বান্দরবানের লামায় প্রকৃতি পাঠে একদিন

ক্ষমতার দাপট এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব পৃথিবীকে দিন দিন অস্থির করে তুলছে। পৃথিবীর বাসিন্দা হয়েও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পারমাণবিক বোমায় পৃথিবী ধ্বংস করার মতো শক্তি থাকার দাম্ভিকতা প্রকাশ করেন। কখনো নিজে যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া, কখনো অন্যকে যুদ্ধ জড়ানোর ইন্ধন দেওয়া, এভাবেই নিজের শক্তি প্রদর্শনে ব্যস্ত। ন্যাটো কিংবা আমেরিকার ইন্ধনে ইউক্রেন রাশিয়ার সঙ্গে যে যুদ্ধে জড়িয়েছিল, সে যুদ্ধ দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ইসরায়েলের আগ্রাসনে ফিলিস্তিনের গাজা আজ পৃথিবীর একটা বিধ্বস্ত নগরী। সাম্রাজ্য বিস্তার কিংবা রাজনৈতিক বিরোধে মুহূর্তেই লেগে যায় যুদ্ধ। গত মাসে সংঘটিত আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত যুদ্ধের উত্তাপ এখনো চলছে। ওই দিকে গৃহযুদ্ধে নিহত হাজার হাজার লাশ সুদানের রাস্তায় পড়ে থাকার খবর আসে। রাশিয়ান লেখক লিও তলস্তয় বলেছিলেন, ‘যখন তুমি নিজের ব্যথা অনুভব করো, তখন তুমি জীবিত, আর যখন তুমি অন্যের ব্যথা অনুভব করো, তখন তুমি মানুষ।’

অন্যের ব্যথা অনুভব করার মতো মানসিকতা মানুষ দিন দিন হারাতে বসেছে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও বিরাজ করছে অস্থিরতা। মবের সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তুচ্ছ ঘটনায় পিটিয়ে মারছে মানুষ। নদীতে ভেসে আসে কারও প্রিয় মুখের লাশ। যে বৈষম্য দূর করার কথা বলে দেশের একটা সরকার পরিবর্তন করা হয়েছে, এখন সব প্রতিশ্রুতির কবর দিয়ে টিকে আছে শুধু সেই বৈষম্যই।

বিপ্লবী নেতা চে গুয়েভারা বলেছিলেন, ‘অন্যায় থেকে পৃথিবীর আরোগ্য লাভই বিপ্লবের মূলমন্ত্র।’ তিনি আজ নেই, কিন্তু পৃথিবীর আলোচনায় বারবার ফিরে আসে তাঁর বিপ্লবের কথা। বাংলাদেশের বিখ্যাত লেখক আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘বিপ্লবে কপটতার স্থান নেই। বিপ্লব মানে ধ্বংস নই, বিপ্লব মানে পুনর্গঠন।’

পৃথিবীতে আজ পাল্টে গেছে সেই বিপ্লবের সংজ্ঞা। সত্য-মিথ্যার মিশ্রণে ডলার বিনিময়ের সহায়তায় দেশে দেশ তারণ্যের উগ্রতাকে উসকে দেওয়ার নাম দিয়েছে বিপ্লব।

এভাবে টংদোকানের আড্ডায় আলোচনা দীর্ঘ হয়। হঠাৎ ইরফান ভাই বলেন, দীর্ঘ এক বছর আমরা পতেঙ্গার ভ্রমণ গ্রুপ ‘লাঠিয়াল’ দেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় লং ট্যুর স্থগিত রেখেছি। এবার ছুটতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৬ নভেম্বর সকালে সিএনজিচালিত অটোরিকশাযোগে একে একে ১১ জনের সদস্য কর্ণফুলী ব্রিজের বাসস্টেশনে গিয়ে হাজির। বাসস্টেশনের পাশের হোটেলে সকালের নাশতা সেরে আমরা টিকিট কেটে বাসে উঠে বসি। সকাল আটটায় যাত্রা শুরু করে কর্ণফুলী ব্রিজ পেরিয়ে চলতে চলতে পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া অতিক্রম করে চকরিয়ার বাসস্টেশনে গিয়ে থামি। চকরিয়া বাসস্টেশন থেকে সিএনজিযোগে গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে দ্বিতীয় দফায় আমরা চকরিয়ার মানিকপুর পুরোনো বাজারে গিয়ে নামি। বাজারের পাশেই মাতামুহুরী নদীর ঘাট। আমাদের এবারের ভ্রমণের উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দরবানের লামায় অবস্থিত হোয়াইট পিক স্টেশন রিসোর্ট। আগে বুকিং দেওয়ার সুবাদে ফোনে যোগাযোগের মাধ্যমে আগে থেকেই রিসোর্টের নিজস্ব বোট এসে আমাদের রিসিভ করার জন্য ঘাটে হাজির। মাঝির পরামর্শে দ্রুতগতিতে আমরা সবাই বোটে উঠে বসি। শহরের কোলাহল পেরিয়ে গেলেই যেন পাহাড়ের নীরবতা শুরু। দুই পাশে সবুজ পাহাড় আর মাঝখানে ঢেউহীন বয়ে চলা মাতামুহুরী নদী। নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা গ্রামগুলো মানবসভ্যতার আদি ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়।

নদীর পাড়ে বেগুন, ঝিঙে, চিচিঙা থেকে শুরু করে নানান শীতের সবজি চাষে ব্যস্ত স্থানীয় কৃষকের দল। গরু, ছাগলগুলো বিচরণ করছে সবুজ মাঠে। নদীতে উল্লাসে গোসলে মেতে উঠেছে কিশোরের দল। আমাদের টিমের সবাই ক্যামেরা হাতে স্মৃতিগুলো ফ্রেমবন্দী করতে ব্যস্ত হয়ে গেছে। চলতে চলতে প্রায় ৪৫ মিনিটে আমরা পৌঁছে গেলাম মূল গন্তব্যে। নদীর পাড়ে উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট টিলায় সাজানো হয়েছে হোয়াইট পিক স্টেশন নামের এই রিসোর্ট।

বোট থেকে নেমেই রিসোর্টের ম্যানেজারের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত জুমঘরে ব্যাগগুলো রেখে সবাই ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। ইতিমধ্যে মিসবাহ ভাই পাশের টংদোকানে চা, কলার অর্ডার দিয়ে সবাইকে ডাক দেয়। বড় এক কাঁঠালগাছের নিচে বাঁশের মাচায় বসার স্থানটি অসাধারণ। সেখানে বসেই আড্ডা দেওয়ার ঘণ্টাখানেক পরই দুপুরের খাবার নিয়ে আসে। গোল করে কাঁঠালগাছের ছায়ায় বসে ডাল, আলু ভর্তা ও দেশি মুরগির মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার শেষে আমরা নিজেদের কটেজের সঙ্গে উঁচু বাঁশের মাচায় বসি।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

দুপাশে উঁচু সবুজ পাহাড়, মাঝখানে নদী—প্রকৃতির এমন সাজ যে কাউকে পাগল করে ছাড়বে। গিটার হাতে মিসবাহ ও সুমন ভাইয়ের আঞ্চলিক গানের সুরে ঢাকা থেকে আগত সাইফুল ভাইয়েরা এসে গোল করে বসে আসর জমিয়ে তুলেছে...

‘আশা আছিল তোয়ারে লই

বাইন্দম একখান সুখের ঘর

সুখের বদল আঁরে দুঃখ দিলা

হোন হারণে ভালোবাসার দাম নো দিলা।’

একের পর এক আঞ্চলিক গানের তর্জমা বুঝিয়ে দিলে তারা হাসিতে ফেটে পড়ে। এবার ইরফান ভাইকে বিকেলে যাত্রার কথা মনে করিয়ে দিলাম। নতুন কোনো জায়গায় গেলে স্থানীয় বাজারে ঘুরে আসা লাঠিয়ালদের পুরোনো অভ্যাস। কারণ, বাজারে গেলেই বোঝা যায় সেই অঞ্চলের সংস্কৃতি। স্থানীয়দের আচার-আচরণ, তারা কী খায়, কী পরে—সবকিছু বাজারেই ফুটে ওঠে। মাঝিকে ফোন করে সবাই আবার বোটে চড়ে বসি। উদ্দেশ্য বান্দরবানের লামা বাজার। মাতামুহুরী নদীর উজান বেয়ে চলছে আমাদের ইঞ্জিনচালিত বোট।

দুপাশে পাহাড়ের সবুজ বনের গাছের ঢালে ছুটতে থাকা হনুমান এবং বানরের দল দেখে ছাত্রজীবনে পড়া সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা প্রবাদটি মনে পড়ে গেল, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’।

জীবমাত্রই তার স্বাভাবিক পরিবেশে সুন্দর থাকে। মানুষের ছোঁয়ায় খাঁচায় বন্দী বানরের চেয়ে এগুলো অনেক সুন্দর ও সুস্থ–সবল দেখাচ্ছে। বানর ও হনুমান দেখে খুশিতে মিন্টু ভাইয়ের সে কী উল্লাস। মোবাইল বের করে ভিডিও করার আগেই তারা দ্রুতগতিতে এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে বনের গভীরে চলে যায়। কিছু পথ এগিয়ে গেলেই নদীর কূলে পাহাড় ঘেঁষে আরও সুন্দর সুন্দর রিসোর্ট চোখে পড়ে। আমরা যখন বাজারের ঘাটে পৌঁছাই, তখন প্রায় সন্ধ্যা। ঘাটের পাশে বড় গাছে ঘরে ফেরা পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ। পূর্ণিমার দিন কেন্দ্র করে উপজাতি এক বৃদ্ধ নদীর কিনারায় মোমবাতি জ্বালিয়ে পূজা করছেন। আমরা বোট থেকে নেমে বাজারে প্রবেশ করি। এখানে মূলত বাজারবার শনি ও মঙ্গলবারেই জমে ওঠে। বৃহস্পতিবার হওয়ার কিছুটা চাপ কম। বাজারের দক্ষিণে স্কুল, তার পাশেই স্থাপিত হয়েছে নতুন মডেল মসজিদ। বিশাল এলাকাজুড়ে বাজার। আমরা ঘুরতে ঘুরতে এক দোকানদারকে গরুর দুধের চায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বাজারের উত্তর পাশে জসিম ভাইয়ের টংদোকানের সন্ধান দিলেন। সবাই জসিম ভাইয়ের দোকানের ছানায় ভরা গরুর দুধের চা পান করে আবার বোটে উঠে রওনা হই। সন্ধ্যে সাতটায় আমরা রিসোর্ট এসে পৌঁছাই। তারা আমাদের জন্য বুট ভাজায় মিশ্রিত ঝালমুড়ি তৈরি করে রাখে। ঝালমুড়ি ও চায়ের পর্ব শেষে মিন্টু, দেলোয়ার, তালেব ভাই ও ভাগিনা আরজুর সঙ্গে দীর্ঘদিন পর ক্যারম খেলায় মেতে উঠি। রেড খাওয়ার প্রতিযোগিতায় পয়েন্ট কম দেওয়ার কৌশলে খেলার মেয়াদ দীর্ঘ হতে থাকে।

রাত সাড়ে ১১টায় রিসোর্ট বয় খাবার রেডি করে সবাইকে ডাক দেয়। হাঁসের মাংসের সঙ্গে ভর্তা, ডাল দিয়ে রাতের খাবার শেষে সবাই বাঁশের মাচায় বসে মিসবাহ ভাইয়ের সঙ্গে গানে সুর তুলে। হাসন রাজার ‘লোকে বলে বলে রে / ঘর বাড়ি ভালা না আমার’ থেকে শুরু করে লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি/ কেমনে আসে যায়’ গানে গানে আসর জমে ওঠে। রাতের নীরবতায় সুমন ভাইয়ের কণ্ঠে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘অমলকান্তি’ কবিতার আবৃত্তি শুনে জীবন বাস্তবতার গভীর স্মৃতিতে ডুবে গেলাম।

রাত প্রায় দুইটা, সবাই জুমঘরে আয়েশের ঘুম দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। আমি, ভাগিনা আরজু, মিসবাহ ভাই বাইরে বাঁশের মাচায় বিছানা তৈরি করি। সারা দিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় পূর্ণিমার রাতেও এতক্ষণ চাঁদ যেন লজ্জায় লুকিয়ে ছিল। কিন্তু রাত তিনটার পর আকাশ পরিষ্কার হয়ে চাঁদের আলোয় পাহাড়ের সবুজ অরণ্যের পাতায় আলোর ঝিলিমিলি ফুটে ওঠে। মাতামুহুরী নদীতে ডিঙিনৌকায় বসে থাকা মাছশিকারিকে স্পষ্ট দেখা যায়। চারদিকে নীরবতা, সে এক অন্য রকম পরিবেশ। মহিউদ্দিন মামা, দেলোয়ার, ইরফান ও মিন্টু ভাইদের নাকডাকার শব্দ ভাগিনা আরজু মুঠোফোনে রেকর্ড করছে। শীতের হালকা অনুভবে চাদর জড়িয়ে মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে ঘুম থেকে উঠে উঁচু পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে জোঁকের আক্রমণে কেউ কেউ রক্তাক্ত হয়ে ফিরে এসে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে মাচায় বসি। রিসোর্টের সকালের মেনুর খিচুড়ি খেয়ে সবাই তৈরি। আজ প্রচণ্ড রোদে কিছুটা গরম অনুভব হলেও পরিবেশটা দেখতে খুব সুন্দর। বোটের মাঝির ডাকে সম্মতি দিয়ে আমরা উঠে বসি। পাহাড়ি বাঁশ বোঝাইয়ের ওপর বসে স্রোতের অনুকূল ভেসে বিক্রির জন্য দূর ঠিকানায় রওনা হয়েছে কিছু লোক। শুক্রবার হওয়ায় একের পর এক পর্যটকের দল বোট নিয়ে আসছে। প্রচণ্ড রোদে পাহাড়ের সবুজ সাজ অবলোকন করতে করতে আমরা মানিকপুর পুরোনো বাজার ঘাটে নামি। ঘাট থেকে টমটমযোগে চকরিয়া বাসস্টেশনে আসতেই দুপুর ১২টা। রাস্তার পশ্চিম পাশে সাম্পান রেস্তারাঁয় ব্যাগ রেখে পাশের মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যাই। নামাজের পর সেই রেস্তারাঁয় দুপুরের খাবার শেষে স্টেশন থেকে বাসে রওনা হই প্রাণের শহর চট্টগ্রামে ফেরার আশায়।