শ্রীমঙ্গলে প্রাচীন গিরিখাতে একদিন

গিরিখাত দেখার জন্য এ বছরের ৫ তারিখ আমরা পাঁচজন (আমি, সৌরভ, পাপ্পু, রুবেল ও পাপন) রওনা হলাম শ্রীমঙ্গল শহর থেকে গিরিখাতের উদ্দেশে। কুয়াশা ভেদ করে বেরিয়ে পড়ি সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের দিকে। সকাল ৯টা বাজে, সূর্যের দেখা নেই। কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে সবকিছু। কনকনে শীতল বাতাস বইছে। ভানুগাছ রোডে পানশি রেস্টুরেন্টে এসে সকালের নাশতা করে পাঁচজনের জন্য চিকেন বিরিয়ানি, খাবার জল, কমলাসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিয়ে নিলাম। একটি কথা বলে রাখি, গিরিখাতে যাওয়ার জন্য জিপগাড়ি নিতে হবে, নয়তো বাইক। আমরা তিনটি বাইক নিয়ে রওনা হলাম বিটিআরআই হয়ে চা–বাগানের ভেতর দিয়ে।

বাইক চলছে। বাগানের রাস্তায় যেতে হবে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে গিরিখাতে। রাস্তার দুই পাশে শুধু চা–গাছ আর সবুজের সমাহার। যতদূর চোখ যাবে, শুধু সবুজের হাতছানি। শীতের একটু আমেজ উপভোগ করতে করতে চলে এলাম হরিণছড়া বাগানের কাছে।

হরিণছড়ার গলফ মাঠের পূর্ব দিকের বাঁয়ে মোড় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই দেখা পেলাম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। সামনে গিয়ে একটু চমকে গেলাম। চারদিকে গভীর জঙ্গল আর জঙ্গল। আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু দুর্গম পাহাড়ি পথ, পাহাড়ের বুক চিরে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে পুঞ্জির আদিবাসীদের যাতায়াতের জন্য। এ যেন এক নৈসর্গিক স্বর্গ!

সমতল থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় শ ফুট ওপরে উঠতে হবে আমাদের ১ নম্বর নাহারপুঞ্জিতে। একজন করে বাইক নিয়ে দুর্গম পাহাড়ের ওপরে উঠছে। কারণ, দুজন একসঙ্গে বাইকে ওপরে ওঠা যাবে না, এতই ভয়ংকর আঁকাবাঁকা রাস্তা। পাপ্পু ভাই আর আমি হেঁটে পাহাড়ের ওপরে উঠতে লাগলাম। কাঁচা রাস্তা, পিচ্ছিল। সামান্য একটু এদিক–সেদিক হলে ঘটে যেতে পারে বিপদ। উঁচু পাহাড় বেয়ে উঠতে দেখতে পেলাম চা-গাছ আর লেবুবাগান। একেবারে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তে আমরা। ত্রিপুরার বিএসএফের ক্যাম্প দেখা যাচ্ছে নাহারপুঞ্জিতে ওঠার পর। পুঞ্জির কাছেই সীমান্ত পিলার ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিএসএফের ক্যাম্প। পুঞ্জিতে বাইক রেখে, সুজাপুঞ্জির শেষ মাথায় গিয়ে ছড়ায় নেমে গেলাম। পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে ছড়ায় নামার জন্য। খুবই সাবধানে নামতে হয়েছে আমাদের। আমরা ছড়া দিয়ে হাঁটছি আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করছি। ছড়া এতই আকর্ষণীয় যে, এর জল খুবই স্বচ্ছ টলমলে।

পরিষ্কার জলে ছোট ছোট মাছ দেখা যাচ্ছে। ছড়ানো–ছিটানো ছোটবড় পাথর। আহ্‌! কী মনোরম নির্জন পরিবেশ, দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, মন ভরে যায়।

এই গিরিখাতের পথে বিভিন্ন পোকাসহ জীবজন্তুও রয়েছে, ভয় রয়েছে সাপেরও। চারদিকে সুনসান নীরবতা, কানে আসছে ঝিঁঝির ডাক। আর ছড়ার তলদেশে পায়ের নিচে একসময় বালুর পরিবর্তে পাওয়া যাচ্ছে পাথর। বিভিন্ন স্থানে ছড়ার ওপর মরা গাছও পড়ে আছে। কোথাও কোথাও গাছের অংশ পানিতে থাকতে থাকতে ফসিল হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে শোনা যায় পাখির ডাক। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আধা ঘণ্টা বা ৪০ মিনিট যাওয়ার পর দেখা মিলবে নিসর্গ গিরিখাতের। আর ১ নম্বর নাহার খাসিয়াপুঞ্জি হয়ে গেলে সাত-আট মিনিটে পৌঁছে যাওয়া যায় গিরিখাতে। ছড়ার ঢালের দিকে প্রবহমান পানি। কোথাও কোথাও পানি প্রবাহের কারণে পাহাড়ের গায়ে পাথরের কারুকাজের সৃষ্টি হয়েছে। ঘন জঙ্গলের কারণে সূর্যের আলো নিচে না আসায় জায়গাটি দিনের বেলায়ও বেশ অন্ধকার। সেখানে জীবজন্তু ও সাপের ভয়ের চেয়ে বড় ভয় হলো, যেকোনো সময় ওপর থেকে পানির প্রবাহ নেমে আসতে পারে। আর তখন দ্রুত উপরে না উঠতে পারলে নিশ্চিত বিপদ।

আমরা পৌঁছে গেলাম শত বছরের প্রাচীন গিরিখাতের কাছে। ছড়ার বাঁ দিকে থাকলেই স্পষ্ট দেখা যায় গিরিখাত। গিরিখাত বেশি বড় নয়, তাই এর নাম ন্যানো গিরিখাত। যাঁরা এ স্বর্গোদ্যানের সন্ধান পেয়েছেন, তাঁরা যাচ্ছেন।

গিরিখাতে প্রবেশ করে দেখা পেলাম ঝরনার। ছোট কয়েকটি ঝরনা রয়েছে। গিরিখাতে অনেক ছবি ওঠালাম, ঝরনার জলে স্নান করে নিলাম। তারপর দুপুরের খাবার খেলাম বেলা ৩টায়। মধ্যাহ্নভোজ শেষে চা-বাগানে কিছু ছবি তুলে শ্রীমঙ্গল চলে এলাম গোধূলি লগ্নে। ফেরার পথে দেখতে পেলাম, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে অসংখ্য টিয়া পাখি।
এ গিরিখাতের অবস্থান শ্রীমঙ্গল শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে ভারতের ত্রিপুরার সীমান্তবর্তী সিন্দুরখান ইউনিয়নের ঘন জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকায়।

কাছাকাছি কয়েকটি আদিবাসী খাসিয়াপুঞ্জি ও চা–বাগান। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে জিপ বা মোটরসাইকেল নিয়ে পুঞ্জি বা চা–বাগান পর্যন্ত, পরে কয়েক কিলোমিটার হাঁটার যে পথ, তার পুরোটাই পাহাড়ি ছড়া ও জঙ্গলাকীর্ণ খাড়া পাহাড় বেয়ে যেতে হবে।

*লেখক: সমীরণ দাশ, সম্পাদক মৌচাক সাহিত্য পত্রিকা