লেক-পাহাড়ের অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাঙামাটিতে দুই দিন
একসঙ্গে লেক–পাহাড়ের এক অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাঙামাটি জেলা। যেন কোনো এক শিল্পীর রংতুলিতে আঁকা ক্যানভাস! আর সেই সৌন্দর্যের ভূমিকে স্বচক্ষে দেখার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া। সময়টা ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর। রাতের বাসে ঢাকার শনির আখড়া থেকে চড়ে বসলাম। সফরসঙ্গী চাচাতো-মামাতো সম্প্রদায়, ছোট ভাই আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু (ওর রাঙামাটি সদরে স্কুল–কলেজজীবন)! যখন রাঙামাটির ঘাঘরার আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে বাস যাচ্ছিল শীতের সকালে, মনে হচ্ছিল এখনই বুঝি সামনের খাদে বাস পড়ে গেল! কিন্তু না, বাসের ড্রাইভার বিচক্ষণতার সঙ্গে জায়গাগুলো অতিক্রম করলেন! এ যেন এক অ্যাডভেঞ্চার! বাসের সামনের সিটে বসে উপভোগ করতে করতে রাঙামাটি সদরে পৌঁছে গেলাম! তখনই শুরু হলো বৃষ্টি! আগে থেকেই ফ্রেন্ডের ফ্রেন্ডের মাধ্যমে বুকিং করে রাখা হোটেলে উঠলাম।
প্রথম দিন (২৮-১২-২০২৩)
সকাল সাতটার দিকে হোটেলের পাশের এক রেস্তোরাঁ থেকে সকালের নাশতা খেয়ে বেরিয়ে পড়ি সৌন্দর্যের রানি রাঙামাটি দেখতে। আমরা রিজার্ভ বাজারে গিয়ে বোটে উঠি, যেটি পুরো দিন আমাদের কাপ্তাই হ্রদের আশপাশ ঘুরাবে। প্রথমেই আমরা যাই পাহাড়ি বাজারে। সেখানে গিয়ে ১৫ মিনিটে বাজারের আশপাশ ঘুরি। এখানকার পণ্য এখন সবখানেই দেখা যায়, প্লাস দেখলাম এখানে বাইরের তুলনায় দামও বেশি। তাই আমরা সময় নষ্ট করিনি।
চলে যাই বৌদ্ধমন্দিরে। বৌদ্ধমন্দিরের ওপরে পেছনের দিকের জায়গাটা চোখের তৃষ্ণা মেটে এমন একটা জায়গা। আপনি যদি ভ্রমণপিপাসু হন, যার কিনা প্রকৃতি দেখে পেট ভরে। যদি পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখেন, আমি নিশ্চিত আপনি এ রাঙামাটির প্রেমে তখনই পড়ে যাবেন।
তারপর আমাদের গন্তব্য সুবলং ঝরনা। এটি রাঙামাটির বরকল উপজেলায়। শীতের সময়ে গিয়েছি, ওই সময় কোনো ঝরনায় পানি থাকে না। কিন্তু সকালের বৃষ্টির কারণে আমরা কিছুটা পানি দেখি ঝরনায়। এর মধ্যে দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। চলে গেলাম বরকল উপজেলার প্রথম প্রান্তে পেদা টিং টিং-এ। সেখানে আমরা দুপুরের খাবার খাই।
খাবার খেয়ে আমাদের গন্তব্য ঝুলন্ত ব্রিজ। শীতের বিকেল তাড়াতাড়ি গড়িয়ে যায়। আমাদের বেলায়ও তা–ই হলো। বিকেল উপভোগ করতে করতে রাঙামাটি সদর হয়ে ঝুলন্ত ব্রিজের উদ্দেশে নৌকা চলতে থাকে। তখন বসে বসে আমরা কাপ্তাই হ্রদ উপভোগ করছিলাম আর তার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা। কীভাবে একটি রাজপ্রাসাদ পানির অতলে তলিয়ে যায়। নৌকার মামা আমাদের এ ইতিহাস বলছিলেন। তারপরই তিনি দুই বিদেশি পর্যটক দম্পতির কথা বলেন। যাদের ভালোবাসার স্মৃতিচারণায় রাঙামাটির পলওয়েল পার্কে লাভ পয়েন্ট বানানো হয়। তাদের মৃতদেহ কোথায় পাওয়া যায় এবং তলিয়ে যাওয়া রাজপ্রাসাদটি কোথায়, মামা আমাদের সে জায়গাটিও দেখিয়ে দেন।
তারপরই আমরা পৌঁছে যাই ঝুলন্ত ব্রিজে! সেখানটায় ঘুরে আমরা আবার নৌকায় উঠি। এরই মধ্যে আমরা সেখানকার আনারসের স্বাদ নিতে আনারস নিয়ে নিই। আনারস খেতে খেতে পলওয়েল পার্কে পৌঁছে গেলাম। সূর্য মামা তখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়ছেন। নৌকা মামা আমাদের পলওয়েল পার্কের টিকিট এনে দেন। তিনি ঝুলন্ত ব্রিজেরও টিকিট এনে দিয়েছিলেন! কারণ, তিনি নাকি কমিয়ে টিকিট কাটাতে পারবেন। আমরা মামাকে সারা দিনের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় জানাই।
পলওয়েলে বন্ধুর আরও দুই বন্ধু এসে উপস্থিত। এদের মধ্যে একজন আমাদের হোটেল আর বোটের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। পলওয়েলে কায়াকিংয়ের ব্যবস্থা আছে! আমরা কায়াকিং করি। সারা দিনের ঘোরাঘুরি শেষে ফ্রেশ হওয়ার তাগিদে পলওয়েল পার্কে এক ঘণ্টা কাটিয়ে সেখান থেকে সিএনজিতে হোটেলে পৌঁছায়!
হোটেলে ফ্রেশ হয়ে আমরা চলে যাই রাঙামাটির কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে! কিছুক্ষণ আড্ডা ও মালাই চা খেয়ে সিএনজিতে চলে যাই বনরূপায়। বনরূপাবাজার ঘুরেফিরে দেখে রাঙামাটির টিএসসি খ্যাত এলাকায় চা খেয়ে, আড্ডা দিয়ে আমরা দোয়েল চত্বরে চলে যাই রাতের খাবারের জন্য। রাতের খাবার সজীবের রান্নাঘর থেকে সেরে নিই। রাত ১১টা অবধি আমরা সেখানে আড্ডা দিই। কিছু খাবার কিনে নিই পরদিন সকালের জন্য। সকালে যাব রাঙামাটির ফুরমোন পাহাড়ে।
২য় দিন (২৯-১২-২০২৩)
ভোর পাঁচটায় ফুরমোন এলাকায় থাকার কথা থাকলেও প্রশান্তির ঘুম ভাঙে ভোর পাঁচটার দিকে! রাতেই সিএনজি ঠিক করা হয়েছিল। উনি এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমরা ১৫ মিনিটে সবাই ফ্রেশ হয়ে সিএনজিতে উঠি। চালক খুব দ্রুত টেনে ৫টা ৫০ মিনিটের দিকে ফুরমোনের পাদদেশে নামিয়ে চলে যান। পরে নামার সময় কল দিলে উনি আমাদের নিতে চলে আসবেন।
শীতের কুয়াশাজড়ানো পরিবেশে যেখানে ১৫-২০ মিটার দূরের কিছু দেখা যায় না। পাহাড়িদের চলাচলে তৈরি হওয়া উঁচু–নিচু রাস্তা দিয়ে উঠতে থাকলাম। ৩০ মিনিট ট্রেকিং করে ওঠার পর এক পাহাড়ি দেখতে পেলাম। জিজ্ঞাসা করছিলাম আর কত দূর? তিনি বললেন বেশি না, ১৫ মিনিট! আর সে ১৫ মিনিট আমাদের ১ ঘণ্টা লাগছে! ফুরমোনের চূড়ায় পৌঁছে আমাদের সঙ্গে থাকা খাবারে সকালের নাশতা সেরে নিই আমরা। খাবারের উচ্ছিষ্ট আমরা পলিথিনে আমাদের ব্যাগে নিয়ে নিই। (জিনিসটা খুবই খারাপ লাগে যখন দেখি এই পাহাড়ের সৌন্দর্য পলিথিন ও প্লাস্টিকের বোতল পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। আমরা যারা ভ্রমণপিপাসু, তারা প্রকৃতিকে ভালোবাসি বলেই ছুটে যাই প্রকৃতির কাছে। আমাদের কি উচিত না প্রকৃতির সৌন্দর্যটা ঠিক রাখার?)
কথায় আছে বাঙালি মেয়ে যেখানেই যাবে শাড়ি পরবে। আর তেমনটাই হলো। ব্যাগে করে শাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। পাহাড়ের চূড়ায় শাড়ি পরে ফটোশুট করে ফেললাম। কিছুক্ষণ আশপাশ দেখে নেমে পড়লাম পাহাড় থেকে। পরবর্তী গন্তব্য কাপ্তাই উপজেলা। নিচে দেখলাম আমাদের সিএনজিচালক অপেক্ষায়। হোটেলে ফিরে চেকআউট করে বেরিয়ে পড়লাম।
দুপুরের খাবার আবার সজীবের রান্নাঘরে সারলাম। সেই সিএনজিতে চলে গেলাম কাপ্তাইয়ের ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশে। সিএনজি রাঙামাটির আসামবস্তি, রাঙামাটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বিলাইছড়ি ব্রিজ, লেক পয়েন্ট হয়ে যাচ্ছিল! মনে হচ্ছিল চোখ বন্ধ করলেই বিরাট কিছু মিস করে ফেলব। কিছু পয়েন্টে সিএনজি থামে, আমরা ছবি তুলে আবার যাত্রা। এ যেন এক স্বর্গীয় রাস্তা বললে ভুল হবে না।
আমাদের যেতে যেতে অনেক দেরি হয়ে যায়, যার কারণে ন্যাশনাল পার্কে না গিয়ে চলে যাই শেখ রাসেল এভিয়ারি অ্যান্ড ইকোপার্কে। সেখানে সন্ধ্যা অবধি থেকে চলে যাই প্রশান্তি পার্কে। এ পার্কের পাশে কর্ণফুলী নদী। এখানে ক্যাম্পিং করে দারুণ সময় উপভোগ শেষে রাত আটটার দিকে পার্কের সামনে থেকেই বাসে উঠে বসি ঢাকার উদ্দেশে। আরও একটা দিন থাকার আক্ষেপের সঙ্গে আবারও রাঙামাটি যাওয়ার আশা নিয়ে আমরা পৌঁছে যাই চিরচেনা ইট-পাথরের শহর ঢাকায়।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে রাঙামাটিগামী অনেক বাস রয়েছে! ৮০০ টাকা থেকে ভাড়া শুরু। যেগুলো রাত ৯টা বা সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে। আপনাকে ভোর পাঁচটা বা সকাল ছয়টার মধ্যে রাঙামাটি পৌঁছে দেবে। আমরা শ্যামলী পরিবহনে করে গিয়েছিলাম। সকাল ১০টার দিকে বাস শনির আখড়া ছিল এবং আমরা ৫টার দিকে রাঙামাটি পৌঁছে গিয়েছিলাম!
কোথায় থাকবেন
রাঙামাটির দোয়েল চত্বর থেকে রিজার্ভ বাজার ও তার আশপাশে অনেক হোটেল আছে। যদি পরিচিত কেউ থাকে বা সঙ্গে নারী থাকে, তাহলে আগে থেকেই হোটেল বুকিং করে রাখা ভালো। আর যদি শুধু ছেলেরা যান, তাহলে সেখানে গিয়ে হোটেল চুজ করতে পারেন। এখানকার হোটেলের ভাড়া আপনি যত দরদাম করতে পারবেন, তত কমে নিতে পারবেন।
নৌকা রিজার্ভ
যদি আমাদের মতো পরিচিত থেকে থাকে, তাহলে তো হয়েই গেল। নিশ্চিন্তে ঘুরে আসতে পারবেন। তা ছাড়া চেষ্টা করবেন নিজে দেখে ঠিক করা! পেজের মাধ্যমে আগে থেকে রিজার্ভ করা থেকে নিজে সামনাসামনি দেখে দাম বুঝে কমিয়ে ভালো সার্ভিস পাবেন। আমরা যারা শিক্ষার্থী, তাদের বাজেট যত কম পড়ে, তত ভালো। সে ক্ষেত্রে দরদাম ভালো করতে পারে এমন বন্ধু থাকলে তো আর কথা–ই নেই, কম বাজেটে বিন্দাস ট্যুর।