বাংলাদেশ-ভারতের প্রথম সীমানা পিলারে একদিন

কাঁচা রাস্তার পথ সাড়ে চার কিলোমিটার, হেঁটে গেলেই শুটিং স্পট। ভাবিনি, এতটা পথ হাঁটতে হবে! এ অল্পখানি, আরেকটু, এই তো সামনেই! এমন করতে করতে পুরোটা পথ আমাদের পা হাঁটল। পদাতিক সৈন্যের মতো হেঁটে আমাদের শুটিং স্পটে পৌঁছে দিল আমাদের পা। পরিশ্রমী পা আমাদের। ধন্যবাদ হে পা!

পায়ের জন্য হাঁটার পথ আরও ছিল, সুদীর্ঘ রাস্তা; কিন্তু আমাদের পা চায়নি আর হাঁটতে। এভাবে হেঁটে যেতে থাকলে তো হেঁটে যাওয়াই যায়! বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ‘ইছামতী’ নদীর তীর দিয়ে তখন পা পৌঁছে যেত মালঞ্চ নদে। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে মালঞ্চ নদ, নদের বুকে দাঁড়িয়ে আছে মমতাময়ী সুন্দরবন। দূরেই থাকো তুমি দাঁড়িয়ে হে সুন্দরবন; আমাদের মন আজ তোমাতে নেই। মন অন্যখানে। আমরা এখানে দেখতে এসেছি তোমার মতোই আশ্চর্যজনক এক জিনিস। আমাদের পা আর চাইছেও না হাঁটতে। ৮-১০ কিলোমিটার হেঁটে কুটুমবাড়ি যাওয়ার আলাদা মজা ছিল গ্রামে থাকতে। কিন্তু দীর্ঘদিন পর হঠাৎ এত হাঁটা! অক্লান্ত পরিশ্রম করে পা এখন কী রকম ক্লান্ত, শ্রান্ত! তাই পায়ের আরামে দরকার আমাদের জন্য বিশ্রাম। তবে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। সেই শুটিং স্পট এই। এখানেই শুট করা হয়েছিল জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র একটি প্রতিবেদন, শুট করা হয়েছিল ‘শঙ্খচিল’ সিনেমার কয়েকটি দৃশ্য।

এখানে আসার সময় রওনা দিয়েছিলাম সাতক্ষীরা থেকে। সূর্য তখন ঘড়ির মুখ দিয়ে প্রকাশ করল, ‘আমার এগারো বেজে গেছে!’ সে সময় কথা বলে উঠল আমার মন, ‘সূর্যের বারো বেজে যায় যাক! আমাদের ভোমরা স্থলবন্দরে পৌঁছাতেই হবে।’ চড়ে বসলাম থ্রি হুইলারে। সিএনজি ধরনের গাড়ি। গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে হ্যান্ডেলের কান ধরে মোড়ালেন ড্রাইভার। গাড়ি আরম্ভ করল চলা। ও যন্ত্রের কান ধরে মোড়ালেই চলে। যেতেই থাকলাম ভোমরা রোড দিয়ে। ফাটাফাটি রোদ। শরৎ আর হেমন্তের সংমিশ্রণ তখন ঋতুতে। গাঢ় নীল আকাশের দু–এক জায়গায় সাদা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো মেঘ। মেঘগুলোকে পেড়ে এনে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছিল একটু। কী দুর্দান্ত কল্পনা! মেঘখেকো মন আমার!
যাত্রীদের গায়ে বাতাস এসে আছাড় খেয়ে পড়ছে। আমরা যাচ্ছি। যাচ্ছি মানে বসে আছি; গাড়ি ছুটছে। ছুটছে বলা ঠিক হবে না; গাড়িটা হাঁটছে। হঠাৎ গাড়ির পেছন দিকে শোঁ শোঁ আওয়াজ। কী হলো?

দেখলাম আমাদের পাশ কাটিয়ে সামনে উঠে যাচ্ছে একটা ব্যাটারিচালিত ভ্যান। গতি বেশি নয়, শব্দটা তারই। আমার মুখটা হা হা করে হেসে ফেলল। আবারও শোঁ শোঁ একটু পর। আরেকটা ভ্যান উঠে গেল সামনে। মুখটা আমার নাছোড়বান্দা, না হেসে থামতে পারল না। আসলে লজ্জায় আমাদের থ্রি-হুইলারের উচিত ওখানে শুয়ে পড়া। কিন্তু শুতে বললেও শুচ্ছে না; কচ্ছপগতিতে এগোচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পেছনে সাইকেলের বেল; ক্রিং ক্রিং। সাইড চাই তার। দ্রুতগতির সাইকেলটা যখন আগে উঠতে যাচ্ছে, দমফাটা হাসি বের হয়ে গেল আমার। মুখ চেপে ধরলাম হাত দিয়ে; হাসি থামেনি। হাসি না থামলে আমার কী করার!

‘ইঞ্জিনের দোষ’, ড্রাইভার আমাদের দিকে হেসে বললেন। ড্রাইভারের কথায় আমরা আর না জেনে পারলাম না যে গাড়িটার ইঞ্জিনের দোষ ছিল! আরও বেড়ে গেল আমার হাসি। মনে পড়ে গেল ভারতীয় কয়েকটা সিনেমার দৃশ্য। মোটরসাইকেল চলছে, পাশ দিয়ে সামনে উঠে গেল সাইকেল! মোটরসাইকেল চলছে, পাশ দিয়ে দৌড়ে আগে উঠে গেল কেউ! হেলিকপ্টার চলছে, আগে উঠে গেল টিয়া পাখি! ভারতীয় এসব সিনেমার দৃশ্য আমার মুখস্থ। যানবাহনগুলোর জন্য কী লজ্জাজনক পরিস্থিতি বলুন তো! তেমন লজ্জা নিয়েই আমাদের গাড়িটিও চলছে। মাঝপথে দীর্ঘ এলাকাজুড়ে রাস্তার পিঠের ছাল উঠে গেছে। পিচের জায়গায় ধুলো। উড়ে এসে রাস্তার ধুলো আমাদের একপ্রকার মেকআপ করিয়ে ছাড়ল। আমরা ধুলোর মেকআপ নিয়ে ছুটে চলছি শুটিং স্পটে। শুটিং করতে নয়, শুটিং দেখতেও নয়; আমরা যাচ্ছি অনেক আগে করে যাওয়া শুটিং এর স্পটটি দেখতে। ইছামতীর তীর ঘেঁষে বাংলাদেশের তিনটি স্পটে শুট করা হয়েছিল সিনেমাটি। তার একটি জায়গায় মুশকিল বাংলাদেশ-ভারতের সীমানা চেনা। ভারতের মধ্যে বাংলাদেশ, আবার বাংলাদেশের মধ্যে ভারত। কেমন তালগোল পাকানো। আমার বুকের ভেতর আনন্দ দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল সে সময়। শঙ্খচিলের শুটিং স্পটে আমরা পৌঁছে যাব এক্ষুনিই!
শঙ্খচিল! পাখি? ওড়ে তা? ইছামতী নদীর ওপর ওড়ে?

ওড়ে মানে! শুধু কি ওড়ে! দুই বাংলার প্রতিটি সিনেমা হলে দীর্ঘদিন বাসা বেঁধে ছিল এই ‘শঙ্খচিল’ সিনেমাটি। ২০১৬ সালে পেয়েছিল ভারতের জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার, মুক্তি পাওয়ার আগেই!
বুঝুন ঠ্যালা! এ সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগেই মুক্তাদানার মুকুট পরে বসে আছে।

‘মনের মানুষ’, ‘শঙ্খচিল’ মন ঠান্ডা করে দেওয়া একেকটা সিনেমা। গৌতম ঘোষের কয়েকটি সিনেমার ওপর অন্য রকম আকর্ষণ আমার। এ আকর্ষণ শিল্প ও শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধের আকর্ষণ। এ আকর্ষণ দুর্নিবার। ‘অভিনয় কাকে বলে’ মধ্যবয়সে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় দেখিয়ে দিয়েছেন এখানটাতে।
খুব ভালো মনে আছে আমার। ‘মনের মানুষ’ সিনেমাটি আমি দেখেছিলাম গভীর রাতে, ‘শঙ্খচিল’ সিনেমাটি সন্ধ্যায়। সবই দেখেছিলাম ফোনে। আমার আরেক মন, আমার সিনেমা দেখার যন্ত্র, আমার বায়োস্কোপ, আমার থিয়েটার, আমার সিনেমা হলের পর্দা, আমার ফোন। ধন্যবাদ তোমাকে ফোন হে। যদি ফোন তুমি অমর হতে!

সাধক লালন সাঁইজির জীবন নিয়ে সুনীল লিখেছিলেন ‘মনের মানুষ’ উপন্যাস। সুনীল বলতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কেউ কেউ তাঁকে শুধু ‘সুনীল’ বলেন, কেউ বলেন ‘সুনীলদা’। কেউ বলেন ‘কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’, আবার ‘কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’ কেউ বলেন। আমাদের ‘কাকাবাবু’র স্রষ্টা। আমি তাঁকে কী বলে ডাকব, সে কথা যখন তাঁকে ডাকব তখন শুনতে পাবেন। কিন্তু এখন আমি কিছু বলে ডাকছি না তাঁকে; আমি এখন তাঁকে নিয়ে লিখছি। তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একনামে সবাই চেনে। আমার মনটার একজন প্রিয় সাহিত্যিক তিনি। তিনি এখন ডাকার ঊর্ধ্বে। তাঁর রচিত ‘মনের মানুষ’ উপন্যাস নিয়ে গৌতম ঘোষ বানালেন সিনেমা, অভিনয়ে ‘শিল্প কী’ তা দেখিয়ে দিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। অবশ্য গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ সিনেমা মানুষের মুখে মুখে আজও ফেরে। বাংলাদেশি কিংবদন্তি অভিনেতা রাইসুল আসাদ অভিনয় করেছেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’তে।

কিন্তু আমরা পদ্মায় আসিনি আজ। আসিনি ‘মনের মানুষ’-এর কুষ্টিয়ার আখড়ায়। আজ ইছামতী নদীর তীরে আমরা এসেছি। এখানে বসো হে বাছা মন! এই জোড়া বটের ছায়ায়। এখানে ‘শঙ্খচিল’ সিনেমার শুট করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের বেদনাবিধুর দিন, কাঁটাতারের ওপারে স্বজনের হাতছানি হয়তো তছনছ করেছে গৌতম ঘোষের মনটাকে। তাই তিনি সিনেমায় তুলে ধরেছেন তাঁর মনের অব্যক্ত বেদনা।

দেশভাগ নিয়ে সবচেয়ে গভীর ক্ষত, অকৃত্রিম বেদনা আমি দেখেছি ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায়। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণ রেখা’, ‘কোমল গান্ধার’ ট্রিলজি সিনেমায় ফুটে উঠেছে মুষড়ে পড়া আর্তনাদ। বিভক্ত দেশের গুমরে মরা ফোঁপানি ঋত্বিক ঘটক এখানে ফুটিয়ে তুলেছেন নিপুণতার সঙ্গে। জানি না গৌতম ঘোষ ‘ঋত্বিক ঘটক’ কি না! কিন্তু তিনি ঘটিয়েছেন সেই অকৃত্রিম বেদনাবোধ, আমি তাঁর শঙ্খচিল সিনেমায় দেখেছি। প্রসেনজিৎ এবং বাংলাদেশি অভিনেত্রী কুসুম শিকদার এখানে মূল ভূমিকায় করেছেন অভিনয়। মানুষের মন একনিমেষেই কেড়ে নিয়েছিল সাঁঝবাতি নামের ছোট্ট মেয়েটিও।

আমাদের ধীরস্থির গাড়িটি পৌঁছাল ভোমরা স্থলবন্দরে দুপুর ১২টা নাগাদ। এই নিয়ে চারবার এখানে আসা আমার। সঙ্গে সহকর্মী আবীর এবং বন্ধু মামুন। দেখলাম বন্দরে একটা সাইনবোর্ডে লাল রঙে বড় করে লেখা ‘থামুন’। আমরা আর না থেমে পারলাম না। যদিও আমরা থাম নই, কিন্তু থামের মতোই থেমে গেলাম আমরা। রসিকতা করে বন্ধুকে বললাম, ‘মামুন, থামুন।’ আমার কথায় সহযাত্রীদের গাল বেয়ে হাসি পড়ল গড়িয়ে। তাকালাম এদিক-ওদিক। ডিউটিরত বিজিবি বাহিনীতে সয়লাব পুরো চেকিং এলাকা। লাল কাপড়ের ছোট ছোট পতাকায় সতর্কতার সংকেত। পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়া ওদিকটায় যাবে না যাওয়া। কারণ, সাইনবোর্ডের পাশেই বসে আছে দুজন বিজিবির সদস্য। তাঁদের কাছে আগে কৈফিয়ত দিতে হবে, পাসপোর্ট দেখাতে হবে, তারপর যেতে দেবেন কাস্টমস অফিসে। অফিসের পাশেই সরু খাল।

খাল পেরোলেই ভারত! কিন্তু খাল লাফ দেওয়াটাও অপ্রয়োজনীয়। এখানে দিব্যি রয়েছে একটি কালভার্ট, বাংলাদেশ-ভারতের জিরো লাইন। এই জিরো লাইন থেকে আমরা প্রায় দেড় শ ফিট দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছি! আমার বন্ধু মামুন কালভার্ট পর্যন্ত যেতে চাইল, ও ভারতের সীমানাটা একটু ছুঁয়ে দেখতে চায়।

মামুনের এই ছুঁয়ে দেখতে চাওয়াটারও কারণ আছে, একটু ইন্ধন আছে। গালগল্প না হলেও একটু আগে আমার গাল দিয়ে একটা গল্প বেরিয়েছিল। গল্পটা বাস্তব। ২০১৩ সালে আমি প্রথম যখন এখানে আসি তখন বাহিনী নিয়ে এসেছিলাম। বাহিনী বলতে বন্ধুবাহিনী। সবাই এসেছিলাম সাইকেলে করে। আসার পর এখানের ডিউটিরত বিজিবি সদস্যকে অনুরোধ করলাম আমরা বর্ডারটা একেবারেই কাছ থেকে একটু দেখতে চাই। নানা কৈফিয়ত দেওয়ার পর তিনি দিয়েছিলেন সম্মতি। তিনি যে কী ভালোর ভালো রে বাবা! দুজন করে যেতে দেবে, সেই দুজন ফিরে এলে অন্য দুজন। কিন্তু কোনোমতে বর্ডার ক্রস করলে করা হবে গুলি। যেহেতু আমরা সীমানা ছুঁয়ে দেখতে যাচ্ছি পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই! বিজিবির লোকটার এ সতর্কবার্তা এ জন্যই। আমরা গিয়েছিলাম সেখানে দুজন করেই। কালভার্টের ওপর একটা পা ছুঁয়ে দিয়েই এসেছিলাম চলে। তুলেছিলাম ছবিও। কিন্তু ছবিগুলো যে হারিয়ে গেল কোথায় সে কথা ছবিগুলোই জানে! এই গল্প শুনে মামুনেরও আজ ইচ্ছে জাগল ওখানে যেতে। আমি বললাম, অনুরোধ করে লাভ নেই, যেতে দেবে না। খুব কড়াকড়ি এখন। আমার কথায় মামুন নিরুপায়। সিদ্ধান্ত হলো আমরা আসল জায়গায় চলে যাই, যেখানে মূলত যেতে এসেছি আমরা! ভোমরা বন্দর থেকে চারদিকে রাস্তা গেছে চারটি। আমার মাথা বাদ দিলে তেমাথার ভোমরা বন্দর আমার! ভারতে ঢুকে গেছে সামনের দিকেরটা, একটা গেছে আমার পেছন দিকের সাতক্ষীরায়, একটা বাঁয়ে, একটা গেছে ডানে। বাঁ দিকের ও ডান দিকের রাস্তা দুটি মূলত সীমান্তবর্তী বেড়িবাঁধ। রাস্তা কাঁচা। ঘন অরণ্য, ঝোপঝাড় আর ঘরবাড়ি; রয়েছে খেতখামার। আমরা ডান দিকটায় যাব না। ওই রাস্তার নিচে জিরো লাইন দিয়ে উঁচু কাঁটাতারের বেড়া। আমরা বাঁ দিকটায় যাব। বামপন্থী আমরা। রাস্তাটা ভোমরা বন্দর থেকে ছুটে গিয়ে ইছামতী নদীকে ছুঁয়ে দিয়েছে, প্রায় বর্ডার লাইন ঘেঁষেই। আবার নিজেই নদীর তীর হয়ে রাস্তাটা ছুটে গেছে সুন্দরবন পর্যন্ত। এই হলো রাস্তার ‘কপাল টেক্কা’ খেলা, ছুঁয়ে দেওয়ার খেলা। বাঁ দিকের এই রাস্তাটা ধরলাম আমরা। গন্তব্য শঙ্খচিল শুটিং স্পট, ইত্যাদির প্রতিবেদনে দেখানো জায়গা। যেখানে বাংলাদেশ আর ভারতের সীমানায় কেউ গুঁজে দিতে পারেনি কাঁটাতারের বেড়ার স্ট্যাম্প। পাখি আর নদীর মতোই বেড়ামুক্ত এলাকা এটি।

যেতে যেতে আমরা যাচ্ছিই। কাঁচা রাস্তা। গাড়িঘোড়া নেই। তবে গরু আছে; যদিও গাড়ি নেই গরুর। গরুরা হাঁটছে, আমরাও গরুর মতো হাঁটছি। হাঁটো বেচারারা! আমাদের পা হেঁটে চলছে। আমার আর তখন কষ্ট কম! হাঁটছে তো আমার পা! আমি আনন্দে এদিক–ওদিক তাকানো করে দিলাম শুরু। সরু সরু বুদ্ধি আমার মাথায় এসে দিতে থাকল টোকা। রসিকতা করতে বন্ধুকে বললাম তখন, বল তো গ্যাঞ্জাম কাকে বলে?
বন্ধু বলল, ‘কাকে বলে?’
আমি বললাম, ‘কেন! জ্ঞানে জ্ঞানে জ্যাম বাঁধলে তাকে গ্যাঞ্জাম বলে।’
ওরা হাসল।
বললাম, ‘যার বিশেষ গুণ আছে তাকে কী বলে?’
‘কী বলে?’ উল্টো প্রশ্ন বন্ধুর।
আমি বললাম, ‘কেন! ‘বিজ্ঞুনী!’’
বন্ধু মামুন বলল, ‘বিজ্ঞুনী আবার কী?’
বললাম, ‘কেন! যার কোনো বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান আছে তিনি যদি বিজ্ঞানী হন, তবে যার বিশেষ গুণ আছে তিনি বিজ্ঞুনী হবেন না কেন!’
জমে গেল ওদের সঙ্গে আমার বুদ্ধির খেলা, ‘শব্দ করো তৈরি!’
সহকর্মী আবীর এবার খুলল মুখ। বলল, ‘কোনো জ্ঞানের সীমা নেই যার, তাকে কী বলে?’
আমি হাসলাম। বললাম, ‘কেন! যার অশেষ জ্ঞান তাকে অজ্ঞানী বলে!’
মামুন কথা না বলে থাকার লোক না। কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিল আমার দিকে৷ ‘আচ্ছা, যার বুদ্ধি কম তাকে কী বলবি?’
মামুনের প্রশ্নপত্রে আমি ঝটকা খেয়ে বললাম, ‘বুদ্ধি ডট কম।’
‘কীভাবে?’, প্রশ্ন মামুনের।

আমি বললাম, কেন! ডট ডট ডট মানে প্রশ্নপত্রের শূন্যস্থান। ছোটবেলায় পড়োনি স্কুলে? ডট বলতে শব্দ সেখানে কম রয়েছে। বুদ্ধি ডটকম মানে বুদ্ধি কম কম। হঠাৎ একটা বেলগাছ দেখিয়ে দিলাম ওদের। ওরা তাকাল গাছের বেলের দিকে। আপদ! আমি বললাম, আরে বেলের দিকে না, নিচের দিকে তাকা। ওপরে বেল, নিচে বিজিবি। এই রাস্তায় প্রতি আধা কিলোমিটার পরপর বিজিবির গার্ড পয়েন্ট। প্রতি পয়েন্টে পাঁচজন। সময় ভাগ করে পাহারা দিতে হয় ২৪ ঘণ্টাই। বেলগাছটার নিচে ছাউনি, ছাউনির নিচে একজন বিজিবি। বসে আছেন বাংলা পাঁচের মতো মুখ করে, কানে ফোন। ভাব দেখে মনে হলো ফোনের ওপাশ থেকে কেউ তেরোর ঘরের নামতা জিজ্ঞেস করেছে! ‘আসসালামু আলাইকুম’, সামনে থাকায় এগিয়ে গিয়ে সালাম দিল আবীর। বিজিবি সদস্যটা উঠলেন একটু চমকে!

‘কোথায় যাচ্ছেন আপনারা? এসেছেন কোথা থেকে?’ প্রশ্ন করলেন তিনি। যথারীতি উত্তর দিলাম, চাইলাম সামনে যাওয়ার অনুমতি। বিজিবি সদস্যটা বললেন সামনে যে গার্ড পয়েন্টটা আছে, সে পর্যন্ত গিয়েই আমরা যেন ফিরে আসি। কী মুশকিল! মাত্র আধা কিলোমিটার! আমাদের গন্তব্য তো আরও অনেক দূর! এটুকু গেলে যে আমরা দেখতে পাব না আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্থান! ভাবলাম না তাঁর কথা বেশি, ‘ঠিক আছে স্যার’ বলে চলতে থাকলাম। রাস্তার প্রায় ১০০ ফিট পশ্চিম দিয়ে ভারত। ভারত আর বাংলাদেশের সীমানা দক্ষিণ দিকে বয়ে গেছে যত দূর, রাস্তাও তত দূর। আমরা চলছি উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে। ঘন গাছপালা আর ঝোপঝাড় থাকায় প্রথমে ভারতের সীমানা পাওয়া যায় না দেখতে। হাঁটছি আমরা। সামনে পড়ল আরেকটা গার্ড পয়েন্ট। বিজিবি আমাদের দিকে ফিরে মুচকি হাসলেন। ‘যাবেন কোথায়?’

রীতিমতো আবার কৈফিয়ত। কথা শেষ করে আরও সামনে যাওয়ার অনুমতি চাইলাম আমরা, দিলেন। তবে সতর্ক করলেন রাস্তার ডান পাশ তথা পশ্চিম দিকে যেন না নামি। ‘জি, আচ্ছা, ধন্যবাদ’ বলে চলতে শুরু করলাম আমরা। ততক্ষণে পাশ দিয়ে দিব্যি দেখা যাচ্ছে ভারতের সীমানা, পতাকা আর ছোট ছোট পিলারই এখানের সীমানাচিহ্ন; কোনো বেড়া নেই কাঁটাতারের। দেওয়া যায় না কাঁটাতারের বেড়া। কী করে দেবে? বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে, মাঝখান দিয়ে উঠানের, ঘরের চালের ওপর দিয়ে, মধ্য দিয়ে পুকুরের এ এলাকার জিরো লাইন। আমরা যে জায়গাটি দেখতে যাচ্ছি, সেখানে রয়েছে একদম অবাক করার ব্যাপার। ঘর একজনের অর্ধেক বাংলাদেশে তো অর্ধেক ভারতে। এ ঘরটা ভারতে তো ওই ঘরটা বাংলাদেশে। এ জন্য শঙ্খচিল সিনেমার ১৪ পরের দৃশ্যে অভিনেতা শাহেদ আলী একটা ডায়ালগ বলেছেন, ‘আমার মনে হয় র‍্যাডক্লিপ সাহেব (সীমানা) রেখা টানার সময় একটু নেশাগ্রস্ত ছিলেন!’ গৌতম ঘোষ আসলে সত্যি কথাই বলিয়েছেন তাঁকে দিয়ে। সত্যবাদী শাহেদ আলী ধন্যবাদ আপনাকে।
আমরা কিন্তু থেমে নেই; হাঁটছি। ওপাশে ভারতের ঘাঁটিতে বসে আছে বিএসএফ। তাদেরও ঘাঁটি ঘন ঘন। একটা ঘাঁটিতে দেখলাম ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর(বিএসএফ) একজন ভাত নিয়ে এল সাইকেলে চড়ে। সীমানার আশ্চর্য কারবার দেখতে দেখতে আমার পা একটু কাঁচুমাচু করে উঠল, অলস পা কোথাকার! আজকে একটু হাঁটো বাছা পা আমার! পা হাঁটল। গাড়ি-ঘোড়ার দেখা নেই। চলছে ভ্যান আর মোটরসাইকেল মাঝেমধ্যে। সবই রিজার্ভ কিংবা ব্যক্তিগত বাহন। আমরাও আমাদের ব্যক্তিগত পা রিজার্ভ করে এনেছি। গাড়ি আনতাম রিজার্ভ করে, যদি বুঝতে পারতাম আগে। কিন্তু আমাদের বুঝকে তখন খুঁজে পাওয়া যায়নি কোথাও। হাঁটতে হাঁটতে চারটা গার্ড পয়েন্ট শেষ ততক্ষণে। পঞ্চম গার্ড পয়েন্টের ডিউটিরত বিজিবি সদস্যটি আমাদের ডেকে বসালেন। চেয়ার আর বাঁশের বেঞ্চ রেডিই থাকে সব পয়েন্টে। বসলাম আমরা। তিনি শুরু করলেন আদ্যোপান্ত জিজ্ঞেস। উত্তর দিতে দিতে একসময় আলাপ জমে উঠল খোশগল্পে। ভদ্রলোকের বাড়ি নড়াইল। তিনি শুরু করলেন ব্রেন ওয়াশ। নানা পরামর্শ। সন্তানের কর্তব্য। সেই সঙ্গে তাঁর কথার ভেতরে ফুটে উঠল নিঃসঙ্গ ডিউটি-জীবনের গুমরে মরা বেদনা। আমি তাঁর বেদনা দেখে ফেললাম চট করে। বউ-বাচ্চা-সংসারের মুখ হয় না দেখা সব সময়!

ছুটি মেলে কম। তিনি বললেন, ‘দিব্যি সুখে আছি অনেকেই মনে করে! সরকারি চাকরিজীবী বর পাওয়ার জন্য কত মেয়ে উন্মুখ! কত অভিভাবক তীর্থের কাকের মতো পইপই করে ঘুরছেন! জামাতাটা তাঁর সরকারি চাকরিজীবী হোক!’ কিন্তু বিজিবির এ লোকটি ধিক্কার দিলেন সেসব লোককে। রাত জেগে করো ডিউটি! মাথার সেলগুলো হয়ে পড়ে দুর্বল। নিঃসঙ্গ এক কাতরতা দুঃখ হয়ে ফোটে কাঁটার মতো। আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি বিজিবি বন্ধুরাই সবচেয়ে বেশি কথা বলতে চায় সঙ্গ পেলে। ফোন করলে ছাড়তে চায় না। আসলে দীর্ঘদিনের দীর্ঘশ্বাস এরা ছাড়ে এভাবেই। আজকের এই বিজিবি সদস্যকে শুধু পোশাক পরা বিজিবি ভাবতে পারলাম না আমি! মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাঁদের কী নিঃসঙ্গতার কষ্ট! আসলে সব পোশাকের ভেতরেই রয়েছে একটা মানুষ, মানুষের ভেতরে একটা মন, মনের ভেতরে বাস করে গুমরে মরা বেদনা!

গল্প করতে করতে বেলা তখন পরিণত হলো অনেক বেলায়। বিজিবির লোকটি গল্প থামাতে চান না! কী বিপদ! তিনি তুলে ধরতে থাকলেন সীমান্তবর্তী মানুষের দৈনন্দিন জীবনকথা। এক ভাই সীমানার এপারে; ওপারে অন্য ভাই। গরু ধান খেয়েছে বাংলাদেশ থেকে ভারতে গিয়ে, ভারত থেকে ছাগল এসেছে এপারে। বিজিবি আর বিএসএফের সমঝোতায় মিটে যায় দ্বন্দ্ব আবার। তাঁর এত গল্প আর শুনতে ভালো লাগছে না আমার। আমার মন শুটিং স্পটে। কোনোরকমে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চলতে থাকলাম সামনে। আমার পা আর হাঁটতে চায় না; ঘাড়ুমাড়ু করে। জোর করে হাঁটাচ্ছি পা–কে। এত দূর হাঁটতে হবে জানলে নিয়ে আসতাম কেডস; জানতাম না বলে আনিনি। পায়ে ফোসকা উঠেছে আমার, ক্ষুধার ঘুম ভেঙে গেছে পেটে! জেগে উঠেছে বিক্ষুব্ধ ঘুমজাগা ক্ষুধা।

আমরা সীমানা বিশ্লেষণ করতে করতে এগোতে থাকলাম। সীমানা দেখলে হাসি পায় কিন্তু কিছুই করার নেই। এখানে কাঁটাতারের বেড়া দিতে গেলে দিতে হবে মানুষের বুকের ওপর দিয়ে; ও অসম্ভব। এসব নিয়ে ভাবছি। কাঙ্ক্ষিত সেই স্থানে পৌঁছে গেলাম ভাবতে ভাবতেই কখন। শুক্রবার। আজান অনেক আগেই হয়েছে। সময় প্রায় কাছাকাছি দেড়টার। সেই বটগাছ। পাশাপাশি দুটি গাছ বেড়ে উঠেছে রাস্তার দুই ধারে। পাকা জায়গা, পাকা করা গাছের গোড়া। আমার পা তখন কাতরাচ্ছে। পা একটু বসতে চায়। বেশ ঠান্ডা ছায়াযুক্ত জায়গা। কিন্তু বসে আছেন দুজন বিজিবি সদস্য, বাকি একজন ওখানেই পড়ছেন নামাজ। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করলাম আমরা। পশ্চিম পাশ্বে ইছামতী নদী, ফাঁকা একটা ছোট্ট মাঠ। উত্তর দিকে ভারত আর বাংলাদেশের এ তালগোল পাকানো সীমানা। অপূর্ব সুন্দর একটা ভারতীয় মসজিদ চোখে পড়ল সবার আগে। কিন্তু মসজিদের মুসল্লি উভয় দেশের। যে বিজিবি সদস্য বটের ছায়ায় নামাজ পড়ছিলেন তিনি নামাজ শেষ করে জিজ্ঞেস করলেন আমাদের নাম। আমরা তখনো দাঁড়িয়ে। নাম জিজ্ঞেস করার পর তিনি বললেন, ‘এখন তো আপনাদের মসজিদে থাকার কথা!’
‘জি, আমরা মসজিদে যেতেই এখানে এসেছি। তা ছাড়া আমরা বাংলাদেশ-ভারতের কাঁটাতারবিহীন এই এলাকাটাও এসেছি ঘুরতে।’ আবীর ঝটপট উত্তর দিল।

বিজিবির এ সদস্যটি একটু সিনিয়র। সিনিয়র ভঙ্গিতেই ইতস্তত করলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘না, এ মসজিদে যাবে না যাওয়া। আপনারা পাশের একটা মসজিদ থেকে পড়ে আসুন নামাজ। এরপর এখানে আসবেন, আমরা ঘুরতে দেব।’ মূলত এ স্থানে যে মসজিদ, সেটি ভারতের ভূখণ্ডে। কিন্তু উভয় দেশের লোকই এখানে নামাজ পড়েন। কোনো কাঁটাতার নেই এখানে। কায়দা নেই কাঁটাতার দেওয়ার। প্রথম প্রথম দেখলে মনে হবে ভারতের মধ্যে বাংলাদেশ আবার ভারত বাংলাদেশের মধ্যে। যা–ই হোক, যেতে হবে দূরের মসজিদে। আমার পায়ের আর ইচ্ছে নেই মোটেও হাঁটার। তবুও যেতে হলো বিজিবির লোকেশন বলে দেওয়া মসজিদে। প্রায় আধা কিলোমিটার দূর। নামাজ শেষ করে আবার ফিরে এলাম আমরা। সিনিয়র সেই বিজিবি এবার নিজেই শুরু করলেন খোশগল্প। সবিনয়ে জানালেন, ‘একজন থাকলে এই মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে দিতাম আমরা কিন্তু তিনজন আপনারা। এখানে অবশ্য স্থানীয় বাংলাদেশিরাও পড়ে নামাজ। বিজিবি, বিএসএফ, ভারতীয়, বাংলাদেশি এখানকার সবার ভেতরেই আছে একটা সমঝোতা।’

বিজিবির কথা আমার লাগছিল না ভালো। কেননা বহিরাগত দু-একজনকে বিশেষ শর্তে এখানে পড়তে দেওয়া হয় নামাজ। মসজিদের একটু ওপাশেই বিএসএফ ক্যাম্প, এপাশে বিজিবি। সুযোগ নেই ফাঁকির। ভারতীয় মসজিদ হাতের কাছে পেয়েও নামাজ পড়তে পারলাম না বলে মনটা একটু শূন্য শূন্য আমার। সিনিয়র বিজিবি সদস্যটি আমাকে ডাকলেন, বলে দিলেন আমরা এ গোলতাল পাকানো সীমানার স্থানাগুলো কীভাবে ঘুরে আসব, তার রূপরেখা।

‘ওই যে সামনেই দেখা যাচ্ছে একটা  বাড়ি, এই রাস্তা ধরে ওই বাড়ি পর্যন্ত যাবেন সোজা। ওটা বাংলাদেশ এবং ভারতের উভয় সীমানায়। ওখান থেকে চলে যাবেন সোজা বাঁয়ে তালগাছের গোড়া দিয়ে। ঘুরবেন না কিন্তু মোটেও এদিক–ওদিক, সব ভারতের বাড়ি। তারপর বেড়িবাঁধে উঠে সোজা এদিকে চলে আসবেন নদীর পাশ দিয়ে। এ রাস্তাটা ভারতের, ওই ঘুরে আসা রাস্তাটা আমাদের।’ এই লোকেশন যখন বিজিবি বললেন তখন র‍্যাডক্লিপ রেখা উড়ে গেল আমার মাথার ওপর দিয়ে! কী বললেন বুঝে উঠলাম না! আসলেই তা–ই। এখানের সীমানা প্রথমবার চেনা কারোর জন্যই অতটা সোজা নয়! জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র সাতক্ষীরা পর্বে শুরুর ৩৬ মিনিট পর তুলে ধরা হয়েছে এই মজার সীমান্তকে। আবার ‘শঙ্খচিল’ সিনেমায় শুরুর ১২ মিনিট পর দেখানো হয়েছে এই মজার জায়গাগুলো।
আমি ওই বিজিবিকে তখন বললাম, ‘স্যার, বুঝতে পারলাম না কীভাবে গিয়ে আসব কীভাবে ফিরে! যদি আরেকটু বলে দিতেন!’ তিনি বললেন, এখানে নতুন যে কারোরই গুলিয়ে যাবে সীমানা, এত প্যাঁচ! আমিও এখানে নতুন জয়েন্ট করার পর ফেলতাম গুলিয়ে!’ জুনিয়র আরেকজন বিজিবিকে তিনি বললেন পুরো এলাকাটা আমাদের ঘুরিয়ে দেখাতে। আমাদের নিয়ে গেলেন সেই জুনিয়র বিজিবি সদস্য। আমরা আনন্দে ধন্যবাদ না দিয়ে পেরে উঠিনি। ভদ্রলোকের বাড়ি পটুয়াখালী। তিনি আমাদের বোঝাতে বোঝাতে নিয়ে গেলেন সীমানার প্যাঁচগুলো। আমরা সোজা একটা বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম প্রথম।

দুই দেশের সীমানারেখা এ বাড়ির ওপর দিয়ে গেছে চলে। যে রাস্তা দিয়ে গেলাম সেটা বাংলাদেশের রাস্তা। ওখান থেকে ভারতের রাস্তা দিয়ে আবার ঘুরে ঘুরে আসতে হবে বাংলাদেশের রাস্তায়। মধ্যে সব ভারতের বাড়ি, সেই মসজিদ। মসজিদের গায়ে ইংরেজি লেখা দেখে বুঝলাম এটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পানিতর গ্রাম। বাংলাদেশের গ্রামটির নাম অবশ্য ‘হাড়দ্দাহ’।

বিজিবির লোকটি হিজিবিজি করে একটা কথা উঠলেন বলে, ‘ওদিকটায় যাবেন না খবরদার! ওই যে দেখেন বিএসএফ ক্যাম্প! ওখানে গেলে করবে ঝামেলা।’

আমরাও অ-ঝামেলার লোক৷ এই যে দেখুন কী আশ্চর্য! দুই দেশ, পিলারে আলাদা হলো; কিন্তু মানুষকে বিভক্ত করতে পারেনি র‍্যাডক্লিপের জিরো লাইন। দিব্যি পড়শির মতোই বসবাস করছে মানুষ এখানে। এরপর সেখান থেকে নদীর পাশ দিয়ে এলাম পেছন দিকে, দেখলাম ফাঁকা ছোট্ট মাঠ, নদীর তীর আমার ইছামতীর। বড় একটা চৌকোনা পিলার সাদা রং মেখে দাঁড়িয়ে আছে ঘাসের বুকে। তাতে লেখা ‘1 MP’। এই হলো বাংলাদেশ-ভারত বিভক্ত করার ১ নম্বর পিলার। বেড়িমুক্ত পিলারটির দুই পাশ ভারত, বাংলাদেশ দুই পাশ। অথচ পিলার একটাই, ভাগ দুই দেশেরই! এখান থেকেই শুরু ভারত-বাংলাদেশ সীমানার পিলারের ক্রমিক নম্বর। শঙ্খচিল সিনেমায় শাহেদ আলী তাঁর ডায়ালগে যাকে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের বুকে প্রথম চাকু এটি।’

  • লেখক: হিমাদ্রি হাবীব, সরকারি কলেজ মোড়, রাজার বাগান, সাতক্ষীরা।