শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ: রাতে শান্তির বৃষ্টি, সঙ্গে এক কাপ চা
রোজার ঈদের এযাবৎকালের দীর্ঘ ছুটিটা কোনো রকম প্রোডাকটিভ কিছু না করে কাটিয়ে দেওয়ার পর কোরবানি ঈদের ছুটিটা বরবাদ না হওয়ার সুযোগ এল। ট্যুরমেট তমালিকা আর আমি মিলে পরিকল্পনা করলাম শ্রীমঙ্গল যাব। সেই মতে ট্রেনের টিকিট কাটা হলো, ঈদের দুই দিন পর আব্বাকে যখন বললাম শ্রীমঙ্গল যেতে চাই, আব্বা বললেন, ‘টিকিট ক্যানসেল কর, এখন যাওয়ার দরকার নেই।’ তমালিকাকে বললাম ‘পাপ্পা নেহি মানেঙ্গে।’ তমালিকা বলে, ‘আপুউউউউ।’ আমি বলি, ‘দাঁড়াও আপডেট জানাচ্ছি।’ হঠাৎ মনে হলো বড় ভাই থাকার একটা সুবিধা তো থাকবে, ছোটবেলায় আব্বার বাইক নিয়ে দুপুরে যখন বের হতো, আমিই তো পাহারা দিতাম। বড় ভাইয়ের হাজারটা শর্ত মেনে নেওয়ার পর সকালে ট্রেনে চেপে রওনা দিলাম ভেড়ামারা থেকে। ট্রেনে তুলে দিতে এসে বাবা আর আমি রীতিমতো একটা যুদ্ধ করলাম, ট্রেনের টিকিট কাটা ক বগিতে, আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম শেষের দিকে। ওদিকে ট্যুরমেট তমালিকা খুলনা থেকে আসছে। পারাবত আর জয়ন্তিকাতে সিট না পেয়ে কালনী হলো শেষ ভরসা।
রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে খেয়ে আবার কিছুক্ষণ বাইরে বসে থাকলাম। রিসোর্টের পরিবেশ এত প্রাকৃতিক যে কারও মন ভালো হতে বাধ্য।
এর আগে সিলেট থেকে ফেরার সময় ট্রেন থেকে চা–বাগান দেখার শখ মেটেনি। এবারও হতাশই হতে হলো। পরিকল্পনা করেও কিছু করা গেল না। ট্রেন এক ঘণ্টা লেট। আগে থেকেই হিড বাংলাদেশের রিসোর্টে রুম বুকিং দেওয়া ছিল। এ বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতা করার জন্য শিখা আপু আর হাসেম ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ। শ্রীমঙ্গল স্টেশনে পৌঁছালাম যখন, তখন সন্ধ্যা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি দিয়ে শ্রীমঙ্গল অভ্যর্থনা জানাল। রাতের খাওয়ার পাট চুকিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে হিড বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা করলাম। শ্রীমঙ্গলের আঁকাবাঁকা রাস্তা, অরণ্যের নির্জনতা, সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি বিদ্যমান। হিড বাংলাতে চেক ইন করে ঘুম।
সকালে উঠে দরজা খুলে বাইরের এক সুন্দর রূপ চোখে পড়ল। সামনে বিশাল এক খোলা প্রান্তর, দূরে উঁচু টিলা। ফ্রেশ হয়ে বের হলাম মৌলভীবাজারের বড়লেখায় মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের উদ্দেশে। কিন্তু বেরিয়ে দীর্ঘক্ষণ কিছুই পাওয়া গেল না। অবশেষে সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে বড়লেখা পৌঁছে উদরপূর্তি করে টিকিট কেটে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে দেখা মিলল মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের। বেশ কিছুক্ষণ জলপ্রপাতের পানিতে পা ভিজিয়ে চা–বাগানের রাস্তা ধরে পরবর্তী গম্তব্য শমসেরনগর গলফ মাঠ। ওখানে গিয়ে উইন্ডোজ ওয়ালপেপারের ভিউ পাওয়া গেল আর দূরেই ছোট ছোট টিলা আর চা–বাগান। দিন শেষে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ফিরে এলাম দুদিনের কুটিরে।
হিড বাংলায় আগে থেকেই বলা ছিল রাতের খাবারের কথা। ওদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। রাতের খাবার শেষে হিড বাংলার লবিতে বসে এক কাপ চা খাওয়া হলো। শ্রীমঙ্গলের প্রধান সৌন্দর্য হলো বৃষ্টি, সারা দিন যত গরমই পড়ুক, রাতে হবে শান্তির বৃষ্টি, সঙ্গে যদি এক কাপ চা থাকে, একদম পরিপূর্ণ শ্রীমঙ্গলের স্বাদ। পরের দিন ভোরের আলো ফুটতেই বাইরে বেরিয়ে দেখি একটা বানর মনের সুখে কাঁঠালগাছে বসে কাঁঠাল খাচ্ছে। আমাদের রুমটা ছিল রিসোর্টের শেষ প্রান্তে, ভোরে ওখানটায় বসে সূর্য ওঠা দেখতে বেশ লাগত।
রুমে ফিরে পরিকল্পনামতো রওনা দেওয়া হলো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে। আবার সেই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি বনের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়া, উদ্যানে ঢুকতেই একপাল বানরের সঙ্গে দেখা হলো খাবার লোভে দাঁড়িয়ে আছে, কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের সন্ত্রাসী রূপ দেখা গেল। খাবার নিয়ে প্রবেশ করা এক দম্পতির ওপর চড়াও হয়েছে। খাবারগুলো তাদের দিয়ে রক্ষা হলো। একটু এগিয়ে সামনের দিকে যেতেই কোলাহল কমার সঙ্গে সঙ্গে বনের উপস্থিতি টের পাওয়া গেল। আস্তে আস্তে বনের শব্দ প্রকট হতে থাকল। বিভিন্ন পাখির শব্দ আর শনশন বাতাসে অরণ্যের গন্ধ ভেসে আসতে লাগল। ট্রেন লাইনটার কাছে গিয়ে দেখি লোকসমাগম অনেক কম, রেললাইন ধরে কিছুটা হাঁটা হলো। বনের মাঝ দিয়ে রেললাইন। রেললাইনটা পেরিয়ে বনের আরও একটু ভেতরে কোলাহল পেরিয়ে যেতেই বন আর বনের শব্দ। এখান থেকে খাসিয়া পল্লি যাবার কথা থাকলেও তা আর হলো না। ফিনলে চা–বাগানের পাশেই আদিনীলকণ্ঠ কেবিনে আট লেয়ারের চা খেয়ে সামনেই রাবার বাগানটা দেখে আবার রওনা দিলাম।
এর পরের গন্তব্য কমলপুর উপজেলার মাধবপুর ইউনিয়ন। বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধে। আবার চা–বাগানের রাস্তা ধরে চলে যাওয়া হলো মাধবপুর। একদম তপ্ত দুপুর। ওখানটাতে দাঁড়াতেই মনে হলো, কত আগের সময় তবুও দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার কী অসীম সাহস ছিল। বাংলাদেশের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠল। পরের গন্তব্য মাধবকুণ্ড লেক। মাধবকুণ্ড লেকের সামনে থেকে আনারস কিনে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল একটা লোক একমনে বাঁশি বাজাচ্ছে। লেকের পানিতে শালুক ফুটে আছে। এগুলো পেরিয়ে সামনে এগুতেই দেখা মিলল উঁচু টিলার। বন্ধুর পথ পেরিয়ে টিলাতে উঠতেই চোখের সীমানাজুড়ে শুধু সবুজের সমারোহ। আমি আর তমালিকা কোলাহলমুক্ত স্থানে বসে আনারসগুলো খেতে খেতে আবার নতুন ট্যুরের প্ল্যান করতে থাকলাম। ওখানটায় বসে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর একদম শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। সামনে সবুজ চায়ের গালিচা আর তা পেরিয়ে সামনেই সুনীল আকাশ। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে বসে থাকলাম। ফেরার সময় আবার সেই বাঁশির সুর শুনলাম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে।
নূরজাহান টি স্টেটে যখন পৌঁছালাম, তখন গোধূলির শেষ প্রান্ত। গরুগুলো নিয়ে চা–বাগানের পথ দিয়ে রাখালেরা এগিয়ে যাচ্ছে, সঙ্গে আছে সারা দিনের সঞ্চিত লাকড়ি। যখন হিড বাংলায় ঢুকলাম, তখন সন্ধ্যা। লবির সামনে ফাঁকা জায়গাটায় বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে খেয়ে আবার কিছুক্ষণ বাইরে বসে থাকলাম। রিসোর্টের পরিবেশ এত প্রাকৃতিক যে কারও মন ভালো হতে বাধ্য। আর সবার ব্যবহার বেশ অমায়িক। রুমে ফিরে সারা দিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল শুরু হলো আবার সেই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে। এ দিনটার লেখা আগে পোস্ট করেছি, আদমপুর এক্সপ্লোরের স্মৃতি। আদমপুর থেকে ফিরে ফিনলে চা–বাগানের ভেতর দাঁড়িয়ে আমি আর তমালিকা কবিতা আওড়াতে আওড়াতে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ শেষ করলাম।
নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]