বগা, বান্দরবানে প্রাকৃতিক লেক

পানি ঘোলা হয়ে যাওয়ার আগে বগা লেকছবি: সংগৃহীত

বগা লেক, বান্দরবান শহর থেকে দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার, বান্দরবন হতে গাড়িতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা, একটু বেশি সময় লাগার কারণ পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। স্থানীয়ভাবে বলা হয়ে থাকে ফোর হুইল ছাড়া বগা লেকে উঠা যায় না, আমার ধারণা তথ্যটি সঠিক নয়, সাজেকে যদিও উঠা যায়, এখানে নয় কেন? তবে সাজেক থেকে রাস্তা কিছুটা খাঁড়া। এটা গাড়ি ব্যবসায়ীদের একটি কৌশল। রুমা থেকে বগা লেক ১৮ কিলোমিটার জিপ ভাড়া আসা–যাওয়া ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা।
বগা লেকে ঢুকতে একটি সেনাবাহিনীর চেক পোস্ট রয়েছে, যথারীতি অন্যান্য স্থানের ন্যায় এখানেও তারা পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। তবে অন্যান্য পর্যটন স্থানে সামরিক বাহিনী কোনো এন্ট্রি ফি নেয় না, তবে এখানে প্রত্যেক পর্যটকদের ৫০ টাকা করে দিতে হয়, বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা, তবে আমার ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ হয়নি। বগা লেকের পারে কিছু রিসোর্ট গড়ে উঠেছে, অনেকে বলে থাকেন এখানে থাকা–খাওয়া খুব সস্তা, আদতে তা নয়, তবে পূর্ব থেকে নির্ধারণ করলে সুবিধা হয়, মাছ এখানে কম পাবেন, পরিবার নিয়ে বেড়াতে যাবেন তেমন ভালো ব্যবস্থা এখানে গড়ে ওঠেনি, এটাস্ট বাথরুম নেই, হাই কমোট নেই, একটি রিসোর্টে হাই কমোট রয়েছে তাও বাইরে। যাঁরা যুবক বা নারীবিহীন তাঁদের জন্যই ব্যবস্থা রয়েছে; কারণ, একজনের সিট ভাড়া ২০০ টাকা, একক রুমের ফ্লোরে কয়েকটি বিছানা পাতা খাটের ব্যবস্থা নেই। কারণ, একটি রুমে বেশ কয়েকজনকে থাকার ব্যবস্থা করতে পারে। আমার ধারণা বগা লেকের ভ্রমণের আরেকটি কারণ এখানে সস্তায় দেশি মদ পাওয়া যায়।

৩০ পরিবারের জন্য একটি নার্সারি স্কুল রয়েছে। দুজন এম এ পাস করেছে লোকপ্রশাসন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বিএ পাস করেছে পাঁচজন, তিনজন ছেলে দুজন মেয়ে, এরা সবাই বাইরে চাকরি করে। এখানকার ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন মিশনারি স্কুলে দিনাজপুর বরিশাল টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ ঢাকায় লেখাপড়া করে।

অনেকের ধারণা বগা লেকের প্রচুর বড় মাছ আছে, তারা ধরতে পারে না। আমার ধারণা এটা ঠিক নয়, শিং মাছ তেলাপিয়া ছাড়া আর কোনো মাছ নেই, হয়তো বড় মাছ থাকতে পারে কিন্তু শেওলার জন্য সেটা ধরা যায় না, বা তাদের আগ্রহ কম। মাছ বড় না হওয়ার একটি কারণ হচ্ছে এখানে কোনো খাদ্য নেই, আমাদের দেশে সাধারণত পুকুরে হাঁড়ি-পাতিল ধোয়া হয় এবং খাদ্য যেগুলো আছে সেগুলো ফেলা হয়, বগা লেক শুধু গোসল করার জন্য মাত্র একটি ঘাট ব্যবহৃত হয়। এখানে মেয়ে-পুরুষ সবাই একসঙ্গে গোসল করে। যুবতী মেয়েরা যখন গোসল করতে পুকুরে নামছিলেন, আমি তখন পা ডুবিয়ে পুঁটি মাছকে আমার পায়ের মরা চামড়াগুলো খাওয়াচ্ছিলাম, ব্যাংককে এটা অর্থের বিনিময় করতে হয়। সেখানে মাছগুলো সম্ভবত পিরানহা, এখানে পুঁটি মাছ; কারণ, মাছ খাওয়া পায় না সে জন্য মানুষের পায়ের চামড়া খায়। মেয়েগুলো নিঃসংকোচে বলল আমার উঠে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, আমি ইচ্ছা করলে ঘাটে বসে থাকতে পারি।

বোম মেয়েরা খোঁপা বাঁধে অনেক সুন্দর করে, তাই তাঁরা প্রতিদিন চুল ভিজান না, সারাদিন কাজ করেন সন্ধ্যায় তাঁরা গোসল করেন, ফলে রাতে চুল শুকাবার কোনো উপায় নেই, সপ্তাহের দুই দিন করে চুল ভিজান। সোলার ও জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পান। দুটি ঘরে আকাশ টেলিভিশন চলে, বগা লেকের স্থানীয় নাম বগারিলি-বগা অর্থ জুম ঘরের বারান্দা, রিলি অর্থ লেক।

বগা লেক পাহাড়ের ওপর প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে। এটার চারিদিক পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত, পশ্চিম দিকের কিছুটা সমতল, সেখানে ৩০ পরিবার বোমদের বাস। এ লেকের পানি বাইরে যেতে পারে না এবং ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে প্রবল বৃষ্টিতে পানি তেমন বাড়ে না এবং শুকনা মৌসুমে পানি তেমন কমে না, শুকনা মৌসুমে পানি না কমার আর একটি হয়তো লেকের গভীরতা। লেকটি আজ পর্যন্ত কখনো সংস্কার হয়নি। তাই প্রচুর শ্যাওলা জমেছে, এ শ্যাওলার মধ্যে মানুষের সাঁতার কাটা বিপজ্জনক বা মাছের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় বোম সম্প্রদায় লেকের গভীরতা মাপতে যায় না, তবে স্থানীয় সূত্রে জানা যায় কোনো একটি দল লেকটি মেপে ১১০ ফুট গভীরতা পেয়েছে। তারা এ লেক সম্পর্কে আর একটি তথ্য দিল দুই থেকে তিন বছর পরপর লেকের পানি ঘোলা হয়ে যায়, তখন পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে, তখন তারা ঝরনার পানি ব্যবহার করে, তবে এই ঘোলা কেন হয়, তার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি।

লেক সম্পর্কে স্থানীয় বোম ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মিথ, যা সচারাচর প্রত্যেক অত্যাচার্য কোনো প্রাকৃতিক বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রাচীনকাল হতে গড়ে উঠে, যা পরে বর্ণনা করছি। বোম সম্প্রদায়ের ৩০টি পরিবার এই বগা লেকে বাস করছে। আদিকালে ৬০টি পরিবার ছিল, (এটা নিয়ে কাল্পনিক গল্প রয়েছে, ৬০টি পরিবারের বগা লেকে সলিলসমাধি হয়েছে, পরে এর বর্ণনা করব)। বোমারা ছিল প্রকৃতি পূজারি, ১৯১৮ সনে ব্রিটিশ নাগরিক প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান পাদ্রী এডুয়েন লরেন্স নামে এক ধর্ম যাজকের আগমন ঘটে। তিনি তাদের প্রকৃতি পূজারি থেকে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করেন।

বগা লেক কিছুদিন পূর্বেও দুর্গম পথ ছিল, ১৯৭৮ প্রথম পর্যটকের আগমন অথবা বহিরাগতদের প্রবেশ ঘটে, তখন থেকে আস্তে আস্তে বোমরা পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়েছে। তাই ধারণা করা যায় ১৯১৮ কতটা দুর্গম ছিল এ এলাকা। শুধু এখানে নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরকে ক্যাথলিক বা প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হয়েছিল। গত তিন দশক থেকে এর প্রভাব এবং তাদের খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অতি পাড়ায় পাড়ায় উপাসনালয় রয়েছে, মুসলমানদের যেমন পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে মসজিদ রয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ১১ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু কিছু উপজাতি খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়ে পড়েছে।

উপজাতিদের ধর্মান্তরিত হওয়ার ফলে তাদের সংস্কৃতি প্রভাব পড়ছে ব্যাপকভাবে, ফলে ক্রমে তাদের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ঘটছে। এ ধর্মান্তরিত, নিজস্ব সংস্কৃতির পরিবার।

লেখক: গাজী সালেহ উদ্দিন, সাবেক শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়