জিন্দা পার্কে একদিন

ছবি: লেখকের পাঠানো

ইট–পাথরের এই ধুলাদূষণে ভরা শহরে একটুখানি সবুজের দেখা পেতে কে না চায়। সবুজের মাঝে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার জন্য মানুষ মুখিয়ে আছে; কিন্তু সবুজ গাছপালা তো দিন দিন কমেই যাচ্ছে। গুটিকয়েক পার্ক ছাড়া এই শহরে সবুজে হারানোর সুযোগ কোথায়? যারা সবুজ ভালোবাসেন। সবুজ গাছপালা, পাখিসহ বন্য প্রাণীর মধে৵ একান্ত নীরবে নিভৃতে সময় কাটাতে চান। তাদের জন্য সত্যিই এক আশীর্বাদ হলো ঢাকা থেকে মাত্র ৩৭ কিলোমিটার দূরে জিন্দা পার্ক। যার অবস্থান নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন পৌরসভার জিন্দা গ্রামে। প্রত্যন্ত গ্রাম বলতে যা বুঝায়। অনেকটা তেমনই এই জিন্দা পার্ক।

কাঞ্চন ব্রিজের আগে বাইপাস মোড়ে নামতে হবে। এরপর অটোতে করে মিনিট দশেকের মধ্যে পৌছে যাবেন জিন্দা পার্কে। আর পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়ক থেকে ২০ মিনিট দূরত্ব। বিআরটিসি বাস চলাচল করে। এতে করেই যেতে পারবেন। প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস নিয়ে গেলে তো কথাই নেই। এ তো গেল জিন্দা পার্ক যাওয়ার কথা। এবার আসা যাক কী দেখে মন–প্রাণ জুড়াবেন তার কথায়।

গেট দিয়ে পার্কে ঢুকতেই বানরের ডাকাডাকিতে চমকে যাবেন। অবশ্য গেটের কাছেই পানির দুটি ট্যাংকে বিভিন্ন রঙের মাছ ভেসে বেড়ায়। এখানে বসে সুন্দর ছবি তুলতে পারবেন। গেটের চারপাশে লতাজাতীয় গাছের অভাব নেই। এর মধে৵ দাঁড়িয়ে প্রিয়তমার হাত ধরে ছবি তুললে তা মন্দ হয় না। মূল গেটের ডানে–বাঁয়ে অসংখ্য গাছপালা। সবুজ ঘাসগুলো যেন আপনাকে বসার আমন্ত্রণ জানাবে। বাঁয়ে স্কুলমাঠ, এদিকে না হয় পরে যান। ডানের দিকটা বেড়িয়ে সোজা গেলে দেখতে পাবেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার লাইন ‘ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য, লও এ নগর’ এমন লেখা একটি গেট। এই গেট পেরিয়ে দুপাশে গাছ আর মাঝখানের কম প্রশস্ত রাস্তায় যখন হাঁটবেন। মনেই হতে পারে লাউয়াছড়া বা অন্য কোনো অভয়ারণ্যে আপনি। অবশ্য এর আগে মসজিদের ডান পাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাঁশবাগান। দিনের বেলায়ও কেমন যেন একটা গা ছমছম করা পরিবেশ। এরপর নারিকেলবাগান, দিঘি, দিঘির মাঝখানে উঁচু টিলা, সেখানে সাঁকো বেয়ে গিয়ে বসা—এমন কত কিছুই না আছে। বলতে গেলে লেখার পরিধিই বাড়বে না কেবল, ধৈর্যচ্যুতি ঘটার আশঙ্কা আছে। ছোট গাছ তার নিচে বসার জন্য সিমেন্টের টুল, কখনো গাছের বদলে সিমেন্টের গোল ছাউনি, চেয়ারসহ বিভিন্নভাবে বসে প্রকৃতি উপভোগের সুযোগ রেখেছে কতৃ৴পক্ষ। এতক্ষণ গাছপালার গল্প শুনতে শুনতে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। কতসংখ্যক গাছ এই পার্কে আছে। প্রায় ১৫০ একর জমির ওপর অবস্থিত এই পার্কে  প্রায় ২৫০ প্রজাতির গাছ আছে । যা ১০ হাজারের বেশি।

ছবি: লেখকের পাঠানো

অগ্রপথিক পল্লী সমিতি নামে একটি সমাজকল্যাণ সংস্থা এই পার্ক পরিচালনা করে। বৃদ্ধ এক চাচা মুঠোফোনে গান শুনছেন চেয়ারে বসে। অনেকক্ষণ ধরেই বসা। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি পার্ক পাহারায় নিয়োজিত। এই চাচার মতো স্থানীয় মানুষেরাই ভ্রমণকারীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। ফলে আর দশটা পার্কের মতো এখানে অসামাজিক কার্যক্রলাপ করার কোনোই সুযোগ নেই। আবার বহিরাগত বখাটেদের যে ভয় অন্য সব জায়গায় থাকে,এখানে তা–ও নেই।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

মনে করতে পারেন, বাংলাদেশে পার্কে বেড়াতে গেছেন; কিন্তু কোথাও চিপস, চানাচুর ও সিগারেটের প্যাকেট ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়া দেখেননি? জিন্দা পার্ক অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। একটু পরপর সিমেন্টের বড় ডাস্টবিন। প্রায় তিন ঘণ্টা পার্কে ঘুরে বেড়ালেও একটি চিপসের প্যাকেট মাটিতে দেখিনি। সবুজ ঘাসগুলোও এত পরিষ্কার। হুট করে বসে পড়লেও কাপড়ে দাগ হবে না। আর খালি পায়ে হাঁটলে আত্মায় শান্তি অনুভব তো করবেনই।

ছবি: লেখকের পাঠানো

প্রায় ৫টি জলাধার নিয়ে ঘেরা আছে এই পার্ক। জিন্দা পার্ক ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে সেখানকার বিশাল লেকের বুকে নৌকায় ভেসে বেড়াতে পারেন। অবশ্য সাঁতার না জানলে নৌকাভ্রমণ না করাই ভালো। জলাধারগুলোর পানি আপনাকে গোসল করার জন্য ডাকতে পারে। একটি জলাধারে লাল শাপলার দেখা মেলে। পাশাপাশি বিড়াল, কুকুর আছে অনেক। সবই নিরাপদ। যে যার মতো হেঁটে বেড়াচ্ছে। এ এক অদ্ভুত মিলনমেলা।

হুমায়ূন আহমেদের সিনেমায় যাঁরা গাছের ওপর ঘর দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের জন্য সুখবর। পার্কে ছোট–বড় অনেকগুলো ঘর আছে গাছের ওপর। আর যেখানেই যান। বইয়ের পাতায় চোখ বোলানো যাদের অভ্যাস। তাদের জন্য আছে লাইব্রেরি। লাইব্রেরি ভবনের ডিজাইন খুবই চমৎকার। এখানে সিঁড়িতে বসে আলো– আঁধারের মধে৵ দারুন সব ছবি তোলা সম্ভব।

টিকিট

ঈদসহ বন্ধের দিন প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য টিকিট ১৫০ টাকা, যা মূল গেটের কাছ থেকে ক্রয় করতে পারনে। বাচ্চাদের জন্য ৫০ টাকা (তিন ফুটের নিচে হলে), সপ্তাহের সব দিনই পার্ক খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে মাগরিবের আগ পর্যন্ত। বন্ধের দিন ছাড়া অন্য সময় টিকিট ১০০ টাকা।  সেমিনার ও মিটিং করার ব্যবস্থা আছে এখানে। এর জন্য আগে যোগাযোগ করতে হবে। জিন্দা পার্ক নামে ওয়েবসাইট এবং ফেসবুক পেজ আছে। সেখানে গেলে সর্বশেষ আপডেট জানতে পারবেন।

ছবি: লেখকের পাঠানো

থাকা, খাওয়া—

পার্কের মধ্যে বিভিন্ন মানের কর্টেজ আছে। সেখানে থাকার ব্যবস্থা আছে। এসি/নন-এসি রুমের জন্য অনলাইন বুকিং সুবিধা বিদ্যমান। পার্কের ভেতরে রেস্টুরেন্ট, ক্যানটিন আছে। এখানটায় খাবারের মান ভালো। দাম বাইরের চাইতে সামান্য একটু বেশি। ফুচকা, চটপটি, আইসক্রিম ও ফাস্টফুডের দোকান আছে অনেক। দোকানের মালিক স্থানীয় মানুষেরাই। তাঁদের আচরণ দেখে মনে হলো ব্যবসার চাইতে পার্কে আসা মানুষদের খুশি করতে বেশি ব্যস্ত। লাভ তাতে একটু কম হোক। বাইরের খাবার ভেতরে নেওয়া নিষেধ।

তবে পার্কে ঢোকার আগে ডেউয়া বানানো না খেলে ধরে নিতে পারেন, জীবনে বড় কিছু মিস করলেন। অনেক রকম মসলা দিয়ে বানানো এই ভর্তার দাম মাত্র ৫০ টাকা। এখানে গ্রামের গাছের আম, কলা, কাঁঠালসহ অনান্য ফল ও সবজি পাবেন। ফিরবার সময় কিনে নিয়ে গেলে ঠকবেন না আশা করি। সবই সতেজ ও বিষমুক্ত। মোদ্দাকথা, এক দিনের ট্যুরের জন্য জিন্দা পার্ক সত্যিই দারুন এক জায়গা। না গেলে শত শব্দের বাক্য দিয়েও আপনাকে আসল ভালোলাগাটা বোঝানো মুশকিল।

যা করবেন না—

আপনি ডানে, বাঁয়ে, সামনে, পেছনে যেখানেই তাকাবেন, প্রচুর ময়লা–আর্বজনা ফেলার পাত্র। তাই যা কিছুই খাবেন, তার প্যাকেট ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলুন। অবশ্য এত সুন্দর জায়গা আপনার নোংরা করতে মন চাইবে না। যদি না তেমন একটা মন আপনার থাকে।