মেঘনার তীরে মাটির গল্প

একবার শরতের পূজার ছুটিতে বাড়িতে ছিলাম। হঠাৎ করেই ঢাকা থেকে এক পত্রিকার সম্পাদক বড় ভাই আমাদের এলাকায় বেড়াতে এলেন। নরসিংদীতে তেমন ঘোরার জায়গা নেই, নাগইরাকান্দি ছাড়া। তাই উনাকে সেখানেই নিয়ে গেলাম।

আগের মতো রাস্তার পাশের পরিচিত দোকানগুলোয় না গিয়ে, এবার বসলাম এক নতুন রাস্তার দিকের চায়ের দোকানে। চা খেতে খেতে ভাই দেশি গান ধরলেন, আমি চারপাশের প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে শুনছিলাম, মাঝেমধ্যে ভিডিওও করছিলাম। রাস্তা দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তারা কৌতূহলভরে আমাদের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছিল। গ্রামের মানুষ এমনিতেই সব বিষয়ে আগ্রহী হয়—শহরে যেমন কেউ কাউকে তেমন লক্ষ করে না।

সন্ধ্যা হয়ে এল। তখনো দেখি, দূর নদীর পাড়ের মাটির রাস্তা দিয়ে কয়েকজন মানুষ হেঁটে আসছে। তাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করলে বলল—‘ওদিকেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে, যেতে পারেন।’ চারপাশে তখন হালকা অন্ধকার, বাতাসে নদীর গন্ধ। নাইরাকান্দি এলাকায় ডাকাতি আর ইভটিজিং প্রচুর হয়—এই ভয়েই আগে কখনো ওইদিকে যাওয়ার সাহস পাইনি। কিন্তু সেদিন অজানার টানে সাহস করেই এগোলাম।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

রেস্টুরেন্টটির নাম ‘মাটি’। টিনের তৈরি ছোট ঘর, ঠিক নদীর ওপরে। প্রথমে ঢোকার ইচ্ছা হচ্ছিল না, কিন্তু কৌতূহল সামলাতে পারলাম না। ভেতরে ঢুকেই দেখি—পুরোনো দিনের বই, ক্যাসেট আর ক্যামেরা দিয়ে সাজানো এক অন্য রকম পরিবেশ। বহুদিন ধরে আমি একটা পুরোনো ক্যাসেট খুঁজছিলাম সংগ্রহে রাখার জন্য। কতজনকে জিজ্ঞাসা করেছি, কেউ দিতে পারেনি। তাই এগুলো দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লাম। ছোটবেলায় যে ক্যাসেট দিয়ে খেলতাম—তার স্মৃতি যেন ফিরে এল।

রেস্টুরেন্টের মালিককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভাইয়া, এগুলো কী আপনার?’

উনি হাসলেন, বললেন, ‘হ্যাঁ, আমারই। আপনি চাইলে একটা নিতে পারেন।’

খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিল, এক টুকরা শৈশব হাতে ফিরে পেয়েছি।

এরপর আমরা চায়ের অর্ডার দিয়ে নিচে নেমে এলাম। নদীর ওপরে বাঁশের মাচায় বসার জায়গা করা—হারিকেন আর কুপির আলোয় খাবার পরিবেশন হয়। সেই মেঘনা নদীর তীরে বসে বহু বছর পরে শুনলাম ঝিঁঝিপোকার ডাক, দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক, আর চারপাশে নদীর নীরবতা। সেদিন ছিল প্রবারণা পূর্ণিমা। চাঁদটাকে ঢুবে যেতে দেখলাম।

তবে রাতে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হলো না। এই এলাকায় ডাকাতি খুব হয়। পাঁচ আগস্টের পর থেকে কেউ রেললাইনের দিক দিয়ে মাধবদীতে যেতে রাজি হয় না। ডাকাতেরা প্রায়ই হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে যায়—নরসিংদীর ভয়াবহ এক বাস্তবতা। তাই তাড়াতাড়ি রেস্টুরেন্টমালিকের ফোন নম্বর নিয়ে আমরা মূল রাস্তা ধরে বাসায় ফিরে এলাম।

বেশ কয়েক দিন পর, কৃতজ্ঞতা জানাতে আবার গেলাম—একটা বই উপহার দিতে। দুপুরের দিকে রোদের তাপে যখন পৌঁছালাম, দেখি রেস্টুরেন্ট বন্ধ। আগের রাতে পাওয়া নাম্বারে ফোন দিলাম অনেকবার, অবশেষে এক লোক ধরে বলল—‘ভুল নম্বর।’ মনটা খারাপ হয়ে গেল।

ওইদিকে কাশফুলে ভরা মাঠ। একা একা বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভাবলাম, রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড থেকে নাম্বারটা দেখি। কল দিতেই রেস্টুরেন্টের মালিক উজ্জ্বল ভাই ধরলেন। বললেন, ‘আমি লোক পাঠাচ্ছি, আপনি সামনের রাস্তার চায়ের দোকানে বসুন।’

চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে বাচ্চাদের কাণ্ড দেখছিলাম। নদীতে চায়ের দোকানদার টায়ার ভাড়া দেয় গোসল করার জন্য। বাচ্চাগুলোর বয়স ৪ থেকে ১২—ক্লাস টু থেকে সেভেন, কেউবা নাইনের ছাত্র। ওরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে, বাড়ি থেকে টাকা চুরি করে সিগারেট কিনে খায়, তারপর নদীতে গোসল করে। জীবনে প্রথমবার দেখলাম ক্লাস ওয়ানের এক বাচ্চা সিগারেট খাচ্ছে। চেহারায় মনে হয় ভালো পরিবারের সন্তান।

এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর উজ্জ্বল ভাই এলেন, আমাকে নিয়ে গেলেন ভেতরে। এবার খেয়াল করে দেখি—রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই ময়না পাখি ‘সালাম’ দিল, একটু পরে একটা বিড়াল এসে পথ দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগে রেস্টুরেন্ট যখন বন্ধ ছিল বাইরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলাম, ভাবছিলাম ভেতরে মানুষ আছে, কিন্তু সেটা ছিল ময়নাটির কথা।

মেনু লেখা আছে চক দিয়ে বোর্ডে। মাটি আর বাঁশের কাপে চা পরিবেশন করা হয়। উজ্জ্বল ভাই আমাকে কফি আর মাফিন দিতে বললেন, তারপর শহরে বাজার করতে চলে গেলেন। উনি নিজেই বাজার করেন, রান্না করেন, আবার নিজেই খাবার পরিবেশনও করেন।

দুই ঘণ্টা পর উনি ফিরে এলেন। এর মধ্যে আমি চারপাশটা ঘুরে দেখলাম—বিশাল কাশবন, নদী, নৌকা, দূরে মাছ ধরছে কয়েকজন। রেস্টুরেন্টের ভেতর থেকেই দেখা যায় সবকিছু। নদীর ওপারে নরসিংদী শহর স্পষ্ট দেখা যায়। রেস্টুরেন্টের ছেলে মোশাররফ বিড়ালকে খাবার দিচ্ছে, ময়নাকেও কিছু খাওয়াচ্ছে। পুরো দৃশ্যটা যেন ‘মাটির ময়না’ সিনেমার মতো লাগছিল।

এর মধ্যে এলাকার অনেকেই এসে গল্প করল। আমি বসে পড়লাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইটা নিয়ে। পানির ওপর মাচায় বসে বই পড়ার সে অভিজ্ঞতা অন্য রকম ছিল।

বাজার শেষে উজ্জ্বল ভাই পিৎজা বানালেন। গ্রামের আত্মীয়ের বাড়িতে গেলে যেমন বাজার করে এসে রান্না করে খাওয়ায় সে রকম লাগল ব‍্যাপারটা। খেতে খেতে গল্প করলেন। বললেন, ‘মাধবদী থেকে তোমার মতো একটা মেয়ে বেরিয়ে আসছে দেখে অবাক হয়েছি।’ জানতে পারলাম, উনি আগে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতেন—মন বসছিল না, তাই ফিরে এসে এই নদীর ধারে রেস্টুরেন্ট খুলেছেন। এখানে নানা মানুষ আসে, গল্প করে, ঋতু বদলের সঙ্গে প্রকৃতির রূপ উপভোগ করে। উনি বললেন, সবচেয়ে সুন্দর হয় সূর্যাস্তের সময়—প্রতিদিনের সূর্যাস্ত নাকি আলাদা রঙে জ্বলে ওঠে নদীর পানিতে।

আমি যখন বললাম, দেশের বাইরে চলে যেতে চাই, উনি একটু চুপ করে বললেন—

‘যান, কিন্তু ফিরবেন একদিন। একেবারে চলে যাবেন না।’

সেদিন বুকের ভেতরটা কেমন হালকা কষ্টে ভরে গেল। মনে হলো, অনেক দিন পর দেশের মাটির গন্ধ ঠিক এমনভাবে অনুভব করলাম। আমাদের দেশের এত এত সমস্যা কিন্তু আমাদের দেশের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে।

পিৎজা খাওয়া শেষে উনি দিলেন রোজেল টি—একটা ফুল থেকে তৈরি চা, ভেষজগুণে ভরপুর। চা খেতে খেতে এলাকার আরও কিছু মানুষের গল্প শুনলাম। তারপর উজ্জ্বল ভাই নিজে বাইকে করে আমাকে বেশ দূর পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন।

বাড়ি ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, আমি যেন কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলাম—তবু সেই বেড়ানোটা ছিল নিজের ভেতরে ফেরা। উজ্জ্বল ভাইয়ের রেস্তোরাঁ, নদীর গন্ধ, হারিকেনের আলো, ময়নাপাখির ডাক—সবকিছু মিলিয়ে মনে হলো, শৈশবের সেই গ্রামীণ আত্মীয়ের বাড়িতে ফিরে গেছি।

লেখা: নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়