্তাঘাটে বাংলায় কথা বলে যাচ্ছি। আমার বাড়ি বাংলাদেশ শুনেই অনেকেই খুলনা–যশোরে পিতৃপুরুষের ফেলে রেখে আসা বাড়িঘরের কথা বললেন।

পোর্টব্লেয়ারে এসে বেশ কয়েকটি মিউজিয়াম ঘুরলাম। সেলুলার জেল মিউজিয়াম ছাড়াও রয়েছে নৃতাত্ত্বিক মিউজিয়াম, নেভির তৈরি সামুদ্রিকা মিউজিয়াম ইত্যাদি। এ যাদুঘরগুলোতে আন্দামান-নিকোবারের আদিম জনগোষ্ঠীর বিবরণ, জীবনযাত্রা প্রণালি, বাড়িঘর, পোশাকপরিচ্ছদের একটি চিত্র পাওয়া যায়। এছাড়া, সাগরের তলদেশের বিভিন্ন প্রকার প্রাণীকে কাচের জারে রাখা হয়েছে। পোর্টব্লেয়ার থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের আন্দামান-নিকোবার এনভায়রমেন্ট টিম (এ্যানেট) দেখতে গেলাম।

সমুদ্রের কুমির, প্রাণীবৈচিত্র্য সংরক্ষণে গবেষণা হচ্ছে। বেশ অনেকগুলো গবেষণা প্রবন্ধের খোঁজ পেলাম। উত্তরের মায়াবদরে ‘কারেন’ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেশ কয়েকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, জানতে পারলাম।

Md. Rashedul Alam Rasel

আন্দামান এসে জানলাম, ভারত সরকার পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা জীববৈচিত্র্য ভরপুর এ দ্বীপপুঞ্জে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে হংকং, সিংগাপুর, দুবাইয়ের মতো আধুনিক বন্দর স্থাপন করতে যাচ্ছে। এখানে তৈরি হবে প্রায় ৭ লাখ মানুষের দুটি নতুন শহর, বিমানবন্দর, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, হোটেল, মোটেল, পানশালা ইত্যাদি। এই নয়া প্রকল্পের কারণে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য, বিরল প্রজাতির গাছপালা, প্রবাল, সামুদ্রিক কচ্ছপ এক দিন হয়তো চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে। অনেক আদিম জনগোষ্ঠী, যথা সম্পেন, নিকোবারিজ চিরদিনের জন্য নিজেদের ভাষা, স্বকীয়তা, সংস্কৃতি ভুলে মূল জনধারায় হারিয়ে যাবে। বিরল প্রজাতির বৃহদাকার ৫ ফুট লম্বা ১০ মন ওজনের ‘লেদারব্যাক সামুদ্রিক’ কচ্ছপ তাদের আবাসস্থল হারাবে। কারণ, এরা প্রতিবছর হাজারো মাইল দূর থেকে এসে একই জায়াগায় বালুমাটিতে ডিম পাড়ে। সেখানে বন্দর-কোলাহল সৃষ্টি হলে, স্থান পরিবর্তন হলে, এদের জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হবে। ২০৫০ সালের মধ্যে প্রকল্পটি সমাপ্ত হলে বৈদেশিক মুদ্রা হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু বিরল প্রজাতির গাছপালা, জীবজন্তুর, এ অভয়ারণ্য চিরতরে হারিয়ে যাবে।

মনটা ভারাক্রান্ত হলো। একসময় দেশে ফেরার সময় হল। গাঢ় নীল ভারত মহাসাগরের সবুজ জঙ্গলে ঘেরা পোর্টব্লেয়ারকে বিদায় জানিয়ে  আবার ফেরৎযাত্রা করলাম চেন্নাই হয়ে ঢাকার পথে।

*লেখক: মাহফুজুল হক, সাবেক সচিব