হাকালুকি হাওরের বৃষ্টিদিন
হাওরের হৃদয়কাড়া রূপে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং বিমোহিত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা হাওরকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘উড়াল পক্ষীর দেশ’ বলে। প্রাচীন গ্রন্থসম্ভারের পসরা খুলে বসলে আপনার মনোজগতে পূর্ববঙ্গ হয়ে যাবে এক ‘উড়া পক্ষীর দেশ’। ওপরে নীল আকাশ আর নিচে অথৈ স্বচ্ছ জলরাশির সরোবর…জলের ওপর বয়ে চলেছে ছোট–বড়–মাঝারি নানা আকৃতি ও মাত্রার নৌকা। জলরাশির মধ্যে নিমজ্জিত না হয়েও জেগে ওঠা হিজল, করচ, কলমিতে জলকেলি করতে করতে আপনি হয়তো পেয়ে যাবেন নয়নকাড়া সবুজ জলজ বনের রাজ্য এক। কোনো এক ভরদুপুরে বিষ্মিত হতে হতে আপনি হয়তো ভাববেন—এই বনের রাজাধিরাজ তাহলে কোথায়?
এশিয়ায় সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ হাওর বোধ হয় ‘হাকালুকি হাওর’। কেননা পূর্বে পাথারিয়া ও মাধব পাহাড় এবং পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড় পরিবেষ্টিত হাকালুকি হাওর মৌলভীবাজার ও সিলেটের পাঁচটি উপজেলায় বিস্তৃত হয়ে তার রূপের নহর ছুটিয়েছে। বলা হয়, কুলাউড়া অঞ্চলে এই হাওর মেলে ধরেছে তার রূপের ১৫ ভাগ শানশওকত। আমরা এক্ষণে আছি যে অঞ্চলে, এখানে নাকি হাওরের সৃজনশীল রূপ সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত। কুলাউড়া শুধু জল, জোছনা, চা–বাগানের ছায়াঘেরা শহরই নয়, দেশের অন্যতম সীমান্ত শহরও। যার একবাহু জুড়ে ত্রিপুরা প্রদেশ। এখানে শহর ছাড়িয়ে অনতিদূরে গ্রামের লোকেরা লোকগানের পসরা নিয়ে বসেন। তাঁদের কণ্ঠে হাসন রাজা, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম সম্প্রীতির বন্ধনে লীন হয়ে অমরত্বের ঠিকানা খুঁজে নেন।
বর্ষা ও শীত—উভয় ঋতুই কুলাউড়া ঘুরে বেড়ানোর জন্য উপযোগী। আমরা যখন প্রকৃতির সবুজাভ মোহে আচ্ছন্ন হতে হতে কুলাউড়া শহর থেকে রিকশাযোগে যাচ্ছি আছুরিঘাট, তখন রিকশাচালক বাচ্চু মিয়া জানালেন, সেখান থেকেই ওই সময়টায় সবচেয়ে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করা যাবে ২৮ হাজার হেক্টর আয়তনের বিস্তৃত হাওরটিকে। বর্ষার অতিবৃষ্টি আর উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামার কারণে সেদিন কুলাউড়া-জুড়ি সড়কের আছুরিঘাট প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের দীপ্ত পদভারে আর কলকাকলিতে ছিল জনাকীর্ণ। জেলে অবনী মালাকারের সঙ্গে কথা হলো। তিনি বলেন, ‘গত বছরের মতো এবারও হাকালুকিতে রেকর্ড পরিমাণ মাছ উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।’ বিগত কয়েক দশক যেখানে হাওরে মাছের গড় উৎপাদন ছিল ১৪ হাজার মেট্রিক টন, এ বছর তা প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ১৭ হাজার মেট্রিক টন হবে বলে তিনি আশাবাদী।
কেমন যেন অন্যমনস্কতার ভেতর বয়ে যাচ্ছে নিঃশব্দ মর্মর এক। এই ভরা বর্ষায় সপরিবার আমরা বেরিয়েছি…পাহাড় ও ঝরনার সঙ্গে, যাকে আমরা আমাদের অধিকতর নিকটতম প্রতিবেশী বলেই জানি; সেই ‘হাকালুকি হাওর’ দর্শনে। যাত্রাসঙ্গী আমার ছেলেও দেখছে চঞ্চল স্বচ্ছ জলের গোলকধাঁধা, প্রশ্নোত্তর না পেয়ে তার শিশুমনে যখনই ধরা পড়ছে বাউলিয়ানা; মাঝি যেন তখনই ছোটালেন সিলেটি লোকগীতির এক হৃদয়-বিস্ফোরণ:
কারে দেখাব মনের দুঃখ গো আমার বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া
কারে দেখাব মনের দুঃখ গো আমার বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া
আমার অন্তরে তুষেরই আগুন জ্বলে রইয়া রইয়া...
হাওরের বালিহাঁস ঠোঁটের আগায় বয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বপ্রাণের স্পর্শরস। শরশর শিশুকঞ্চিপাতা যেন রোদের সঙ্গে বাজিগর সাজে। মনের ভেতর প্লাবন আনতে ছুটছি ভাটিস্রোতে…। হরিৎসন্ধানী চোখে অরণ্যঘ্রাণের আদিম-মৃগয়া। সংস্কৃত শব্দ ‘সাগর’ থেকে ‘হাওর’ শব্দের উৎপত্তি বলে গণমানুষের ধারণা।
কালক্রমে হাওর শব্দের উৎপত্তি হয়েছে এভাবে সাগর-সাওর-হাওর। পুরো সিলেট বিভাগই চা–বাগান, পাহাড়, মনোলোভা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে হাওর অঞ্চল হিসেবেও জনপ্রিয়। সেই অর্থে আমরা সৌভাগ্যবান যে হাওরের ভূমিপুত্র আমরা। সুতরাং চিত্ত মেলে দিয়ে হাওরের রূপে মত্ত হয়ে লুটোপুটি খাব না, এটা কি হয়! শুধু হাকালুকি হাওরই নয়, বঙ্গভূমিতে টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির হাওর, টগার হাওর, মাটিয়ান হাওর, দেখার হাওর, হালির হাওর, সানুয়াডাকুয়া হাওর, শৈলচকরা হাওর, বড় হাওর, হৈমান হাওর, কড়চা হাওর, ধলা পাকনা হাওর, আঙ্গরখালি হাওর, নখলা হাওর, চন্দ্রসোনার থাল হাওর, ডিঙ্গাপুতা হাওর…ডানা মেলেছে আরও কত কত নাম।
শারমিন বলেছিল কোনো একদিন, ধরো লোকালয়ের শব্দপুঞ্জে যদি কখনো তোমার বিরক্তি আসে, নৈশঃব্দ্যপ্রিয়তাকে আলিঙ্গন করতে এক ভরা বর্ষায় হাওরের শান্ত জলের সঙ্গে প্রশান্ত বৃষ্টির জল একীভূত করে ধুয়ে নিয়ো তোমার বিহ্বল মন! বর্ষাকে অন্তরে স্থায়ী রূপ দিতে তাই আজকের এই নৌবিহার।
হাকালুকি হাওরের পূর্ব দিক থেকে সূর্যাস্তও নাকি দারুণ উপভোগ্য। ডিঙ্গির মাঝি ধীরে ধীরে জিরো পয়েন্টের দিকে যাচ্ছেন। জানালেন, এখনই শুরু হবে মাছ এবং নানা জাতের পাখির মেলা। মাছগুলোও লম্ফঝম্প করে ক্রীড়া প্রদর্শন করে হঠাৎ নৌকার পাশে বিপরীত দিকে হারিয়ে যাচ্ছে। অতিদূরে দেখা যায়, বিশাল মহিষের পাল নিয়ে গ্রামের পথে রাখালেরা ছুটছেন। কোনো কোনো রাখাল মহিষের মুখে তুলে দিচ্ছেন ঘাস। দেশ ও এশিয়ার বৃহত্তম এই হাওর, যাকে আমরা একই সঙ্গে জানি দেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠা পানির জলাভূমি বলেও। এখানে যে জায়গায় জলের গভীরতা একটু বেশি; সেখানটাতে ডানপিঠে ছেলেমেয়েরা ডুবিয়ে ডুবিয়ে দিনান্তের লাফালাফিতে সেকি মত্ত! আরও খানিকটা সীমিত জলে দেখা গেল ভেসে বেড়াচ্ছে হাঁসের ঝাঁক।
আমরা যখন প্রকৃতির সবুজাভ মোহে আচ্ছন্ন হতে হতে কুলাউড়া শহর থেকে রিকশাযোগে যাচ্ছি আছুরিঘাট, রিকশাওয়ালা অবনী মালাকার জানালেন, সেখান থেকেই ওই সময়টায় সবচেয়ে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করা যাবে ২৮ হাজার হেক্টর আয়তনের হাওরটিকে। বর্ষার অতিবৃষ্টি আর উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নামার কারণে তখন কুলাউড়া-জুড়ি সড়কের আছুরিঘাট প্রকৃতি প্রেমিক মানুষের পদভারে, কলকাকলিতে জনাকীর্ণ। জেলে বাচ্চু মিয়ার সাথে কথা হলো, তিনি জানালেন, গত বছরের মতো এবারও হাকালুকিতে রেকর্ড পরিমাণ মাছ উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিগত কয়েক দশক যেখানে হাওরে মাছের গড় উৎপাদন ছিল ১৪ হাজার মেট্রিক টন, এ বছর তা প্রায় ২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ১৭ হাজার মেট্রিক টন হবে বলে তিনি আশাবাদী’।
শীত মৌসুমে পরিযায়ী পাখিদের আগমনে হাওর যেন পরিণত হয় স্বর্গোদ্যানে। আর এ সময় অতিথি পাখিদের সঙ্গে মিতালি গড়তে ক্যামেরা ট্রাইপড নিয়ে মানুষের জনঘনত্বও বাড়ে হাওরপাড়ে। তবে বর্ষা মৌসুমেও দেখা পেলাম বেশ কিছু অতিথি পাখির।
ছোট-বড় ২৪০টি বিল এবং ১০টি নদীর মেলবন্ধন। হাওরের নীলাকাশে সাদা মেঘের গল্পে ভেসে যায় বিষণ্ন বৃষ্টিরেখা। জলের ভেতর উঁকি দেয় আইড়, চিতল, বাউশ, পাবদা, মাগুর, শিং, কইসহ আরও নানা প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তি পথের মাছগুলো। চারধারে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিঞ্চিৎ উঁচু ভূমি বিলের পানিতে প্রতিচ্ছবি ফেলে সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্যকল্পের। বোরো ধানের ফাঁকা মাঠে সুখের পরশ।
পাখিকুলের সঙ্গে বাউলগানের মুখরতায় তৃপ্তি নিতে নিতে গোধূলিবেলায় আকাশকে পরখ করি। ভাটি বাংলার রূপে আচ্ছন্ন শারমিনের ঘোর কাটতে কিছুটা দেরি হয়। রোদঝলমল আকাশের চেয়ে মেঘে ধৌত আকাশটাই কেন জানি তার বেশি পছন্দ!
ভাবছি, রাতের খাবার আগেই প্রস্তুত করা ডিমভুনা, খিচুড়ির কথা। এর জন্যই কি সে বাসায় ফিরতে তেমন তাড়না অনুভব করছে না? নদী বাওয়া বাতাস, ঠান্ডা ভিজে মাটি নৌকার মাঝি সবরু খাঁকেও এতক্ষণে রোমাঞ্চিত করে তুলেছে। তিনি বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে কোমরে থাকা ডার্বি সিগারেটের প্যাকেট খুললেন।
রোঁয়া ওঠা নরম ফুল নৌকা থেকে কচি হাতে কুঁড়িয়ে বেশ বিনোদিত আমার ছেলে। আমার শৈশবকে মনে করিয়ে দেয়! মনের মধ্যে বেঘোরে ঘুমিয়ে থাকা সেই শিশুটিও যেন কাঁকিয়ে ওঠে, হাত-পা নাড়ে। কিছু একটা হারিয়ে ফেলে খুঁজে পাওয়ার উল্লাসে লিখে ফেললাম—আস্ত একটি কবিতা! নাম ‘হাওরের দাগ’।
কৈশোরের আকুল আগুন
ছুঁয়েছিল জলমন্ত্র...
যে হাওরে স্রোত বেশি
সে হাওর জুড়ে নাকি; প্রেতিনী-ডাকিনী?
হাসে অন্তরাত্মা
হাওরের কলস্তরে কথকতা...
একেক ঋতুতে একেক যাপন
জ্যোতির্ময় লীলাময়, প্রভু ও পরম
বলি; হাকালুকি হাওর কি তোমার-আমার
ইচ্ছাজলে সুগঠিত-
শীতল-আশ্রম?
ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিদের মুক্তির বাহাস
মানুষের ঠোঁটে ক্রুশবিদ্ধ
অতিথি পাখির মতোই লাফাচ্ছে
হাওরের ‘রানিমাছ’; নয়নাভিরাম!
ভাবতে গেলেই অ্যাবসার্ড
হাওরের ফসলি ভূমিতে না তাকিয়ে-
দিগন্তরেখায় খুঁজি
দুষ্কর্মের দাগ।।