একদিন চাঁদপুরের পথে পথে

ইলিশ ভাস্কর্যের সামনে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

প্রতিদিনের টুকিটাকি কাজের চাপ নিতে নিতে শরীর-মন ঝিমঝিম করছে। ক্লান্ত শরীর ও মনে একটি সফর করতে পারলেই ক্লান্তির অবসান হতো। হঠাৎ এক প্রশান্তিময় সকালে চা-চুমুকে মাথায় জাগল কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়? লম্বা সময় নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সংলাপ করে সবাইকে মেঘনার পাড় বেড়ানোর কথা বলি।

সেই সঙ্গে আপনাদের একটি কথা বলে রাখি, ভ্রমণ হলো একটি সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা, ভ্রমণের সঙ্গে মানুষের মনের গভীরে স্পর্শ করা যায়। শুধু তা-ই নয়, ভ্রমণে মানুষ নিজের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে পরিচিত হয় পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। ভ্রমণে সুখ-দুঃখ সঙ্গে প্রতিদিনের জীবনের বিভিন্ন রঙের স্বাদ অনুভব করা যায়। তাই আমাদের এবারের গন্তব্য ইলিশপ্রিয় ভোজনরসিকদের শহর চাঁদপুরে।

আমাদের গন্তব্য ইলিশের রাজধানী চাঁদপুরে। তাই সবাই ভ্রমণের আনন্দে হইচই করে বেড়াচ্ছে। সবাই মিলে যাত্রা শুরু করি। নদীর পানিতে লঞ্চটি সাঁতার কাটছে। আমরা নদীর বিভিন্ন রূপের সৌন্দর্য দেখতে পাচ্ছি। কালো পানির তালে, সবুজ পাহাড়ের কাছে, আর নীল আকাশের ছায়ায় সবকিছু একত্রে নদীর সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের মনে ভ্রমচ্ছেদ ঘটিয়ে দিয়েছে। বাতাসের আঘাতে আমরা আকাশে মেঘের খেলা দেখতে পাচ্ছি এবং দূরত্বে প্রান্তিক গ্রাম ও জেলেদের জীবনের চিত্রও আমাদের দেখাচ্ছে নদীর কাহিনি।

লঞ্চ থেকেই চোখে দেখি ছোট্ট ছোট্ট ডিঙি, জলের ঢেউয়ের মধ্যে নৌকার ওলট–পালট দেখে সময় পেরিয়ে এসে পড়েছি চাঁদপুরে। বড় স্টেশনে পৌঁছে মেঘনার বুকে তাকিয়ে কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে যাই অজানা স্থানে। পদ্মা, মেঘনা এবং ডাকাতিয়া নদীর সঙ্গমস্থল, যেখানে বড় স্টেশন মোলহেড অবস্থিত, এখন পরিচালিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু পার্ক হিসেবে। বঙ্গবন্ধু পার্কে প্রবেশ করলে আপনি দেখতে পাবেন ইলিশের ভাস্কর্য এবং শিশুদের বিনোদনের ব্যবস্থা। সামনে এগিয়ে যাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ, যা মূলত রক্তধারার স্মৃতি নিয়ে সূচনা করে। এই স্মৃতিস্তম্ভের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বড় স্টেশন মোলহেড একটি ভাস্কর্য অংশে পরিণত হয়েছে। এটি একটি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ঘটে গেল অমানবিক নির্যাতন ও হত্যা এবং অসংখ্য মানুষের লাশ নদীতে ফেলে দেওয়ার ঘটনার স্মৃতি নিয়ে প্রতীকী হয়েছিল। চোখ যত দূর যাবে, সবুজ সব গাছপালা। আর বড় বড় গাছের ফাঁকে পড়ছে চিকচিক রোদ।

মোহনার কোলঘেঁষে বসার জন্য ইট-পাথরের রংবেরঙের বেঞ্চ আছে, চাইলে আপনি তীরের ঢালে বসেও সারা দিন কাটাতে পারেন। সব দুঃখে অবসান হবে এখানে পার করা সময়টুকুতে। ক্লান্তি আপনাকে ছুঁবে না; বরং জিবে জল আনা কিছু খাবারের স্বাদ নিতে পারবেন। নিজ চোখে দেখতে পেরেছি নদীর যৌবন, সেই সঙ্গে বিচিত্র সব মানুষের উপস্থিতি—সবকিছুই আমাদের মুগ্ধ করেছে। আমরা সেখানে বেশ ভালোই সময় কাটিয়েছি। এটি আলোকচিত্রীর জন্য আদর্শ একটি স্থান। আমিও আমার ফোনে আপনাদের দেখানোর জন্য কিছু ছবি চট করে তুলেছি ও ভিডিও করেছি। ফেরার পথে সূর্যাস্ত দেখা, এ যেন স্বর্গীয় অনুভূতি।

ব্রিজের গোড়া থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যাত্রা শুরু হলো নতুন গন্তব্যের উদ্দেশে। ২৫ মিনিট পর চলে এলাম হরিণা ফেরিঘাটে এসে ইলিশভাজা খাই। তবে হ্যাঁ; ইলিশভাজা খেতে মন চাইলে দামদর করে কিনে খাবেন। বিকেলে ওই আকাশে একঝাঁক পাখি ওড়াউড়ি করছে। আমরাও দাঁড়িয়ে দেখছি আর পথ চলছি। এত বড় সূর্য এক পলকে ছোট হয়ে গেছে। সূর্য দ্রুত হাঁটছে, আমরা তাকিয়ে দেখছি আর বন্ধুদের বলছি, ওই দেখা যায় সূর্যের বাড়ি।

এই রোমাঞ্চকর ভ্রমণ শেষে রাতের খাবার শেষে আমরা পুনরায় আমাদের বাসায় ফেরার পথে নেমে পড়ি। হাসি ও হাঁটার কথা না–ইবা বলি। ভ্রমণ শেষ আমাদের মোটেও কোনো ক্লান্তি নেই। নদীপ্রেমীদের জার্নি বোধ হয় এমনই।

পড়ন্ত বিকেল
ছবি: লেখক

চাঁদপুর এলে যা দেখতে পারবেন—

তিন নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত চাঁদপুর জেলায় এসে দেখতে পারবেন—ইলিশ চত্বর, ডিসির বাংলো, রক্তধারা ও অঙ্গীকার স্মৃতিসৌধ। এ ছাড়া কিছু ঐতিহাসিক স্থান—যেমন রূপসা জমিদারবাড়ি, লোহাগড় মঠ, ৫০৫ বছরের পুরোনো হরিপুর জমিদারবাড়ি ও হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ ইত্যাদি।

কীভাবে যাবেন—

ঢাকা থেকে চাঁদপুরের দূরত্ব কম হওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থা অনেক ভালো। চাইলে অল্প সময়ে স্বল্প খরচে আসা যায়। সদরঘাট থেকে চাঁদপুরগামী লঞ্চে চাঁদপুর নেমে পড়বেন। ভোরে রওনা দিয়ে একদিনে ঘুরে বিকেলে চলে যেতে পারবেন।

যেভাবে থাকবেন—

যাতায়াত সহজ হওয়ায় সকালে বের হয়ে সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসা যায়। এ ছাড়া রাত্রী যাপন করার জন্য স্বল্প মূল্যে বিভিন্ন হোটেল পাবেন।

যা খেতে পারবেন—

প্রথমত বলে রাখি, ইলিশ মাছের জন্যই চাঁদপুর সবার কাছে জনপ্রিয়। তবে ভ্রমণপিপাসুদের মন কেড়ে নেওয়ার মতো এখানে পাবেন কিছু দর্শনীয় স্থান। ভোজনরসিকেরা তাজা ইলিশের স্বাদ নিতে হলে ইলিশের রাজ্যে আসতে হবে। এ ছাড়া যাঁরা মিষ্টান্ন খেতে পছন্দ করেন, তাদের জন্য আছে ওয়ান মিনিট আইসক্রিম, আউয়ালের মিষ্টি, মতলবের ক্ষীর।

লেখক: তানবির শেখ, শিক্ষার্থী, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়