সিলেটের পর্যটন সমস্যা ও সম্ভাবনা
সম্প্রতি গিয়েছিলাম বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম এবং নিকটতম সীমান্তবর্তী দেশ ভারতের কয়েকটি প্রদেশে। ডাউকি সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে সামনে এগোতেই চোখে পড়ে নান্দনিক সব ব্রিজ। কোনোটা শুধু পাথর দিয়ে তৈরি, কোনোটা শুধু আগাছা দিয়ে তৈরিসহ আরও অনেক। পানির নহর শুধু পানি পড়ছে গতিবেগে, এ রকম প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য ডজনখানেক বারই দেখলাম। দেশে এ রকম দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারা আমরা অজান্তেই হত্যা করছি। নবরূপে আর গড়ে তুলতে পারছি না।
গাছগাছালি আর সবুজের সমারোহে পাহাড়ের কুলঘেঁষে দীর্ঘ রাস্তা পাড়ি দিয়ে গন্তব্য চেরাপুঞ্জি। রাতযাপন ওখানেই। আমাদের পার্শ্বববর্তী দেশ হলেও খাবারের মেনুতে ভিন্নতার কমতি দেখিনি। যাতায়াত, পরিবহন, রাস্তাঘাট বেশ নজর কেড়েছে। ভারতের সরকার, প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাধুবাদ। ভারতীয় আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তনশীল। বৈরী আবহাওয়ায় ‘সেভেন সিস্টার্স’–এর সৌন্দর্য ভালো করে দেখতে পারিনি। পাথর কেটে দেয়াল তৈরি ওখানকার আলাদা আরেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। শিলং পৌঁছে দেখলাম অন্য আরেক জগৎ। বাঙালি সংস্কৃতি বেশ চর্চা করা হয়। সিলেটি কথাবার্তা দিয়ে মোটামুটি প্রয়োজন সারা যায়। পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের চেয়ে ভারত অনেক এগিয়ে আছে বলে মনে করি। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ করে বলি সিলেটের এ শিল্পে নজর বাড়ালে আমরা যেমন উপকৃত হব, দেশ তার চেয়ে বেশি উপকৃত হবে।
বিশ্বের যেকোনো দেশের লোক ভ্রমণে এলেই মন্তব্য করেন বাংলাদেশ একটি সুন্দর দেশ। সুজলা সুফলা বাংলাদেশে মানবসম্পদ থেকে শুরু করে অনেক রকম উপায় উপরকরণ রয়েছে, যা পৃথিবীতে অনেক দেশেই নেই। বিদেশিরা বাংলাদেশের সৌন্দর্য দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। বিশেষ করে সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবার চোখ কেড়ে নেয়। সিলেটের পর্যটন স্থানগুলোর প্রতি সবার আলাদা আকর্ষণ আছে। বিষয়টি ইতিহাস থেকে একটু বুঝিয়ে বলি। বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ১৩৪৬ সালে সিলেট ভ্রমণ করেন। তিনি হজরত শাহজালালের (রহ.) সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সিলেট এসেছিলেন। তিনি তাঁর মন্তব্যে বলেন, সিলেট ভ্রমণ না করা পর্যন্ত আমার ভারত ভ্রমণ শেষ হলো বলে মনে করি না। সিলেটে পর্যটনের অনেক সম্ভাবনা আছে। আসুন, এ বিষয়ে একটু কথা বলি।
হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর দরগাহ কমপ্লেক্সটি সিলেট শহরের উত্তর দিকে পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। শাহজালালের দরগাহটি উঁচু ঢিবির ওপরে তৈরি। শাহজালালের মসজিদটি ১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি। এ মসজিদে একটি গেটের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। প্রবেশ পথসংবলিত এই পাকা ভবনটি ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ভবনে বহুধাপযুক্ত সিড়ি পথ সংযুক্ত এবং একটি প্রশস্ত প্ল্যাটফর্ম মঞ্চে গিয়ে সমাপ্ত হয়েছে। এর সম্মুখের কেন্দ্রীয় হলঘর এবং এ হলঘরের মধ্য দিয়ে প্রার্থনাকারীরা শাহজালালের (রহ.) দরগাহতে যান। এখানে অপরিসর প্রার্থনার স্থানসহ প্রবেশটি জন উইলিস (১৭৮৯—৯৩ খ্রি.) নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়। শাহজালালের দরগাহ মহল্লায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য ইমারত বড় গম্বুজ। এ স্থাপত্য ইমারতটি বর্গাকার এক গম্বুজবিশিষ্ট এবং এটি ফৌজদার ফরহাদ খান ১০৮৮ হিজরি নির্মাণ করেন। বড় গম্বুজের চার কোণে চারটি পার্শ বুরুজ এবং খিলানে সৃষ্টি প্রবেশপথ আছে।
শাহজালের মাজারকে প্রধান উপলক্ষ করে ভ্রমণে এলেও সমস্যার শেষ নেই। প্রধান সমস্যা হচ্ছে গাড়ি পার্কিং। গাড়ি পার্কিংয়ের পর্যাপ্ত জায়গা নেই বলে ভ্রমণকারী শহরের বাইরে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে অথবা রিকশাযোগে অত্যন্ত কষ্ট করে মাজারে যেতে হয়। আবাসিক হোটেল আছে কিন্তু সংখ্যায় খুব নগণ্য। তা ছাড়া মাজারের নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রায় সবাই সন্দিহান। উপর্যুক্ত সমস্যাগুলোর সমাধান সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে শাহপরাণ মাজারে আবাসিক সমস্যা প্রকট ছিল। কিন্তু সম্প্রতি থ্রি–স্টারসম্পন্ন হোটেলের যাত্রা শুরু হওয়াতে এ সমস্যার সমাধান অনেকটাই হয়েছে বলা যায়। আর তেমন উল্লেখযোগ্য সমস্যা নজরে পড়েনি।
পর্যটকদের জন্য জাফলং দর্শনীয় স্থান। জাফলং-তামাবিলকে পর্যটকদের স্বর্গরাজ্য বলা হয়। দূরত্ব সিলেট থেকে ৬২ কিলোমিটার। অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে খাসিয়া পাহাড়ে কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে জাফলং। পিয়াইন আর সারী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে পাথরের সাম্রাজ্য। চারদিকে শুধু পাথর আর পাথর। পাথরের গাঁ দুয়ে পাহাড়ি নদীর বয়ে যাওয়া লোভনীয় দৃশ্য। জাফলংয়ের খাসিয়াপুঞ্জির পথে পথে রয়েছে অসংখ্য দৃশ্যনীয় জায়গা। উঁচু–নিচু পথ বেয়ে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন আপনার পছন্দসই স্পটে। জাফলংয়ের কমলা খেতে নীল পাহাড়ে যাওয়া যায়। সবুজ উপত্যকা। সাপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া নদী এবং ভিন্ন প্রজাতীর পাখি চোখে পড়বে বারবার। খাসিয়াদের পুঞ্জি ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পারবেন চা–বাগানে ফাঁকে ফাঁকে কমলাবাগান, কাঠালের গাছ, আনারস, কলা, লেবুর বাগান। পাহাড়ের পাদদেশে গাছগুলো লাইন করে দাঁড়ানোর দৃশ্য দেখে সবাই পুলকিত হন। জাফলংয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। পর্যাপ্ত আবাসনব্যবস্থা না থাকায় পর্যটকদের দারুন অনীহা। পাথর তোলা হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে। যততত্র স্টোন ক্রাসার মেশিন বসিয়ে শব্দদূষণ করায় পর্যটকেরা অতিষ্ঠ। পয়ঃনিষ্কাশনের সুব্যবস্থা না থাকায় সর্বত্র অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে। নয়নাভিরাম নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড এলাকা ঘুরে দেখা গেছে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিনষ্ট, পর্যটন করপোরেশনের অযত্ন, জলপ্রপাতের ওপর বাঁধ দিয়ে ঝরনার পানির স্রোত কমানোসহ নানা অপকর্ম।
মাধবকুণ্ড জলপ্রাপাত
আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে মাধবকুণ্ড জলপ্রাপাত সবার কাছে প্রশংসার দাবিদার। বড়লেখার কাঁঠালতলা পয়েন্ট থেকে মাধবকুণ্ড জলাপ্রপাতের সেই পাহাড়ের আসল নাম ‘আদম আইল’। পাথারিয়া পাথর নামে খ্যাত। আয়তন প্রায় ১১ বর্গকিলোমিটার। মৌলভীবাজার জেলা ও ভারতের আসাম রাজ্যের মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই পাহাড়। মাধবকুণ্ডে দেখবেন পাহাড়, অরণ্য বিশাল পাথরের পাহাড়। জলপ্রপাত থেকে অবিশ্রান্তভাবে পানি ঝরছে, তা দেখে শুধু তাকিয়ে থাকার নয়, আশ্চর্যও হবেন। আম, কাঁঠাল, আনারস আর চা–বাগান। চা–বাগানে বেষ্টিত কুণ্ডের খাঁচে বড় বড় পাথর। পাথর পেরিয়ে ঝরনার পানি হাতে নিতে পারেন। দেশের অন্যতম পিকনিক স্পট মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত এখন দেশি বিদেশি পর্যটকদের কাছে সুপরিচিত। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বর্তমান সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও তা বাস্তবায়নে কচ্ছপগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এখানে ইকো পার্কের প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করে দিলে পর্যটন মৌসুমে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক পুলিশি ব্যবস্থা নিলে মাধবকুণ্ডের বিদেশি পর্যটকদের উপস্থিতিও বৃদ্ধি পাবে। মাধবকুণ্ডের সঠিক কোনো গাইড নেই। ফলে ভ্রমণকারীরা নানা সমস্যায় পড়েন। কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় পাহাড়ের ওপর উঠে। মাঝেমধ্যে অঘটনও ঘটে।
টাঙ্গুয়ার হাওর
সুনামগঞ্জ থেকে জলযানে যেতে হয় টাঙ্গুয়ায়। কষ্টবহুল ভ্রমণ। টাঙ্গুয়ার হাওর তাহিরপুর ধর্মপাশা উপজেলায় উত্তর–পশ্চিম সীমান্ত বিস্তীর্ণ অর্ধশতাধিক বিলের সমন্বয়ে গঠিত দেশের বৃহত্তর জলাভূমি। আয়তনে ৯৫ হেক্টর। হাওর-বিললাগোয়া প্রায় ৮৫টি গ্রামের নয়নাভিরাম বেষ্টনী ভেদ করে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রবেশ রয়েছে নানা পথ। যোগাযোগ বেশ কষ্টসাধ্য বিখ্যাত প্রবাদের সঙ্গে মিল রেখে অনেকই বলে, ‘বর্ষায় নাও আর হেমন্তে পাও’। গবেষকদের মতে, টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকাটি ১ কোটি ২০ লাখ বছর ধরে একই অবস্থায় রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩ মিটার উঁচুতে অবস্থিত হওয়ায় টাঙ্গুয়ার হাওরে শীত মৌসুমে পানি থাকে। শুধু হাওর অঞ্চলে জন্ম নেওয়া হিজল, করচ বৃক্ষরাজি ছাড়াও টাঙ্গুয়ার হাওরে বিশ্বের বিরল প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ নলখাগড়া রয়েছে। বিরল প্রজাতির পগলোসের ফিসিং ঈগলসহ দুই শতাধিক প্রজাতির পাখির আশ্রয় টাঙ্গুয়ার হাওরে। এর মধ্যে ১০০ প্রজাতির হাঁসজাতীয় পাখি। মাছ রয়েছে দেড় শ প্রজাতির। জলাভূমির জীববৈচিত্র্যের গবেষণা সূত্রের প্রকাশ টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে বছরে গড়ে ৮ কোটি টাকার মাছ বিক্রির ইজারাদারির রেকর্ড রয়েছে। এনসিএস এবং ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান ফর টাঙ্গুয়ার সূত্রমতে জানা যায়, টাঙ্গুয়ার হাওরে ২০৮ প্রজাতির পাখি, দেড়শ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১১২ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬ প্রজাতির কচ্ছপ, ২১ প্রজাতির সাপ, ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। বাংলাদেশের সুন্দরবনের পর টাঙ্গুয়াকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রামসার ঘোষণা করা হয় ২০০০ সালের ১০ জুলাই। রামরাস কার্যক্রমে প্রথমটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণে টাঙ্গুয়ার হাওরকে সংরক্ষণ করা। টাঙ্গুয়ার হাওরের কথা উল্লেখপূর্বক প্রখ্যাত কথাশিল্পী শাহেদ আলীর বিবরণ হচ্ছে, যৌবনকালে যা দেখছেন পরিণত বয়সে ১০ ভাগের ১ ভাগও নেই। টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ অনেক কঠিন কাজ। ভ্রমণ সহজ করতে হলে সুনামগঞ্জ শহরে প্রবেশদ্বারে প্রস্তাবিত সুরমা ব্রীজ নির্মাণ করে পাহাড়ি সীমান্তের যে রাস্তা নির্মাণ চলেছে, তা বাস্তবায়িত হলে দোয়ারাবাজার সুনামগঞ্জ সদর—বিশ্বম্ভরপুর–তাহিরপুর–ধর্মপাশার সীমান্ত এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি বিজিবি কর্তৃক সীমান্তে চোরাচালানি প্রতিরোধ জোরদার করতে হবে। গত কয়েক বছরে সীমান্ত সড়কে বিচ্ছিন্ন কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। পুরো সীমান্ত সড়ক ও ব্রীজগুলো হয়ে গেলে টাঙ্গুয়াযাত্রা সহজ হবে। উল্লেখ্য, এ ছাড়া ভোলাগঞ্জ এবং হামহাম জলপ্রপাত প্রকৃতির অপার দান। এখানেও স্বাগতম। সিলেটের চা-বাগানের সৌন্দর্য অপরূপ। ভ্রমণতালিকায় রাখতে পারেন।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৯ সালে মার্চ মাসে সিলেট আগমন করেন। তিনি শিলং এসেছিলেন বায়ু পরিবর্তনের জন্য। তাঁর নিজের ভাষায় ‘গরম যখন ছুটল না, বরফ ঠান্ডা শরবতে ছুটে এলাম তখন এই শিলং নামক পর্বতে (সবুজপত্র)।’ সিলেটে তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তিনি সিলেটের প্রেমে পড়ে যান। সিলেটের সৌন্দর্যের প্রশংসা করে কবিতা লেখেন—
মমতাবিহীন কালস্রোতে
বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে
নির্বাসিত তুমি সুন্দর শ্রীভূমি।
*লেখক: বদরুল আলম, গবেষক ও প্রভাষক, তাজপুর ডিগ্রি কলেজ, সিলেট।