কুমিল্লাতে একদিন
কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকাল। আমি আর তূর্য ভাই ভৈরব বাজার জংশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। গন্তব্য কুমিল্লা। সেখানকার ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখাই মূল উদ্দেশ্য।
নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে ট্রেন স্টেশনে এল। প্রথমে কিছুটা হতাশ হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে পুনরায় প্রফুল্ল অনুভব করলাম। কারণ, কুয়াশার পর্দা ছিঁড়ে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। আমরা যাচ্ছি ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো স্বচক্ষে দেখতে। সে কি কম আনন্দের! একের পর এক স্টেশন পেছনে ফেলে আমরা ছুটে যাচ্ছি। সেসব স্টেশনের কত যে বাহারি নাম! তালশহর, পাঘাচং, গঙ্গাসাগর, ইমামবাড়ি, কসবা, মন্দবাগ, সালদানদী, শশীদল, রাজাপুর, সদর রসুলপুর—বেশ শ্রুতিমধুর নাম।
দেখতে দেখতে দুপুর ১২টা বেজে ১৫ মিনিট, কুমিল্লা রেলস্টেশনে পৌঁছালাম। সেখান থেকে প্রথমে কিছুটা পথ সিএনজিচালিত অটোরিকশা এবং কিছুটা পথ রিকশায় চড়ে আমরা গেলাম রানি ময়নামতির প্রাসাদে। দুপুরে সূর্যের আলোয় চারদিক জ্বলজ্বল করছিল। ১০ একর আয়তনবিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি অরক্ষিত পড়ে আছে দেখলাম। আরও কাছে গিয়ে দেখলাম, পোড়ামাটির ইট দ্বারা নির্মিত বেশ পুরু প্রাচীরগুলো এখনো টিকে আছে। এরই মাঝে একটি কূপসদৃশ চোখে পড়ল। সেখানে প্রবেশের জন্য সরু পথ রয়েছে। ভয়ে ভয়ে সেদিক দিয়ে ঢুকলাম। তূর্য ভাই ওপর থেকে দাঁড়িয়ে আমার ভয় পাওয়া চেহারার ছবি তুললেন।
আবার রিকশায় চড়ে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রির দিকে গেলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের কবরস্থান এই ওয়ার সিমেট্রি, যেখানে এক হয়ে শুয়ে আছে হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্ট্রান প্রভৃতি ধর্মাবলম্বী মানুষ। তাদের প্রত্যেকের কবরের পাশে শোভা পাচ্ছে বর্ণিল ফুল। পুরো জায়গায় সতেজ ঘাস জন্মে আছে, যেন পরিষ্কার সবুজ কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে কেউ।
রোদের তীব্রতা কমে আসতে লাগল। শালবন বিহারের দিকে রওনা হলাম আমরা। সেখানে ঘুরে দেখার মতো তিনটি জায়গা রয়েছে। প্রথমে গেলাম নব শালবন বিহার বা শান্তি প্যাগোডায়। অনেক দূর থেকেই এটির চূড়া দেখতে পাওয়া যায়। এরপর এখানে যা চোখে পড়ে, তা হলো সোনালি রঙের বিশাল বুদ্ধমূর্তি। জানলাম এটির উচ্চতা প্রায় ৩০ ফুট এবং ওজন ৬ টন! প্যাগোডার ওপরে ওঠার তিন দিকে সিঁড়ি এবং সিঁড়ির দুপাশেই সোনালি বর্ণের নাগরাজের প্রতিকৃতি দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিটি প্রতিকৃতির কাছে ক্ষুদ্র সাইনবোর্ডে লেখা, ‘নাগরাজ স্পর্শ করবেন না। আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ’।
শুভ্র দেয়াল আর পরিচ্ছন্ন চারপাশ। সর্বত্র ফুল ফুটে আছে। সৌন্দর্য উপভোগ করতে নানান সম্প্রদায়ের মানুষের আনাগোনা দেখতে পেলাম। মধ্যাহ্নভোজনের জন্য আমরা কিছুটা সময় রেখে দিলাম। রাস্তার পাশে সারি সারি ক্ষুদ্র রেস্তোরাঁ। রঙিন কাপড় দিয়ে বাঁধা দেয়াল এবং মাথার ওপর ত্রিপল দিয়ে বানানো ছাদ। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলাম সেখানে লোকজন বেশ আরাম করে খাবার খাচ্ছে। তা দেখে আমরাও ভূরিভোজের উদ্দেশ্যে টেবিলে বসে পড়লাম।
অদূরেই শালবন বিহার। আমরা মধ্যাহ্নভোজন শেষ করে সেখানে প্রবেশ করলাম। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের সঙ্গে মিশে গেলাম দ্রুত। বইয়ের পাতায় শালবন বিহারের কথা অনেক পড়েছি। কিন্তু সেদিন আমার কল্পনা আরও প্রসারিত হলো। হাজার বছরের পুরোনো এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি দেখলে চোখ জুড়ায়। বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থিত এই বিহার। পোড়ামাটির ইটগুলো যেন রোদে চকচক করছে। যুগ যুগ ধরে এই স্থাপনাগুলো এখনো কেমন অক্ষত হয়ে আছে! দেববংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এটি নির্মাণ করেছিলেন। এখানে মোট ১১৫টি কক্ষ রয়েছে। কক্ষগুলোয় থেকে একসময় বৌদ্ধভিক্ষুরা ধর্মচর্চা এবং বিদ্যাশিক্ষা লাভ করতেন।
শালবন বিহার আবিষ্কারের পর সেটি খননকালে বেশকিছু পুরাসামগ্রী পাওয়া গিয়েছিল। সেসব বর্তমানে প্রদর্শিত হচ্ছে পাশেই ময়নামতি জাদুঘরে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি স্থাপনা থেকে প্রাপ্ত মূল্যবান পুরাবস্তু এই জাদুঘরে রাখা আছে। সেসব দেখতে শালবন বিহার থেকে বেরিয়ে আমরা ময়নামতি জাদুঘরে প্রবেশ করলাম। এখানে এসে দেখলাম পোড়ামাটির ফলক, ধাতব মুদ্রা, ব্রোঞ্জ ও পাথরের মূর্তি, লিপিফলক, গৃহে ব্যবহৃত বিভিন্ন তৈজসপত্র, অলংকারের অংশ, মৃৎপাত্র প্রভৃতি। পুরাবস্তুগুলো মোট ৪২টি আধারে প্রদর্শিত হচ্ছে। সেসব দেখলে বাংলার প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সহজেই আঁচ করা যায়।
সন্ধ্যা নামার আগেই আমরা স্টেশন অভিমুখে রওনা হলাম। শেষ সময়ে তূর্য ভাইয়ের পরিচিত আদিব এসে যুক্ত হলো। বাড়ি কুমিল্লায়। তারপর তিনজনে চায়ের কাপ হাতে নিলাম। ট্রেন স্টেশনে আসা অবধি নানান বিষয়ে গল্প করলাম। স্মৃতি হিসেবে থাকল বেশকিছু ছবি। সব অভিজ্ঞতা জমা হতে হতে স্টেশনে ট্রেন এসে থামল। আমি আর তূর্য ভাই নিজেদের বগিতে উঠে বসলাম। আদিব আমাদের হাত নেড়ে বিদায় জানাল। ইতিমধ্যে ট্রেন আমাদের নিয়ে ভৈরবের উদ্দেশে চলতে শুরু করেছে।