হামহাম ঝরনা দেখা

বনে প্রবেশের পথে
ছবি: লেখক

খুব সম্ভবত পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় একবার চট্টগ্রামে বাসা পরিবর্তন করে নতুন বাসায় উঠি। আগের বাসায় স্নানঘরে স্নানের জন্য ব্যবস্থা বলতে ছিল পানির ট্যাপ, বালতি আর মগ। আর নতুন বাসায় পেলাম ঝরনা! এ জিনিসের প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল। আমার সেই আকর্ষণ বড়বেলায়ও কমেনি! বরাবরই ঝরনার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ আমার।

ভ্রমণের এ জীবনে কয়েকটা ঝরনা আমার দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তবে ২০১২-১৩ সালের দিকে শ্রীমঙ্গলের হামহাম ঝরনার কথা শোনার পর ঠিক করেছিলাম, সেখানে আমাকে যেতেই হবে। এলাকার লোকেরা ‘চিতা ঝরনা’ বলে। তবে এখানে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে বলতে হয়, হামহাম ঝরনাটা তখন মাত্র পরিচিতি পেয়েছিল, অর্থাৎ মানুষের পদচারণা খুব একটা পড়েনি।

এর সঙ্গে বনের স্বাদ আর উঁচু–নিচু পাহাড় পার হয়ে যাওয়া! এর সঙ্গে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো বটেই! সব মিলিয়ে এই এক ট্যুরেই অনেকগুলো স্বাদ নেওয়ার সুযোগ। সেই ২০১২-১৩ সালের স্বাদ নিয়েছিলাম আমি বছর কয়েক আগে। আমরা তিন ভাই মিলে একসঙ্গে যাব সিদ্ধান্ত নিলাম।

ট্র্যাকিংয়ের সময় বিশ্রাম না নিলেই নয়
ছবি: লেখক

ঢাকা থেকে মাত্র চার ঘণ্টায় বেলা ১১টায় পৌঁছে গেলাম বনের শুরুর দিকে। সেই জন্য বেশ সকালে রওনা দিতে হয়েছিল। আগে থেকেই একজন গাইড অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য বনের সামনেই। যাত্রাটা যে আনন্দদায়ক হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

তবে এ যাত্রার প্রস্তুতি ছিল আলাদা! তিনজনেই মাথায় গামছা দিলাম! জানি প্রচুর ঘাম ঝরবে, আবার সামনে যেহেতু ঝরনা, সেখানে না ভিজলে তো ভীষণ অন্যায় হবে, সেই ক্ষেত্রে গামছাটা প্রধান অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে। লম্বা সাদা মোজা নিলাম আর সেটা পরার পর প্যান্টের পায়ের নিচের অংশ মোজার মধ্যে গুঁজে দিলাম। এসব কাহিনি করলাম, কারণ জোঁক যেন ধরতে না পারে। দড়ি নিয়েছিলাম মোজার ওপর গিঁট দেব বলে, যাতে ভয়ংকর জোঁক আমাদের মোজার ভেতরে আসতে না পারে। সঙ্গে করে ডেটল দুই বোতল।

কারণ, ডেটলের ঘ্রাণ ওই মহাশয় সহ্য করতে পারে না। এত সব কেবল জোঁকের জন্য। এর বাইরেও ছুরি আর লবণ নিলাম বাড়তি নিরাপত্তা হিসেবে।

তারপর শুরু করলাম। সঙ্গে ছিল একজন গাইড—আরমান মামা। অসাধারণ এক লোক। তিনিই বনে প্রবেশের আগে একটা হোটেলে দুপুরের খাবার অর্ডার দেওয়ার পরামর্শ দিলেন। কচি চা–পাতার ভর্তা আছে মেনুতে, ভাতের সঙ্গে আরও আছে ঘন ডাল এবং মুরগির মাংস। এটা শুনেই ঠিক করলাম, এখানেই খাব। আমরা ঘুরে আসব, আর তাঁরা আমাদের জন্য রান্নার আয়োজন করবেন!

বিপজ্জনক ঢালু পথ
ছবি: লেখক

অবশেষে প্রবেশ করলাম বনে। বিশুদ্ধ একটা বন! সম্পূর্ণ অগোছালো আর প্রাকৃতিক। বাঁশঝাড়ের সংখ্যাই বেশি। তবে এর সঙ্গে বড় বড় গাছ আছে, যাদের নাম আমি জানি না। মূলত পাহাড়ের ওপর সব। এ পাহাড়েই একবার ওঠা আর একবার নামা! খুব একটা ট্র্যাকিংয়ে অভ্যাস না থাকলে হাঁপাতেই হবে! আমরাও এখানে এসে হাঁপানির দলে নাম লিখালাম। তাই ৫-৬ বার থেমে থেমে রেস্ট নিয়েছি। এ হাঁপানির সময়ে লম্বা দম যেমন কাজে লাগে, এর সঙ্গে কাজে লাগে খাওয়ার পানি। কারণ, প্রচুর ঘাম হয়, তাই পানিশূন্যতা ঠেকাতে বাতাস আপনাকে কোনো কাজ দেবে না!

তাই সঙ্গে করে প্রতিজনের জন্য পানির বোতল নিলে খুব আরাম পাবেন। আরও ভালো হয়, এর মধ্যে যদি স্যালাইন দিতে পারেন। পাহাড়ি রাস্তায় চলাফেরায় নিরাপত্তার জন্য আগেই এলাকার ছেলেপেলেদের কাছ থেকে ১০ টাকা দিয়ে বাঁশ কিনে নিয়েছি। বাঁশময় এ ভ্রমণে কয়েকটা বাঁশের সাঁকোও পড়বে আপনার যাত্রাপথে।

পাহাড়ে ওঠার সংখ্যাটাই বেশি। তবে শেষ দিকে, বেশ খাড়াভাবে ৬-৭ তলা সমান পাহাড় আপনাকে বেয়ে বেয়ে নামতে হবে! এটা ছিল খুব বিপজ্জনক। এ পাহাড় নামার সময় টের পেয়েছিলাম, পাহাড়টি বেয়ে ফেরার সময় ভয়ানক কষ্ট হবে। তবে চারপাশে বাঁশঝাড় থাকায় সেই বাঁশ ধরে ধরে নেমেছি। আর অনেকেই যেহেতু আগে উঠেছে, তাই সাধারণভাবেই কিছু গর্ত হয়েছে, তাতে পা রাখার সাপোর্ট পাওয়া যায়।

প্রকৃতি
ছবি: লেখক

এরপরেই এল, পাথুরে পানি পথ। একটা সময় গলা সমান পানি পেলাম। সঙ্গেই দুপাশে উঁচু মাটির পথ আছে। তবু আমরা ইচ্ছে করেই পানিপথ বেছে নিলাম। এ বেলায় উপভোগ করলাম বনের অনন্য সৌন্দর্য। ছিমছাম নীরবতা সেখানে আর আমরা শিশুর মতো ডান–বাম সামনে–পেছনে সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্রায় ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট পাহাড় পেরোনোর পর এ দৃশ্য অন্য রকম শক্তি দেয়। আধো আলোতে এভাবে আরও ১৫-২০ মিনিট হাঁটার পর পেলাম হামহাম ঝরনা। আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্থল!

১৪০ ফুট এ ঝরনার সেদিন খারাপ দিক ছিল, পানির পরিমাণ বেশ কম। সেই সুবাদে ভালো দিক হলো, শেষ পর্যন্ত যেতে পেরেছি। পানি বেশি হলে সেটা অবশ্যই বিপজ্জনক। এখানে ৩০-৪০ মিনিট স্নানের আনন্দ নেওয়ার পর ফেরার পথে আমাদের একজনের পায়ে দেখলাম জোঁক। এতে সে যতই আতঙ্কিত হোক, আমি ভীষণ খুশি।

কারণ, এত এত জিনিস এনেছি প্রটেকশনের জন্য! কাজে না লাগলে খারাপ লাগত! ভয়ংকর জোঁক, কোনোভাবেই ছাড়ানো যায় না! ডেটল দিলাম! জোঁক পাত্তাই দিল না! আর যেই মাত্র লবণ দিলাম, অমনি, নিজ থেকেই খসে পড়ে গেল! যেভাবে তরকারিতে লবণ বেশি দিলে আমরা সহ্য করতে পারি না! বেচারা জোঁকেরও একই দশা! পরে অবশ্য জোঁককে ‘সরি’ বলেছি মজা করে।

হামহাম ঝরনা
ছবি: লেখক

এবার ফেরার পালা! দেখতে হবে সেই খাড়া পাহাড়! কেবল মনের সব সাহসকে একসঙ্গে করে শুরু করলাম! নামার সময়টা যতটা সহজ ছিল। ওঠাটা মনে হচ্ছে না তেমন সহজ হবে। আমাদের আগে বেশ কয়েকটা দল এসেছিল, তারা ফিরে গিয়েছে। উপহার হিসেবে আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন পানিতে ভেজা কাদা কাদা আর পিচ্ছিল পথ। তাই খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়েছিল। আর অনেক কষ্ট করেই পেরোলাম।

তারপর শুরু করলাম লম্বা হাঁটা এবং বেশ ভালো গতিতে। জানি না, কেন এমন শক্তি পেলাম! আসতে যখন সময় লাগল দেড় ঘণ্টা, ফেরার সময় লাগল মাত্র এক ঘণ্টা! বের হয়ে এলাম সেই উঁচু–নিচু আঁকাবাঁকা পাহাড়ি বন থেকে। শুরুতেই সেই ঝরনার পানি যে পথ দিয়ে বের হয়ে আসে, সেই পথে স্নান করে নিলাম আবার। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত হয়ে ভাত খেলাম সেই হোটেলে। কচি চা–পাতার ভর্তার স্বাদ তো ভালো ছিলই।

ফেরার পথে বোনাস হিসেবে নিলাম মাধবপুর লেক। হামহাম ঝরনার ভ্রমণকে আমি বলব, এক দিনে বেশ জম্পেশ আর পরিশ্রমের সঙ্গে আনন্দদায়ক ভ্রমণ।

যেভাবে যাবেন

প্রথমে শ্রীমঙ্গলে পৌঁছাবেন বাস বা ট্রেনযোগে। সেখান থেকে কলাবন পারায় যাবেন রিজার্ভ সিএনজিচালিত (আনুমানিক ভাড়া ১ হাজার ৫০০ টাকা) বা জিপ গাড়িতে। আগে থেকে গাইড ঠিক করে রাখলে ভালো হয়, তবে সেখানে গিয়েও গাইডের খোঁজ পাবেন।

সঙ্গে যা যা নেবেন

পথে জোঁক আছে অনেক, এর প্রটেকশন নিতে পারেন। সঙ্গে হালকা শুকনা খাবার এবং খাওয়ার পানি খুব জরুরি।