মেঘ করেছি জয়, নীলগিরি সফরের গল্প

ঢাকার বনানীর একটি অফিস থেকে ফ্যামিলি ট্যুর ছিল বান্দরবানে। তিন দিনের সফরের তৃতীয় দিন নির্ধারিত ছিল নীলগিরি ভ্রমণ। দিনটি ছিল শুক্রবার। বান্দরবান শহরের হোটেল হিল ভিউ থেকে আমরা ৪৪ জনের একটি টিম ভোর ৬টায় রওয়ানা হলাম মেঘ পাহাড়ের স্বর্গরাজ্য নীলগিরির উদ্দেশ্যে।

বান্দরবান শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দুরে থানচি উপজেলায় অবস্থিত নীলগিরি যেতে হলে আমাদের পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তা বেয়ে উঠতে হবে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪০০ ফিট উচ্চতায়। তাই আমাদের সবার মধ্যেই দেখতে পাচ্ছিলাম দারুণ এক উত্তেজনা বিরাজ করছে, যা ফুটে উঠেছিল সবার চোখেমুখে। নীলগিরি ভ্রমণে আমরা চান্দের গাড়ি বলে খ্যাত তিনটি খোলা জিপ চার হাজার টাকা করে ভাড়া করে ছুটছিলাম আর লক্ষ করছিলাম তীব্র শীতে আমাদের সবার অবস্থা অনেকটা জড়সড়।

কিছুদূর এগিয়ে আস্তে আস্তে ওপরের দিকে ওঠার পর লক্ষ করলাম আমরা সবাই মেঘের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। মেঘ ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার জ্যাকেট বেয়ে পানি ঝরছে। পাশে বসা আমার সহকর্মী সঞ্জীব দা–কে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, মেঘ আপনাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে রাজিব ভাই। আমার নীল রঙের সানগ্লাসটিও একদমই ভিজে গেল। কয়েক কিলোমিটার যাওয়ার পর চোখে পড়ল শৈলপ্রপাত, চিম্বুক পর্বত। পথে পেয়ে গেলাম উপজাতিদের হাতে তৈরি শাল, হরেক রকমের ফল। এবার আমরা নীলগিরির যাত্রাপথের প্রায় অর্ধেক পথ চলে এসেছি। দেখতে পাচ্ছি সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যাচ্ছে। মহান সৃষ্টিকর্তার কি অনবদ্য সৃষ্টি। মহান আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া আদায় করছি এ রকম একটি অপরূপ দৃশ্য দেখতে পেরে।

আমাদের গাড়ি ছুটে চলছে নীলগিরির পথে। নানা ধরনের চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে আমাদের সফরকে আরও প্রাণবন্ত করে রাখছিল আমাদের গাড়িচালকের সহকারী ইসহাক। যাওয়ার পথে চোখে পড়ল ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের। কাঁধে সুন্দর একটি ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছেন জীবিকার সন্ধানে। নারকেল, কলা পেপের মতো বিভিন্ন ধরনের পরিচিত গাছের পাশাপাশি দেখতে পাচ্ছি অনেক অপরিচিত গাছ। এর মধ্যে আমরা চলে এসেছি নীলগিরিতে প্রবেশের চেকপোস্টের কাছে। ও জানাতে ভুলে গেছি নীলগিরি রিসোর্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি রিসোর্ট। তাই এখানে আসতে হলে যাত্রীদের নাম এন্ট্রি করে তারপর অনুমতি নিয়ে যেতে হয়। তখন সকাল প্রায় আটটা। আমরা এবার নীলগিরির বেশ কাছাকাছি। পাহাড়ের গা বেয়ে পিচঢালা মসৃণ পথে আমরা এগিয়ে চলছি শুভ্র মেঘকে নিচে ফেলে। কখনো ওপরের দিকে উঠতে হচ্ছে আবার একটু নামতে হচ্ছে। আমার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল ২০০৯ সালে দার্জিলিং সফরের কথা। ওই যাত্রাপথও এ রকমই ছিল।

এবার আমরা সবাই দলগতভাবে গান গাচ্ছি। দারুণ উত্তেজনার উন্মুখ আমরা। আমাদের গাড়িচালকের সহকারী কাম ট্যুরিস্ট গাইড ইসহাক জানাল ওই যে দেখেন নীলগিরি দেখা যাচ্ছে। সবাই তাঁর কথা শোনার পর গাড়ির ভেতরেই দাঁড়িয়ে গেলাম। হ্যাঁ, সত্যিই আমরা নীলগিরির একেবারেই সন্নিকটে। সবাই ক্যামেরায়, মুঠোফোনে ছবি তুলতে তুলতে টের পেলাম আমাদের গাড়ি থেমে গেল। ও তার মানে আমরা এখন নীলগিরি হিল রিসোর্টের গাড়ি রাখার পার্কিংয়ে। আমার পাশে বসা ডেভিড ভাইকে নিয়ে আমি নীলগিরির মাটিতে পা রাখলাম। ঠান্ডার সমস্যার কারণে গাড়িচালকের সিটের পাশে বসা ছিল আমার স্ত্রী তানিয়া ও মেয়ে জায়না। তাদেরও নামালাম। নেমেই বুক ভরে মেঘ পাহাড় ও সবুজের সংমিশ্রণে তৈরি বাতাসের নির্ভেজাল ও প্রাকৃতিক এক জুস গ্রহণ করলাম। ও সত্যিই এত সুন্দর জায়গা বাংলাদেশে আছে! ইংরেজিতে ওয়াও শব্দটি সবার মুখ থেকেই তখন বের হচ্ছিল। আমাদের আইটি অফিসার সাইদুর তো রীতিমতো ওয়াও, চার্মিং, মারভেলাস, ওয়ান্ডারফুল শব্দ ছাড়া আর কিছুই বলছে না। নীলগিরি পৌঁছতে আমাদের সময় লাগল প্রায় দুই ঘণ্টা।

এবার সকালের নাশতা সারার পালা। আমরা বান্দরবান থেকেই প্যাকেট নাশতা নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাল, ডিম, পরোটা আর চা দিয়ে নাশতা শেষ করলাম সবাই। এরপর ফটোসেশনের পালা। প্রবেশ টিকিট কেটে আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই দেখতে পেলাম মেঘের সমুদ্র এখন আমাদের চোখের সামনে। এত সুন্দর দৃশ্য আমি এর আগে উপভোগ করিনি। সাদা মেঘগুলো যেন সাদা বরফের পাহাড় মনে হচ্ছিল। সাদা তুলার মতো লাগছিল মেঘের সমুদ্রকে। মনে হচ্ছিল সম্ভব হলে ঢাকায় নিয়ে যাই ব্যাগ ভরে। নীলগিরি নাম শুনে হয়তো ভাবতে পারেন জায়গাটির নামই নীলগিরি, কিন্তু আসলে তা নয়। এটি আসলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একটি হিল রিসোর্ট, যার নাম নীলগিরি হিল রিসোর্ট। এই রিসোর্টে পাঁচ ধরনের কটেজ আছে। আকাশনীলা, মেঘদূত, নীলাঞ্জনা, মারমা রিসা, তেহখো এবং সঙ্গে আছে তাঁবু টানানো ঘর। মোট আটটি কটেজের মধ্যে একেকটিতে এক রাতযাপনের জন্য ভাড়া পড়বে ৫ থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত। আর তাঁবুতে থাকতে গেলে ২ হাজার ৫০০ টাকা।

বাংলাদেশি পর্যটকদের রিসোর্ট বুকিং দিতে হলে তাদের পরিচিত থাকতে হবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোনো অফিসার। তারপর অনলাইনে ফরম পূরণ করে বুকিং দিতে হবে। আর বিদেশি পর্যটকদের জন্য এই রিসোর্ট রেস্ট্রিকটেড বা নিয়ন্ত্রিত। এখানে আরও আছে একটি উন্নতমানের রেস্টুরেন্ট, আছে হেলিপ্যাড। বছরের বেশির ভাগ সময়ই এখানে মেঘ দেখা যায়। তবে বর্ষাকালে নীলগিরির রূপ হয় অন্য রকম। তখন এর সৌন্দর্য আরও বহু গুণ বেড়ে যায়। আমরা নীলগিরির বিভিন্ন স্পট ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর ছবি তুলছিলাম। এখানে আসার পর আমার মনে হলো দার্জিলিংয়ের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর আমাদের নীলগিরি।

ভ্রমণপিপাসু যাঁরা এখনো নীলগিরি যাননি, তাঁরা ঘুরে আসতে পারেন সপরিবার। একবার গেলে যে কেউ আবার যাবে, এটা আমার মনে হচ্ছে। আমার বিশ্বাস সরকার ও সেনাবাহিনীর বিশেষ উদ্যোগে এ অপূর্ব মনোরম সুন্দর স্থানটি একসময় বিশ্বের অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে দেশি–বিদেশি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। প্রায় দুই ঘণ্টা অবস্থান শেষে এবার আমাদের ফেরার পালা। মেঘ পাহাড়কে বিদায় জানিয়ে আমরা ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম বান্দরবান শহরের দিকে। আর কানে কানে নীলগিরিকে বললাম বন্ধু খুব তাড়াতাড়িই তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।

* নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস: [email protected]