কুতুবদিয়া ভ্রমণ: নীল সাগরের মোহনায় এক দিন
এখন ট্যুর মানেই হুটহাট রওনা—এমনটা খুব কমই হয়। তারিখ ঠিক করতে হয়, হাতে সময় মেলাতে হয়, প্ল্যান করতে হয়, তা–ও আবার শেষ মুহূর্তে কেউ না কেউ বাদ পড়ে যায়। কুতুবদিয়া যাওয়ার ইচ্ছাটা ছিল অনেক দিনের, কিন্তু ফাঁকফোকরে অন্য জায়গায় ঘুরে আসা হলেও এই দ্বীপে পা রাখা হচ্ছিল না। অবশেষে আমাদের নাইমের একাগ্রতার জোরে, ব্যস্ততা উপেক্ষা করে কয়েকজন মিলে রওনা হলাম সমুদ্রের বুকচিরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই রহস্যময় দ্বীপে।
আমি চাকরির সুবাদে থাকি চকরিয়া। চকরিয়া থেকে পেকুয়া হয়ে ঘাটে অপেক্ষা করছিলাম আমার বন্ধুদের জন্য। এক কাপ চা হাতে স্থানীয় একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই বাস থেকে নেমে এল বন্ধুরা। একসঙ্গে যখন হলাম, তখন সকাল প্রায় ১০টা। হালকা নাশতা সেরেই আমরা বোটে উঠে পড়লাম। খাঁ খাঁ রোদ মাথায় নিয়ে, পুরো বোট মাতিয়ে রেখে দ্বীপে পৌঁছেই প্রথম গন্তব্য ঠিক করলাম কুতুবদিয়া বাতিঘর।
শতবর্ষী এই বাতিঘর যেন সময়ের নীরব সাক্ষী—সমুদ্রের গর্জন আর লবণাক্ত হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক দৃঢ় প্রহরী। কুতুবদিয়া ঘাট থেকে বাতিঘর পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা ছিল শোচনীয়। যে টমটমে গিয়েছিলাম, সেই টমটমেই আবার মাজার পর্যন্ত ফিরব বলে অপেক্ষা করিয়ে রেখেছিলাম। বাতিঘরের পুরো এলাকা ঘুরে স্মৃতি ধরে রাখতে কিছু ছবি তুলি। এরপর হজরত কুতুবউদ্দীন মালেক শাহ (রা.)–এর মাজারে পৌঁছাই। পবিত্র জুমার নামাজ শেষে মাজার প্রাঙ্গণে শুরু হলো সবার জন্য বিনা মূল্যে খাবারের আয়োজন। মাটির পাত্রে আসতে থাকে খাবার। ধনী-গরিব, স্থানীয়-পর্যটক, সবার জন্য একই খাবার। ভ্রাতৃত্ব আর সমতার মিশেলে পুরো দরবারে অন্য রকম এক আবহ ছড়িয়ে পড়ে।
মাজার থেকে বের হয়ে টমটমে চড়ে রওনা দিলাম কুতুবদিয়া বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে। পথের দুই ধারে চোখে পড়ল বিশাল লবণমাঠ—সূর্যের আলোয় সাদা লবণ যেন মুক্তার মতো ঝলমল করছে। মাঝেমধ্যে দেখা মিলল লোনাপানির ছোট খাল, আর সেই খালের ধারে গরু-ছাগল চরছে।
ঘাটে পৌঁছে টমটমে এলাম নতুন রাস্তার মাথায়। দেখলাম, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামগামী কোনো লোকাল বাসেই ওঠার ন্যূনতম সুযোগ নেই। ক্লান্তি, তাড়াহুড়া আর অনিশ্চয়তার মধ্যে হালকা অস্থিরতা। তবু সেই মুহূর্তেও হাসি থামেনি। হয়তো ভ্রমণের আনন্দই এমন—সব অস্বস্তি ছাপিয়ে দেয়।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছে দেখি তেমন ভিড় নেই মানুষের, নেই অহেতুক দোকানের ভিড়ভাট্টা। কেবল বিশাল সব টারবাইন আর সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ। মানুষের ভিড়ের বদলে সেখানে পাওয়া গেল স্থানীয় কিছু শিশু, যারা মেতেছে ফুটবল নিয়ে।
সমুদ্রের পাড়ে ঢেউয়ের তালে পা ভিজিয়ে অনেক হাঁটা হলো, ছবি তোলা হলো। সমুদ্রপাড়ে হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ে খোলা জায়গায় মানুষের মলমূত্র ত্যাগ, যা এই সুন্দর জায়গার সৌন্দর্যে কিছুটা কালিমালিপ্ত করে দিচ্ছিল।
বাতাসে লবণাক্ত গন্ধ, ঢেউয়ের ছন্দময় শব্দ—সব মিলিয়ে যেন এক অন্য রকম প্রশান্তি, নিজেদের আবিষ্কার করলাম কুতুবদিয়া সমুদ্রসৈকতে। অসময়ে ছোট একটা গরুর হাট, সৈকতের অনেকাংশজুড়েই স্থানীয় মানুষের খেলাধুলা, শিশুদের সাইক্লিংয়ে ব্যস্ততা—খুব শান্ত একটা সমুদ্রসৈকত। হঠাৎ ঠিক হলো, সৈকতের বালুতে একটা দৌড় প্রতিযোগিতা হবে। সবাই জুতা খুলে, প্যান্ট গুটিয়ে, শিশুর মতো উচ্ছ্বাস নিয়ে ছুটতে লাগলাম। হেসেখেলে হারিয়ে গেলাম বিকেলের রোদে।
এরপর সূর্য যখন ধীরে ধীরে সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছিল, আকাশে লাল-কমলা রঙের অসাধারণ ছোঁয়া ছড়িয়ে দিচ্ছিল, তখন আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ালাম। একে অপরের কাঁধে হাত রেখে, ঢেউয়ের গর্জন আর সূর্যাস্তকে পেছনে রেখে নিজেদের আবদ্ধ করলাম ছবির ফ্রেমে।
সন্ধ্যা নেমে আসতেই আমরা রওনা দিলাম কুতুবদিয়া ঘাটের পথে। বোটে উঠে শুরু হলো গান—আমাদের কণ্ঠে ভর করা সেই আনন্দের সুর, যা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল বোটের ইঞ্জিনের একটানা গর্জনে।
ঘাটে পৌঁছে টমটমে করে এলাম নতুন রাস্তার মাথায়। কিন্তু সেখানে এসে দেখা গেল, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামগামী কোনো লোকাল বাসেই ওঠার ন্যূনতম সুযোগ নেই। ক্লান্তি, তাড়াহুড়া আর অনিশ্চয়তার মধ্যে সবার মুখে হালকা অস্থিরতা। তবু সেই মুহূর্তেও হাসি থামেনি। হয়তো ভ্রমণের আনন্দই এমন—সব অস্বস্তি ছাপিয়ে দেয়। অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজির পর গাড়ি মেলে, বন্ধুদের শহরের গাড়িতে তুলে দিয়ে আমি ফিরি চকরিয়া আমার বাসার দিকে।
কুতুবদিয়ার নোনা হাওয়া, সোনালি বিকেল পেছনে রেখে ফিরছি। দূরে সরে গেল দ্বীপ, তবু যেন মনে হলো কুতুবদিয়া রয়ে যাবে আমার ভেতরে হয়তো অনেক দিনের জন্য, হয়তো চিরদিনের জন্য।