পাঁচগাঁও, এক পাহাড়ি গাঁওয়ের গল্প

বসন্তের নরম রোদ সবে প্রখর হতে শুরু করেছে সকালটায়। আমরা দুই চাকার যানে চেপে বেরিয়ে পড়লাম আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশে। পাহাড় বরাবরই আমাকে টানে। অনেক দিন ধরে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও সেটা কোনোভাবেই বাস্তবায়িত হচ্ছিল না। ২৯ ফেব্রুয়ারি, সকালে এক বন্ধুকে বললাম, ‘ঘুরতে যাব, কিছু টাকা লাগবে। যদি দেস তাহলে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ব।’ আশ্বাস দিল। আর কে আটকায়। নেত্রকোনা শহর থেকে মাত্র ৪৩ কিলোমিটার উত্তরে গেলেই গন্তব্য, ছায়াঘেরা সবুজ পাহাড়ি গাঁও। এত দিন শুধু যার গল্প শুনে আসছি। এবার সুযোগ এসেছে নিজ চোখে দেখার।

নেত্রকোনা থেকে রাস্তা ভালো হওয়ায় সাঁই সাঁই করে দ্বিচক্রযান ছুটে চলল কলমাকান্দার সীমান্ত গ্রামের দিকে। যেতে যেতে হামেশাই দেখা মিলেছে রক্তিম শিমুলের। সূর্যের আলোতে সেগুলো যেন আরও লালাভ হয়ে ফুটে উঠেছে। রাস্তার দুই ধারে বিস্তীর্ণ সবুজ ধানখেত। কলমাকান্দা বাজারের ভেতরে ঢুকে একজনকে জায়গার নাম বলতেই হাত বাঁকিয়ে বলল, ‘সোজা এদিকে যাবেন, রাস্তাই আপনাকে নিয়ে যাবে।’ রাস্তার পাশে থাকা ছোট মাইলফলকে ১১ কিলোমিটার দেখালেও এইটুকু জায়গা যে ভোগাবে কিছুটা, সেটা রাস্তা দেখেই বোঝা গেছে। পথের আরাম শেষ করে এবার একটু শক্ত করেই গাড়িতে ধরে বসতে হলো।

বাজারের নাম ভায়রাকান্দা। সেখানে এসে চোখ একটু কপালে উঠল বৈকি। এত দিন চোরাই চিনির যে গল্প শুনে আসছিলাম, সেটা এখন নিজের চোখে দেখছি। হ্যাংলা পাতলা প্লাটিনা মোটরসাইকেলে করে বস্তায় বস্তায় আমাদের যাত্রাপথের রাস্তা থেকে আসছে চিনি। গুনতে গুনতে বিশ-পঁচিশেক গাড়ি গুনে ফেললাম মনে মনে। প্রতি গাড়িতে তিনটি করে বস্তা বাঁধা দড়ি দিয়ে শক্ত করে। ‘ম্যাড ম্যাক্স ফুরি রোড’ সিনেমার দৃশ্য যেন; দ্রুত বেগে ছুটে আসছে, ছুটে যাচ্ছে গাড়িগুলো। চালকদের চোখেমুখে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে চাপা উল্লাস। যেন আজ তাঁদেরই দিন। এঁদের নিয়ে গল্প প্রচলিত আছে যে গাড়ি কাগজবিহীন। সীমান্তে ধরা পড়ার আশঙ্কা থাকলে পাহাড়ের ওপর থেকে গাড়ি ফেলেই পালিয়ে আসেন।

ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা এগোতে লাগলাম সামনের দিকে। গাড়ির চাকা ঘুরে পথের দূরত্ব কমার সঙ্গে সঙ্গে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো দৃশ্যমান হতে থাকল চোখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্তব্যে চলে এলাম, সীমান্ত পাহাড়ের সেই গাঁও। পাহাড়ের আরও কাছে যেতে আমরা গাড়ি নিয়ে ভুল রাস্তায় ঢুকে পড়লাম। পাকা রাস্তা ছেড়ে মাটির রাস্তা ধরে সীমান্তের কাছাকাছি। একেবারে নীরব-নির্জন জায়গা। মিনিট পাঁচেকের দূরত্বে সীমান্তের কাঁটাতার দেখা যাচ্ছে। কোনো সীমান্তরক্ষীকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না কোনো পাশে। কাউকে যে জিজ্ঞেস করব, সে উপায়ও নেই। দুপুরের রোদ তখন মাথার ওপর। ঝিরিপথে আসা ঝরনার পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নির্জন সৌন্দর্য উপভোগ করছি পাহাড়ের। অন্য পাশে বিস্তীর্ণ ভূমি। এখানে যেন কোথাও কেউ নেই। সেখানে দাঁড়িয়ে দৃশ্য দেখে আমার কাছে মনে হলো, পাঁচগাঁও কবিতার গাঁও, চুপচাপ বসে পাহাড় দেখার গাঁও।  

একটা পাতাঝরা মৃতপ্রায় রেইনট্রিগাছের নিচে বসলাম কিছুক্ষণ। সবকিছু যেন ছবির মতো। নিশ্চুপ চারপাশ। নির্জনতা ভাবাচ্ছিল আমাদের। আমরা কি ভুল জায়গায় এসেছি নাকি, বুঝতেও পারছিলাম না। একটু ভয় ভয়ও লাগছিল। দূর থেকে দুটি ছোট ছেলে এদিকেই আসছিল। রাখাল হবে হয়তো। আমরা তাদের জন্য অপেক্ষা করলাম। তাদের জিজ্ঞেস করার পর তারা আরও রোমহর্ষক তথ্য দিল। একেবারে সীমান্তের কাছেই নাকি একটা ঝরনা আছে ছোট। কাঁটাতারের পাশ ঘেঁষে যেতে হয়। এ সময়ে কেউ থাকে না। তবে সীমান্তরক্ষীরা থাকলে দৌড়ানি খেতে হয়। কথা বলতে যে তারা খুব আগ্রহী না, সেটা মুখ দেখেই বোঝা গেল। সেখান থেকে বেরিয়ে আমরা আবার মেইন রাস্তায় উঠলাম।

ছবি : লেখক

একজন স্থানীয় পথচারীর সাহায্য নিলাম আবার, চন্দ্রডিঙ্গা যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য। এবারে বুঝতে পারলাম আমাদের ভুল হচ্ছিল কেন বারবার। ব্রিজের একেবারে কিনারা ঘেঁষে রাস্তাটা নেমেছে নিচের দিকে। যেটা আমাদের চোখ এড়াচ্ছিল বারবার। সেখানে নির্দিষ্ট স্থানে মোটরসাইকেল রেখে আমরা পাহাড়ের ভেতরের দিকে যেতে থাকলাম। কথিত আছে, মনসার রোষানলে চাঁদ সওদাগরের হারানো সপ্তডিঙ্গার নামে পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে ‘চন্দ্রডিঙ্গা’। পাহাড়ের পাদদেশে বাস করা ম্রো জাতিগোষ্ঠীর কয়েকজনকে দেখলাম, পাহাড় থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করছেন। সেখানকার দোকানগুলোও তাঁরাই চালাচ্ছেন।

পাহাড়ি ঝিরিপথ দিয়ে যতই ভেতরে যাচ্ছিলাম, পাহাড় যেন আপন করে নিচ্ছিল। ছোট-বড় পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে ওপরের দিকে যেতে যেতে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। দুই পাশে যেন ঘন সবুজের ছাউনি। ওই দিকে সীমান্তের ওপার হাতছানি দিয়ে ডাকছিল ভারতের মেঘালয়। ঝিরি দিয়ে আসা ঝরনার শীতল পানিতে হাতমুখ ধুয়ে ক্লান্তি মেটাচ্ছিল অনেকেই। খুব বেশি রিস্ক না থাকলেও কিছু কিছু জায়গায় বেশ কষ্ট করেই উঠতে হয়েছে। ছিল পিছলে পড়ার ভয়। একটু থ্রিল, একটু রিস্ক আর মায়াভরা নয়নাভিরাম সবুজ—এটাই তো পাহাড়ের সৌন্দর্য। তবে আমার কাছে গাঁয়ের রাস্তা ধরে কিছুটা দূর থেকে দেখা পাহাড়ের সৌন্দর্য বেশি নজর কেড়েছে। আমি আবার কখনো গেলে মাদুর পেতে সেখানে ঘুমানোর ইচ্ছা আছে।

ফেরার পথে একটা স্থানীয় দোকানে কেনাকাটা করতে গিয়ে দোকানদারের সঙ্গে আলাপ হয়। পানি খেতে চাওয়াতে আন্তরিকতার সঙ্গে পানি এনে দেন। আলাপের ফাঁকে পাহাড়ের এদিকে থাকা বটগাছটার ব্যাপারে চমকপ্রদ তথ্য উঠে আসে একটা। বর্তমানে যে গাছটা আছে, সেটা নাকি মূল গাছ না। মূল গাছ অনেক আগেই কাটা হয়েছিল এবং যে এগারো জনে মিলে কেটেছিলেন, তাঁরা নানা রকম রোগে ভোগে সবাই মারা গিয়েছিলেন কিছুদিন পরই। যাঁরা এটাকে পূজা করতেন, তাঁদের অভিশাপ বলে ধরা হয়। তবে তিনি নিজের চোখে দেখেননি, সেটাও অকপটে স্বীকার করেছেন। তিনিও শুনে এসেছেন এ ঘটনা।

বিকেলের দিকে রোদ পড়তে শুরু করে। আমরা আবার গাড়িতে চেপে বসি। পেছনে ফেলে আসি রংছাতি ইউনিয়নের সেই সীমান্তবর্তী গাঁও, নিয়ে আসি কিছু নতুন গল্প।

লেখক: সৌরভ আহমেদ, ফ্রিল্যান্স রাইটার, সদর, নেত্রকোনা

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]