ঢাকা-ভুবনেশ্বর: চেনা–অচেনা কণ্ঠস্বর

ভুবনেশ্বরের পটিয়ায় কেআইআইটি আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের সামনে সপরিবারে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুকে কয় দিন আগে সড়কে শৃঙ্খলার একটি ছবি নজরে পড়ল! আলোকচিত্রটি পূর্ব ভারতের একটি শহরের। রৌদ্রময় ভরদুপুরের দৃশ্য। ভাইরাল হওয়া ছবিটি দেখে নিজের দেশের কথা ভেবেছি শুধু। ওদের থেকে আমরা এখনো অনেক দূরে। সড়ক বিভাজনের সাদা দাগের বাইরে স্কুটিচালক ভদ্রমহিলাটিও নন। ডান পাশের পরিচ্ছন্ন পথ যানবাহনশূন্য। ট্রাফিক সিগনালের জন্য হয়তো পরিবহনগুলো ওপারে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বাঁ পাশের সবাই অনড়। সবাই সড়ক আইন পালনে দায়িত্বশীল ও শ্রদ্ধাশীল। এ চিত্র তো আমাদের দেশে অকল্পনীয়! যাঁরা দেশের আইন রক্ষাকারী, তাঁরাই আইন অমান্য করেন!

বেইলি রোডের স্বনামখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানে টানা এক যুগ শিক্ষা নিয়েছে আমার মেয়ে। তার উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত আমরা! ভর্তি কোচিংয়ের ব্যবসা, রাজনৈতিকীকরণ, অনিয়ম, অপেক্ষাকৃত শিক্ষার উচ্চমূল্য ও বৈরী পরিবেশ—সব মিলিয়ে অনেক অভিভাবকের মতো আমিও উদ্বিগ্ন। কষ্টার্জিত রোজগার! সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাবা হিসেবে স্নাতক স্তরে ভর্তিতে মেয়েকে নানা জায়গায় চেষ্টা করছি। পঞ্চম, অষ্টম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির সব পর্যায়ে বেশ ভালো ফলের পরও মেয়ের পছন্দের বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হলো না দেশে। অবশেষে ৬০ শতাংশ শিক্ষাবৃত্তির আওতায় ভর্তির সুযোগ মিলল। কম খরচে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ওডিশা প্রদেশের ভুবনেশ্বরে বেসরকারি শিক্ষালয় কেআইআইটিতে সুযোগ হলো। চার বছর মেয়াদি আট সেমিস্টারে স্নাতক পর্যায়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়বে মেয়ে। ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন এবং মেয়েকে ছাত্রীনিবাসে রেখে আসার জন্য ভুবনেশ্বর গিয়েছিলাম দুই মাস আগে। সপরিবার। কলকাতা হয়ে যাত্রা। ঢাকা থেকে ভুবনেশ্বরে ১০ দিনের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বিচিত্র।

মধ্যরাতের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস। মহানগরের আরামবাগ থেকে চার সদস্যের যাত্রা। সৌহার্দ্য শ্রেণির ঢাকা-কলকাতা জনপ্রতি ভাড়া ২ হাজার ৩০০ টাকা। প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া কেন? পরিবহন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, দুই সীমান্তে যাত্রীকে বাসের নিজ আসনে বসে থাকলেই চলবে। অন্য সব তদারকির কাজ গাড়ির লোকজনই করে দেবে।

পুরী জগন্নাথ মন্দিরের কাছে সপরিবারে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

ভারত-বাংলাদেশ সৌহার্দ্য যাত্রা। রাত সাড়ে ১২টায় ভ্রমণ শুরু। পদ্মা সেতু হয়ে মাদারীপুরের একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে যাত্রাবিরতি। ভোর পাঁচটায় পৌঁছে গেলাম যশোর বেনাপোল সীমান্তে। বাস থেমে আছে। গাড়ির সুপারভাইজার এসে বললেন, সাতটায় কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন। এক লাইনে আমাদের সৌহার্দ্য বাসযাত্রীদের লাইনে দাঁড়াতে হবে! যাত্রীপ্রতি বন্দর চার্জ ১৫০ টাকা দিতে হবে। হাজারো যাত্রী অপেক্ষমাণ। গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছে তারা! সকাল সাড়ে ছয়টায় খুলল বাংলাদেশ সীমান্তের অফিস। সীমান্তে এক রঙের পোশাকে দেখি ২২ জন কুলি ঘুরছে। বাস থেকে চারটি ভারী ব্রিফকেস নামালাম। পেট্রাপোল সীমান্ত অবধি মালপত্রগুলো নিয়ে যাওয়ার শর্তে এক কুলি মজুরি হাঁকলেন ৮০০ টাকা। শেষে ৩০০ টাকায় রফা হলো। বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের বন্দর চার্জ বাবদ চারটিতেই পেলাম ৫১ দশমিক ৮৯ টাকার রসিদ। সুপারভাইজারকে বললাম, ‘প্রায় ১০০ টাকা করে বেশি কেন?’

উত্তর, ‘এটাই দিতে হয়।’ বাংলাদেশ কাস্টমস পর্যন্ত মালপত্র রেখে টাকা নিয়ে চম্পট কুলি। কাস্টমস সদস্য দুজন চা–পানির জন্য টাকা দাবি করলেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সরে পড়লেন তাঁরা। ভারত সীমান্তে ঢোকার আগে মালপত্র মেশিনে স্ক্যানিং এবং দেহ তল্লাশি শেষে বাসে গিয়ে বসি। হরিদাসপুর থেকে বাস ছাড়ল সকাল সকাল সোয়া আটটায়। নিয়ম মেনে চালক পরিচ্ছন্ন রাস্তায় আমাদের নিয়ে চলছেন কলকাতা মূল শহরে। আধা ঘণ্টা পর বারাসাতের বামনগাছির সাধারণ একটি রেস্টুরেন্টে বাসের যাত্রাবিরতি। হাতমুখ ধুয়ে সকালের খাবারের জন্য প্লাস্টিকের তৈরি চেয়ার ও টেবিলে বসে পড়লাম সবাই। পশ্চিম বাংলার এ হোটেলের দাদারা আমাদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলছেন। এখানে শুধু রুটি ও ভাজি নেই! থালি। ভাত, সবজি, পনির, রুটি, ডাল, টক, ধনেপাতাসহ পেঁয়াজ ও টমেটো একত্রে খাবার। থালির মূল্য ১২০ রুপি! একটি মাটির ঘটের দুধ চায়ের দাম ২০ রুপি! ভড়কে গেলাম! অগত্যা খেতেই হলো। ঢাকা থেকে ১ টাকা ২২ পয়সা করে কিনে আনা ৫ হাজার রুপির ৬৩০ রুপি চলে গেল ভারতে প্রথম খাবারেই।

কলকাতার আকাশে ঝকঝকে রোদ। কোথাও কোনো যানজট নেই। গাড়ি চলছে। দু–একটি জায়গায় ট্রাফিক চোখে পড়ল। শৃঙ্খলিত ও নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থা। কলকাতার মারকিউজ স্ট্রিটে যখন গাড়ি পৌঁছাল, তখন বেলা পৌনে একটা। সরু রাস্তার কারণে গাড়ি বেশিক্ষণ রাস্তায় দাঁড়াতে পারল না।

আমাদের গন্তব্য টালিগঞ্জ মিস্ত্রিপাড়া। অ্যাম্বাসেডর হলুদ ট্যাক্সি চালক ৪০০ রুপি চাইলেন। তাড়াহুড়ার মধ্যে বয়স্ক চালক ভদ্রলোককে বললাম ৩০০ রুপি। রাজি হলেন। মালপত্র নিয়ে ট্যাক্সিতে চাপাচাপি। ২২ মিনিটে পৌঁছে গেলাম টালিগঞ্জে গিন্নির ছোট মামার বাড়ি। গিন্নির বড় মামা ও ছোট মাসি থাকেন হুগলীর শ্রীরামপুরে। সেখানে দুদিন বেড়িয়ে ফিরেছি টালিগঞ্জে। উবার চালক ৮০০ রুপির ভাড়া ১ হাজার ১০০ রুপি আদায় করে ছাড়লেন। যাতায়াতে আমাদের বেশির ভাগ বাহন উবার, ওলা ও ট্যাক্সি। উবার ও ওলায় যাতায়াতে নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও বেশি ভাড়া আদায় করেন চালকেরা, বিশেষ করে বাংলাদেশি পেলে! আরও লক্ষ্য করেছি, বাংলায় ওরা কথা বলে না।

নিরাপদ ও ঝামেলামুক্ত যাতায়াতে কলকাতায় রেল বাহনই সেরা। ৪০ দিন আগে থেকে ওডিশার পুরীগামী সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন বন্দে ভারত এক্সপ্রেসে টিকিট কাটা ছিল অনলাইনে। ২২ জুলাই ভোর ছয়টায় ট্রেন ছাড়বে। ভুবনেশ্বরের উদ্দেশে যাত্রা। টালিগঞ্জ থেকে হাওড়া নতুন ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম পৌঁছে গেছি ভোর পাঁচটায়। চালক সঠিক ভাড়া নিল। কিন্তু বড় ধরনের ধাক্কা খেলাম হাওড়া স্টেশনের ট্রলিওয়ালা কুলির কাছ থেকে। হিন্দি বলতে পারি না! সত্তরের ওপরে বয়স্ক লাল গেরুয়া বসনের কুলির সরদার হিন্দিতে ৫টি লাগেজের জন্য ১ হাচার ৫০০ রুপি দাবি করে বসল। নতুন জায়গা। গিন্নি ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে রাজি করাল ৮০০ রুপিতে, যা কিনা বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ট্রেনের আরামদায়ক একটি চেয়ার কোচ আসনের ভাড়ার চেয়ে ৪০০ রুপি বেশি! ১৮ নম্বর প্ল্যাটফর্ম যেতে সময় লাগল মাত্র ৬ মিনিট। গাড়িতে যাত্রী আসনের নির্ধারিত জায়গায় মালামাল তুলে দেওয়ার পর যুবক কুলি ৫০০ রুপির ২টি নোট দিলে সে আর বাকি অর্থ ফেরত দিল না। বরং একটা গালি উপহার পেলাম মনে হলো!

সম্পূর্ণ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বন্দে ভারত নির্ধারিত সময়েই হাওড়া থেকে পুরী অভিমুখে যাত্রা করল। বেশ পরিষ্কার ট্রেনটি। আছে কিছুক্ষণ পরপর নানা খাবারের বাহার। স্ত্রী, কন্যা ও পুত্র পাশাপাশি তিন আসনের ডান দিকে। আমার পাশের আসনে সহযাত্রী শুভাশিস দাস। বালেশ্বর স্টেশনে এসে পরিচয়। যাবেন কটক। ভদ্রলোক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। দাদুর বাড়ি একসময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছিল। আমাকে পেয়ে মনে হলো তিনি বাড়ির মানুষ পেলেন! তিনি থাকেন সুইডেন, জাহাজে। গিন্নি হুগলীর শ্রীরামপুরের শেওড়াফুলি একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। একমাত্র ছেলে স্মার্টফোনে আসক্ত! কলকাতার পড়াশোনার মান একেবারে নেমে গেছে। জানালেন তিনি। তাই ছেলেকে মানসম্পন্ন শিক্ষার অভিপ্রায়ে ভুবনেশ্বরের আবাসিক প্রতিষ্ঠান সাই ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। ছাত্রাবাসে থেকে ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। মাসিক সংগীত প্রতিযোগিতায় তাঁর ছেলের বাজানো গিটারের সুরের ভিডিও ক্লিপ দেখালেন তিনি। বললেন, প্রকৌশল বিষয়ে ভুবনেশ্বরের কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল টেকনোলজি (কেআইআইটি) ভারতের বেশ নামকরা প্রতিষ্ঠান। ‘আপনার মেয়ে সঠিক জায়গায় এসেছে।’ খড়গপুর পার হওয়ার পর ট্রেনে যেতে যেতে দেখলাম ফসলের মাঠ আর মাঠ। আশপাশে মানুষের বসতি নেই।

মন্দিরের রাজধানী বলে খ্যাত ওডিশার ভুবনেশ্বরে ছিলাম চার দিন। রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার এবং সবাই শৃঙ্খলিত। জনগণ খুব আন্তরিক। কলকাতার মতো এখানে বাইক খুব একটা নেই। কেউ ময়লা রাস্তায় ফেলে না। ভেজ আইটেম সস্তা। রাস্তার দোকানগুলোর খাবারের দাম কম এবং তা সুস্বাদু ও জীবাণুমুক্ত।

ওডিশার ভাষা ওডিশি; তা অনেকটা হিন্দির সহজ সংস্করণ। বাংলা ভাষার কাছাকাছি। ভুবনেশ্বরের মানুষ বাংলা বোঝে ভালোভাবেই। কিন্তু অটো ও ট্যাক্সিচালক বাংলাদেশি পেলে চলমান ভাড়ার চেয়ে বেশি আদায় করতে ছাড়ে না, তা প্রমাণ পেলাম। শহরের রাস্তার দুপাশের বিনা ভাড়ায় পার্কিং স্থান বেশ চোখে পড়েছে। পর্যটকবান্ধব হোটেলগুলো। সব শ্রেণির লোকের জন্য থাকা–খাওয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। শহরের পটিয়ায় কেআইআইটি। ২০০ একর জমির ওপর এর বিশাল ক্যাম্পাস। কেআইআইটির সহযোগী প্রতিষ্ঠান কওঝঝ। মানে কলিঙ্গ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্স। এ দুটির প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষাব্রতী প্রফেসর অচ্যুত সামান্তা বেশ দয়ালু ও কর্মঠ সজ্জন মানুষ। তিনি গরিব আদবাসীদের এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস ও কর্মযোগের ব্যবস্থা করেছেন।  শিশুশ্রেণি থেকে মাধ্যমিক স্তরের ৮০ হাজার অনাথ ও অসহায় শিশুকে তিনি বিনা মূল্যে বহন করার দায়িত্ব নিয়েছেন। বাংলাদেশে উচ্চতর শিক্ষায়ও সামান্তার অবদান রয়েছে। কেআইআইটির অভ্যন্তরে সুরম্য ইমারতের পাশে পরিচ্ছন্ন পথের ঘন সবুজ বৃক্ষতল। দৃষ্টিনন্দন ভুবনেশ্বরের পটিয়াও। পথচারী পারাপারের পথ বিঘ্নœনা করে ফুটপাতে সস্তায় দোকানি খাবারসেবা দিচ্ছে। সে–ও অনলাইনের পেটিএম কার্ড ব্যবহার করছে এবং মূল্য নিচ্ছে।

ওডিশার রাজ্যে এসে পুরীর জগন্নাথ মন্দির দর্শন করব না, তা কি হয়? ভুবনেশ্বর থেকে পুরীর দূরত্ব প্রায় ৬৪ কিলোমিটার। এসি বাসে সময় লাগে ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। জনপ্রতি ভাড়া ৬০ থেকে ৮০ রুপি। নন–এসি বাসে ভাড়া ৩০ থেকে ৪০ রুপি। ভুবনেশ্বর কল্পনা স্কয়ার মোড় থেকে একদিন সকালে বাসে চারজন রওনা দিলাম। সকালের হিমেল হাওয়ায় দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম পুরী বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে ইজিবাইকে চড়ে সাত মিনিটে মন্দির পৌঁছাই। খালি পায়ে কোনো দ্রব্য ব্যতীত জগন্নাথ মন্দিরে যেতে হয়। তপ্ত রোদে হাত তুলে ‘জয় জগন্নাথ’ ধ্বনি তুলছে ভক্তরা। ২৭ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন। তল্লাশিরত পুলিশ বাদ সাধল। মুঠোফোন রেখে আসতে হবে। আমার যাওয়া হলো না মন্দিরের ভেতর। মন খারাপ যেমন হলো, তেমনি অচেনা জায়গায় পরিবারের সবাইকে হারানোর আশঙ্কায় শুধু ঘামছি আর ছিটানো জলে খালি পা রাখছি। দুপুরের আহার শেষে এসি বাসে করে ভুবনেশ্বর পুরোনো রেলস্টেশনসংলগ্ন হোটেল গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল। বাসের কন্টাক্টর জনপ্রতি ৬০ টাকা করে নেবে বলে বাসে তুললেও অত্যন্ত দুর্ব্যবহারের সঙ্গে ৪০০ রুপি নিয়ে ছাড়ল।

কেআইআইটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে গিয়ে মেয়ে প্রমিতি মজুমদারের ভর্তির প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করি। মেয়েদের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসে তুলে দিয়ে ২৬ জুলাই দুপুরে কলকাতায় রওনা হব বন্দে ভারত এক্সপ্রেস ট্রেনে। হোটেলে ফিরে তিনজন বিশ্রাম ও স্নান শেষে কাছের রেস্টুরেন্ট সোয়াদিস্ট গিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিই। মালপত্র নিয়ে গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল হোটেল থেকে চেকআউট করি বেলা ২টা ১০ মিনিটে।

রিসেপশনের দায়িত্বে দুর্গা ভৌমিক বেশ আন্তরিক। প্রায় অর্ধেক ভাড়ায় টিভি, ফ্রিজ, ইলেকট্রিক কেটলির ব্যবস্থায় সার্বক্ষণিক ওয়াই–ফাই সুবিধায় আমাদের অত্যাধুনিক বড় কক্ষ দিয়েছেন। তাঁর স্বামী অনির্বাণ ভৌমিকের বাবা ছিলেন আমার জন্মস্থান চাঁদপুরের। হোটেল ত্যাগের সময় তাঁর চোখও ছলছল করছিল।

ট্রেনে বসে মেয়ের একা থাকার কথা যেমন ভাবছিলাম; তেমনি মনে পড়ছিল হোটেল সোয়াদিস্টের ভদ্র ছেলেটির নিষ্পাপ মুখ। যে অমিত শর্মা দুপুররাতে ছয় বেলা হাসিমুখে আমাদের খাবার সরবরাহ করেছেন ভেজ থালি, নুডলস ও এগরোল। রাত আটটায় হাওড়া স্টেশনে নেমে চাকাওয়ালা লাগেজ হাতে নিয়ে বের হচ্ছি। চোখ পড়ল আইআরসিটিসির (ভারতীয় রেল ক্যাটারিং ও পর্যটন নিগম) কুলি ভাড়াসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তির ওপর। পড়ে দেখলাম লোহার ট্রলি করে মালপত্র নিতে একজন কুলির নির্ধারিত মজুরি মাত্র ৩৭ রুপি। বেশ প্রতারিত হয়েছি ভেবে কষ্ট পেয়েছি অনেক।

কলকাতায় এক দিন এক রাত থেকে ২৮ জুলাই ভোরে তিনজন দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে সৌহার্দ্য বাস ধরি। নীরব কলকাতা শহর। বলতে গেলে যানশূন্য। ফাঁকা রাস্তা। ট্রাফিক সিগনালের লালবাতিগুলো মেনে গাড়ি চালাচ্ছে ট্যাক্সিচালক, যা দেশে দেখা যায় না। আমাদের মহাসড়কগুলো তো সিগনাল বাতিই নেই এখন! খারাপ লাগল কলকাতা ভ্রমণে এবার। ওরা বাংলা ভাষাকে আর শ্রদ্ধা করে না। হিন্দি ভাষার দাপটে বাংলা অসহায়। ভ্রমণে কষ্ট পেয়েছি হাওড়া সিটি পুলিশ নিয়ন্ত্রিত প্রিপেইড ট্যাক্সি ভাড়া করতে গিয়ে। হাওড়া থেকে টালিগঞ্জ রিজেন্ট পার্ক ভাড়া ১২৬ রুপি। অথচ পোস্টপেইড ট্যাক্সি ভাড়ায় আমাদের আড়াই থেকে চার গুণ বেশি ভাড়া বহন করতে হয়েছে।

কলকাতার জনগণের চেয়ে আমরা বেশি বন্ধুবৎসল। আমরা বাংলা ভাষাকে বেশি ভালোবাসি, রাজধানীর বাইরে রাস্তাঘাটের আমাদের ব্যাপক উন্নয়ন; মনের উন্নতি হয়নি। আমরা পরিবেশদূষণে ভারতবাসীর চেয়ে এগিয়ে। তবু স্বপ্ন দেখি সুন্দর ও দূষণমুক্ত বাংলাদেশের।

● লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি ও সাংবাদিক