গ্রিন ভ্যালি পার্কে শিক্ষাসফর

‘শিক্ষাসফর’ শব্দটি শুনলেই একধরনের আনন্দ–উচ্ছ্বাস আর নস্টালজিয়া ভর করে আমাদের মনজুড়ে। ছোটবেলা থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার কথা চিন্তা করলেই আমাদের মনে একধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি সৃষ্টি হতো। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে এসেও সেই আনন্দে কোনো ঘাটতি পড়েনি। বরং সেটা আরও গভীর হয়েছে। কারণ, এখন বুঝি এই মুহূর্তগুলো কতটা অমূল্য। শিক্ষাসফর মানে শুধু আনন্দ নয়, এটা ক্লাসরুমের বাইরে সহপাঠী, সিনিয়র-জুনিয়র ও শিক্ষকদের সঙ্গে অন্য রকম সম্পর্ক তৈরি করার এক অনন্য সুযোগ।

২১ এপ্রিল ২০২৫, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল শিক্ষাসফরের, যার গন্তব্য ছিল নাটোরের গ্রিন ভ্যালি পার্ক। এটি শুধুই একটি শিক্ষাসফর ছিল না, বরং ছিল হাসি–আনন্দ, ভোজন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আন্তরিক সম্পর্কের এক অসাধারণ মেলবন্ধন। এ দিনটি আমার স্মৃতির পাতায় চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এটি কেবল একটি ভ্রমণ ছিল না, বরং এটি ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের অন্যতম মধুর অভিজ্ঞতা।

তখন সময় সকাল সাতটা। মাত্রই সকাল হয়েছে। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। আর বৈশাখের তপ্ত গরমের মধ্যেও হালকা শীতল বাতাস বইছে। আমরা সবাই সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী একাডেমিক ভবনের সামনে জড়ো হয়েছিলাম। সবার মুখে হাসি, গায়ে পরিপাটি রঙিন পোশাক, হাতে হাতে মুঠোফোন। একেকজন বিভিন্ন পোজে ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমরা বন্ধুরা মজা করছিলাম। অনেক জুনিয়র বিভিন্ন কাজে দৌড়াদৌড়ি করছিল। শিক্ষকেরা সন্তুষ্ট মুখে আমাদের দেখছিলেন আর দিকনির্দেশনা দিচ্ছিলেন কীভাবে সিনিয়র হিসেবে জুনিয়রদের সঙ্গে মিশে আমাদের এই শিক্ষাসফর সফল করতে হবে।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রার জন্য তিনটি বাস রাখা ছিল সিরাজী ভবনের সামনে। সকাল আটটায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। যাত্রা শুরু হতেই গানবাজনা, হাসাহাসি, জুনিয়রদের নাচানাচি আর দল বেঁধে আড্ডা সব—মিলিয়ে বাসে বসেই পাচ্ছিলাম শিক্ষাসফরের থ্রিল। ক্লাসরুমের সিরিয়াসনেস হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেল, সিনিয়র–জুনিয়র সবাই হয়ে উঠল বন্ধু। সবার তখন একটাই পরিচয়, আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী।

রাস্তাজুড়ে চোখে পড়েছিল একের পর এক দোকান, মাঠ, আমের গাছ। প্রকৃতি যেন নিজ হাতে আঁকা একটি ছবি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরছিল। আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা পর পৌঁছালাম আমাদের গন্তব্যে।

সময় সকাল ১০টা। গ্রিন ভ্যালি পার্কে পা দিতেই মনটা আনন্দে ভরে গেল। পার্কটি কৃত্রিম হলেও তার সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। সারি সারি ফুলের বাগান, চারপাশে প্রজাপতির ওড়াউড়ি, গাছে গাছে চঞ্চল কাঠবিড়ালি, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্নের কোনো জগতে পৌঁছে গেছি।

গাড়ি থেকে নেমেই সকালের নাশতা। মেনুতে ছিল খিচুড়ি আর সেদ্ধ ডিম। খোলা আকাশের নিচে বসে এই সাধারণ খাবারটিও যেন অসাধারণ মনে হচ্ছিল। পাশেই কেউ গান গাইছিল, কেউ ছবি তুলছিল, কেউ গল্প বলছিল। ছোট ছোট আনন্দই যে জীবনেকে সুন্দর করে তোলে, সেই উপলব্ধি আমার আবারও হলো।

নাশতার পর শুরু হলো দল বেঁধে ঘোরাঘুরি। স্যাররা আগেই বলে দিয়েছিলেন সবাই দল বেঁধে ঘুরবে, এতে সিনিয়র–জুনিয়রের আন্তরিকতা বৃদ্ধি পাবে। গ্রিন ভ্যালি পার্ক যেন এক জাদুর বাক্স; বিভিন্ন ধরনের রাইড, ৯ডি সিনেমা, গেম জোন, লেক, নৌকা আর তার মাঝে হাজারো ফুলের মেলা।

বিশেষ আকর্ষণ ছিল ৯ডি মুভি থিয়েটার। আমি এর আগে কখনো এই থিয়েটারে যাইনি। তাই আমার জন্য এটি ছিল একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা। চোখে চশমা পরে সিনেমা দেখা সত্যিই চমৎকার এক উপভোগ্য বিষয়।

পার্কজুড়েই ছিল সারি সারি আমগাছ। গাছে ঝুলে থাকা কাঁচা আম দেখে কেউ লোভ সামলাতে পারছিল না। অনেক জুনিয়র তো তখনই মজা করে পেড়ে খেতে শুরু করে কাঁচা আম। লুকিয়ে লুকিয়ে আম পেড়ে খাওয়ার এই গ্রামীণ স্বাদ পুরো দিনটিকে আরও জীবন্ত করে তুলেছিল।

ফুলের বাগানে ছবি তোলা, রাইডে চড়া, ঘুরে ঘুরে গল্প করা—সবই চলছিল একই সঙ্গে। ক্লাস, পরীক্ষার চিন্তা যেন কোথাও নেই। তখন বারবার মনে হচ্ছিল আমরা একটি পরিবারের মতো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ পরিবার।

আমাদের জন্য আগে থেকেই একটি বিশ্রামাগার ভাড়া নেওয়া ছিল। নাম ছিল তার ‘সন্ধ্যামালতী’। বেলা দুইটা নাগাদ দুপুরের খাবার পরিবেশন হলো। মেনুতে ছিল পোলাও, খাসির মাংস, ডাল, দই ও কোমল পানীয়। দল বেঁধে একসঙ্গে খাওয়া, একেকজনের প্লেট থেকে দুষ্টুমি করে মাংস তুলে নেওয়া, কেউ মজা করে আবার খাবার মুখে তুলে দিচ্ছে অন্যজনের—এসব দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর।

শিক্ষকেরাও আমাদের সঙ্গে খেলেন, হাসাহাসি করলেন, গল্প করলেন। খাওয়া শেষে কেউ ঘাসের ওপর শুয়ে রোদের গরমে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে, কেউ খেলাধুলা করছে, কেউ আবার চুপচাপ আকাশ ও গাছপালা দেখছে। এই মুহূর্তগুলো যেন সময়ের ফ্রেমে আটকে রাখার মতো।

বিকেল চারটা থেকে শুরু হলো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। শিক্ষার্থীদের নিজেদের আয়োজনে এমন এক চমৎকার পরিবেশনা আমরা উপভোগ করলাম, মনে হচ্ছিল আমাদের বিভাগ শুধু একাডেমিক সত্তা নয়, বরং একটি প্রাণবন্ত পরিবার।

শিক্ষকেরাও খেলাধুলায় অংশ নিলেন। প্রতিযোগিতা শেষে বিজয়ীদের হাতে স্যাররা তুলে দিলেন পুরস্কার আর মেডেল। সবশেষে ছাত্র-শিক্ষক সবাই মিলে একটি গ্রুপ ফটো তোলা হলো, যেটি এই বন্ধনের প্রতীক হয়ে থাকবে। তখন সময় সন্ধ্যা ছয়টা। পার্ক থেকে বিদায় নেওয়ার সময় চলে এল। বাস ছাড়ার আগে সবাইকে পরিবেশন করা হলো আইসক্রিম। ঠান্ডা আইসক্রিম যেন সারা দিনের ক্লান্তিকে মুছে দিল।

বাসে উঠে ফেরার সময়ও আনন্দ চলতেই থাকল। কেউ নাচছিল, আবার কয়েকজন গাইছিল, আবার কেউ কেউ হইহুল্লোড় করতে ব্যস্ত। কেউ ক্লান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করল, কেউ আবার পাশের বন্ধুর কাঁধে মাথা রাখল। রাস্তায় সূর্য ডুবছিল ধীরে ধীরে, আকাশে ছড়িয়ে পড়ছিল রঙিন আভা, পথচারীরা সারা দিনের ক্লান্তিশেষে বিষাদগ্রস্ত মুখ নিয়ে ঘরে ফিরছিল আর বাসে চলছিল এক উল্টো হাসি–আনন্দের জগৎ।

রাত আটটার দিকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পৌঁছালাম। শরীরে একরাশ ক্লান্তি থাকলেও মন ছিল আনন্দে পরিপূর্ণ।

আমার অনার্স লাইফের শেষ শিক্ষাসফর ছিল এটি। এই গ্রিন ভ্যালি পার্কের শিক্ষাসফরটি আমার কাছে শুধু একটি ভ্রমণ ছিল না, এটি ছিল একসঙ্গে বাঁচার, মিশে যাওয়ার এবং বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের সারাংশ উপলব্ধি করার এক অনন্য মুহূর্ত।

একসঙ্গে সবার হাসি, খুনসুটি, খাবার ভাগাভাগি, ক্লান্তির মাঝেও বন্ধুদের কৌতুক—সবই ছিল আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর একটি।

আমার কাছে এই ভ্রমণ একটি বড় শিক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুধু সিজিপিএ বা সার্টিফিকেটে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি আন্তরিকতার গল্পে, বন্ধুত্বের আলিঙ্গনে, শিক্ষকদের দিকনির্দেশনায় ভবিষ্যতের পথে হাঁটার এক অনবদ্য অধ্যায়।

আমি কৃতজ্ঞ আমার বিভাগের প্রতি, শিক্ষকদের প্রতি, বিশেষ করে আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের প্রতি, আর সেই বন্ধুদের প্রতি, যাদের সঙ্গে কাটানো এ দিনটি আমার স্মৃতির পাতায় চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে।

লেখক: আতিয়া ইবনাত রিফাহ্, শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়