চায়ের রাজ্য শ্রীমঙ্গলে একদিন ঘোরাঘুরি
মৌলভীবাজার জেলার একটি উপজেলা শ্রীমঙ্গল। যদিও মৌলভীবাজার জেলা থেকেও শ্রীমঙ্গল নামটিই বেশি পরিচিত আমাদের কাছে। এর প্রধান কারণ, শ্রীমঙ্গল বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। আর এখন যেহেতু শীতকাল, ভ্রমণের কাল, তাই চলুন যেনে নিই কীভাবে এক দিনে ঘুরে আসবেন শ্রীমঙ্গলের দর্শনীয় স্থানগুলো।
পাহাড়, রেইনফরেস্ট আর হাওরে ঘেরা শ্রীমঙ্গল চায়ের জন্য বিখ্যাত হলেও আমরা অনেকেই হয়তো জানি না, এখানে চায়ের পাশাপাশি রবার, আনারস ও লেবুর খুব ভালো ফলন হয়। তা ছাড়া শ্রীমঙ্গলের পাশেই রয়েছে একসময়ের বৃহত্তর সিলেটের মৎস্যভান্ডার বলে খ্যাত হাইল হাওরের বাইক্কা বিল। যাঁরা শ্রীমঙ্গলে বিলাসবহুল ভ্রমণ করতে চান, তাঁদের জন্য রয়েছে পাঁচ তারকা মানের হোটেল, ‘হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান’, ‘দুসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা’ ইত্যাদি। শ্রীমঙ্গল সম্পর্কে তো প্রাথমিক ধারণা হলো, এবার চলুন ব্যাগ গুছিয়ে শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে রওনা করা যাক।
যদি শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে সাশ্রয় করতে চান, তাহলে আপনার অত্যাবশ্যক কাজ হচ্ছে ৮ থেকে ১০ জনের গ্রুপ করে ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলা। চট্টগ্রাম কিংবা ঢাকা, দুই রুটেই পাবেন সিলেটগামী ট্রেন। ঢাকা থেকে সিলেট রুটে কালনী এক্সপ্রেস (শুক্রবার বন্ধ) আর চট্টগ্রাম থেকে সিলেট রুটে উদয়ন এক্সপ্রেসে (শনিবার বন্ধ) উঠে গেলে আপনাকে সকাল সকাল নামিয়ে দেবে শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে। ট্রেনের টিকিট না পেলে সিলেটগামী বাসে চেপে চলে আসুন শ্রীমঙ্গল। আপনি যদি বাসে আসেন, সে ক্ষেত্রে বাস আপনাকে নামিয়ে দেবে চৌমোহনাতে। চৌমোহনা ও রেলস্টেশন হাঁটার রাস্তায় ৫ মিনিটের দূরত্বে অবস্থিত, তাই চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশন থেকে বের হয়ে পাশেই পেয়ে যাবেন সকালে নাশতা করার জন্য মোটামুটি মানের দুটি হোটেল, সেখানে সকালের নাশতা সেরে নিতে পারেন। আর যদি ভালো মানের খাবার চান, তাহলে রেলস্টেশন থেকে সোজা রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকুন চৌমোহনার দিকে। চৌমোহনার কাছেই পেয়ে যাবেন ভালো মানের বেশ কিছু হোটেল। আর নয়তো গুগল ম্যাপ চালু করে ১০ মিনিট হেঁটে চলে যান বিখ্যাত পানসি রেস্তোরাঁয়।
সকালের নাশতা করতে যাওয়ার সময় বা নাশতা শেষে শ্রীমঙ্গলে দিনব্যাপী ভ্রমণের জন্য জিপ ভাড়া করে নিন। রেলস্টেশনের বাইরে থেকে শুরু করে চৌমোহনা এবং পানসি রেস্তোরাঁ পর্যন্ত রাস্তার পাশে এসব জিপ থাকে। আপনারা যদি সংখ্যায় ২ থেকে ৫ জন হন, তাহলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা হবে আপনাদের জন্য উপযুক্ত বাহন। কোন কোন দর্শনীয় স্থানে যাবেন, তা ভেদে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা এবং জিপ ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে রাখে। দরদাম কষে জিপ বা অটোরিকশা ঠিক করার পর বাহনে চেপে বেরিয়ে পড়ুন দর্শনীয় স্থানগুলোর উদ্দেশে। ওই দেখো, এখনো তো আপনাদের দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কেই বলা হয়ে ওঠেনি। চলুন তাহলে এবার জিপ বা অটোরিকশায় করে কোন কোন দর্শনীয় স্থান, কোনটার পর কোনটা ঘুরবেন, সেটা জেনে নেওয়া যাক।
শ্রীমঙ্গলে অনেক দর্শনীয় স্থান আছে, যা আপনার পক্ষে এক দিনে ঘুরে শেষ করা সম্ভব নয়। তাই এক দিনে ঘোরার জন্য কিছু বিখ্যাত এবং প্রচলিত দর্শনীয় স্থানগুলো হলো বাইক্কা বিল, লাউয়াছড়া, মাধবপুর লেক, চা-বাগান, লাল পাহাড়, চা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বধ্যভূমি-৭১ ইত্যাদি।
ভোরের কুয়াশামাখা বাইক্কা বিলের সৌন্দর্য দেখতে চাইলে প্রথমেই চলে যেতে হবে বাইক্কা বিলে। বাইক্কা বিলে সম্পূর্ণ সকালটা কাটিয়ে তারপর চলে যান বিখ্যাত স্পট লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভালোভাবে ঘুরে শেষ করতে ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগবে। বাইক্কা বিল আর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান—এ দুই জায়গা চেষ্টা করবেন দুপুরের মধ্যে ঘুরে শেষ করার। কারণ, শীতকাল ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত হলেও দিনের দৈর্ঘ্য কিন্তু ছোট। যাহোক, লাউয়াছড়া উদ্যান ঘোরা শেষ হলে চালককে বলুন একটি ভালো খাওয়ার হোটেলের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য, সঙ্গে এটাও মনে করিয়ে দেবেন, আপনাদের পরবর্তী গন্তব্য হবে মাধবপুর লেক। হোটেল যদি মাঝামাঝি হয়, তাহলে সেটা আপনাদের জন্যই ভালো, সময় বাঁচবে। আর হ্যাঁ, চালকের খাওয়ার বিল কিন্তু আপনাদেরই দিতে হবে। খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে এবার বেরিয়ে পড়ুন মাধবপুর লেকের উদ্দেশে। মাধবপুর লেক থেকে এরপর যাবেন নূরজাহান টি স্টেট, লাল পাহাড়, বিটিআরআই, আদি নীলকণ্ঠ চা কেবিন এবং বধ্যভূমি-৭১।
আদি নীলকণ্ঠ চা কেবিনের ৭ রঙের চা দেশব্যাপী বিখ্যাত, তবে খেয়াল রাখবেন, ওদের একটা শাখা কেবিন আছে, ওখানে না গিয়ে প্রধান শাখায় যাওয়াটাই উত্তম হবে। এসব দর্শনীয় জায়গায় যাওয়ার পথে চারপাশের রবারবাগান, চা-বাগান, গাছগাছালিঘেরা রাস্তা দেখে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য। সব কটি স্থান ঘোরা শেষে চালক আপনাকে নামিয়ে দেবেন আপনার গন্তব্য অনুযায়ী শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশন বা বাস টার্মিনালে। হাতে সময় থাকলে আশপাশে একটু ঘুরে দেখতে পারেন, আর চাইলে আশপাশের অসংখ্য দোকান থেকে বাছাই করে কিনে নিতে পারেন চা-পাতা। তারপর সন্ধ্যার নাশতা সেরে চেপে পড়ুন বাসে বা ট্রেনে। যদি নিজেকে খুব বেশি ক্লান্ত মনে হয়, আর হাতে থাকে পর্যাপ্ত টাকা, তাহলে রাতটি শ্রীমঙ্গলে কাটিয়ে পরদিন আবার বাদ পড়ে যাওয়া কিছু দর্শনীয় স্থান ঘুরে (যেমন: সিতেশ বাবুর চিড়িয়াখানা, হাম হাম ঝরনা ইত্যাদি) ফিরে যান আপন নীড়ে, ঝাঁপিয়ে পড়ুন নতুন উদ্যমে আপনার দৈনন্দিন কার্যকলাপে।
পরামর্শ:
আপনি চাইলে সময় বেশি নিয়ে শ্রীমঙ্গল ও সিলেট একবারে ভ্রমণ করে আসতে পারেন। যেকোনো জায়গায় ভ্রমণের আগে অবশ্যই ওই এলাকা এবং বাজেট সম্পর্কে ভালো ধারণা নিয়ে যাবেন। দর্শনীয় স্থানসহ যত্রতত্র ময়লা ফেলে সুন্দর বাংলাদেশকে আগামী প্রজন্মের জন্য অবাসযোগ্য করে তুলবেন না।
*লেখক: আসিফ আল নাঈম, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।