নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল টাঙ্গুয়ার হাওর

টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলার মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশের একটি হাওর। সুনামগঞ্জকে বলা হয় ‘হাওরকন্যা’। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টির বেশি ঝরা (ঝরনা) এসে মিশেছে এই হাওরে। প্রায় ১২৬ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি। এ হাওরকে ‘নয়কুড়ি কান্দার ছয়কুড়ি বিল’ বলা হয়। ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের ঘেরা টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার, নীলাদ্রি লেক/শহীদ সিরাজ লেক, লাকমাছড়া, শিমুল বাগান, বারিক্কাটিলা, যাদুকাটা নদী, মিনি সুইজারল্যান্ডসহ নাম জানা–অজানা অনেক দর্শনীয় স্থান। সৌন্দর্যের লীলাভূমি নয়নাভিরাম টাঙ্গুয়ার হাওর এখন পর্যটকের কাছে অতিপ্রিয় স্থান। টাঙ্গুয়ার হাওরের রূপের বিবরণ লিখে শেষ করার মতো নয়। বর্ষা ও শীত—এই দুই মৌসুমে দুই রকমের সৌন্দর্যে অপরূপ হয়ে ওঠে এই হাওর। বর্ষা মৌসুমে প্রতিদিন শত শত পর্যটক শতাধিক নৌকা-হাউসবোট নিয়ে হাওরজুড়ে ভেসে বেড়ান। অনেকে হাউসবোট নিয়ে হাওরেই রাত যাপন করেন।

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ

আমাদের টিম ‘বেঙ্গল ট্রাভেলার্স’ নিয়ে হাওর ভ্রমণ শুরু হয় চট্টগ্রাম এ কে খান বাস টার্মিনাল থেকে। প্রায় ১২ ঘণ্টা বাসে করে সকাল ১০টায় সুনামগঞ্জ বাস টার্মিনালে পৌঁছি। সেখান থেকে লেগুনা করে চলে যাই তাহিরপুর বোট ঘাটে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল জলসঙ্গী ও যাদুকাটা ভিন্টেজ হাউসবোট। তারা প্রথমে শরবত দিয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। এরপর সকালে নাশতা খিচুড়ি দেয়। এরপর শুরু হয় আমাদের হাওর ভ্রমণ।

বোট যখন চলতে শুরু করল ঠিক তখনই যেন ঢুকে পড়লাম অন্য এক জগতে। দিগন্তবিস্তৃত হাওরের বুকে হালকা হাওয়ার স্নেহে মেঘমালা ভেসে বেড়ায় দূরের পাহাড় ছুঁয়ে। এ এক অপার্থিব অভিজ্ঞতা, যেন জলও কথা বলে, আকাশও দেয় সাড়া। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে ছোট ছোট চর। বর্ষায় মাছ ধরে, শীতে চাষ করে, আর এই মাঝামাঝি ঋতুতে তারা পর্যটককে দেয় হাসিমাখা আতিথেয়তা। বোট চলতে চলতে মধ্য দুপুরে পৌঁছালাম ওয়াচ টাওয়ারে। সেখানে পানি এতটাই স্বচ্ছ, ডুবে যাওয়া পাতার হাড় জিরজিরে দাগ পর্যন্ত চোখে পড়ে। ছোট ছোট ডিঙিনৌকায় চেপে ঘুরে বেড়াই করচ-হিজল বনের গভীরে। গোসল, আহার আর বিশ্রামের পর বোট চলতে রাখল নীলাদ্রি লেকের দিকে। চুনাপাথরের খনি আজ রূপ নিয়েছে নীল জলে ভরা এক হৃদয়ে। স্থানীয় লোকজনের কাছে এটি শহীদ সিরাজ লেক হলেও, পর্যটকের কাছে এর পরিচয়– নীলাদ্রি। সন্ধ্যা নামার আগে লেকের নীল জলে ছোট ডিঙিনৌকায় ঘুরে বেড়ালাম। সন্ধ্যা নামল যাদুকাটা নদীর ধারে। সীমান্তঘেঁষা সেই জায়গা থেকে দেখা যায় মেঘালয়ের পাহাড়। সীমান্ত এলাকায় সোডিয়াম লাইটের আলোর নিচে গাঢ় হয়ে ওঠে এক স্বপ্নময়তা, যেন রূপকথার কোনো নিঃশব্দ গ্রাম। রাতে হাঁসের মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে রাতটা কাটল হাউসবোটে।

নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্যতম আকর্ষণ হলো হাউসবোটে থাকার দিনগুলো। ভোর সকালে চলে যাই সীমান্তবর্তী এলাকা লাকমাছড়াতে। লাকমাছড়া দিয়ে বয়ে চলছে শীতল পানি। এরপর চলে এলাম হাউসবোটে। হাউসবোটে জানালার পাশে বসে চায়ের চুমুকে দূর মেঘালয়ের পাহাড়গুলোর দৃশ্য মনকে যেন জাগিয়ে তুলেছে অন্য রকম অনুভূতিতে। এরপর বোট ছুটতে লাগল শিমুলবাগানের দিকে। ৪০ টাকা করে টিকিট কেটে ঢুকে যাই শিমুলবাগানের। সবুজে ঘেরা পাতা দিয়ে প্রকৃতি সেজেছে অপরূপ সৌন্দর্যে। বাগান থেকে বাইরে বেরোতে শুরু হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে দেখতে থাকি যাদুকাটা নদী অপরূপ সৌন্দর্য ও মেঘালয় পাহাড়ে মেঘের খেলা। এবার বোটে করে চলে যাই টেকেরঘাট। সেখান থেকে বাইক ভাড়া করে চলে যাই মিনি সুইজারল্যান্ড, ঝরনা ও বারিক্কাটিলায়। বারিক্কাটিলায় রয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের ১২০৩ নং পিলার এবং ওখান থেকে দেখা যায় যাদুকাটা নদীর রূপ। যাদুকাটা নদী দিয়ে চলে যায় হাওরের বুকে নদীতে গোসল করতে। লাইফ জ্যাকেট পরে নেমে যাই গোসল করতে যাদুকাটা নদীতে। বোটে উঠে দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে বোট চলতে থাকল হাওরে গ্রামীণ পথ ধরে তাহিরপুর ঘাটে। এখানেই আমাদের হাওরবিলাস শেষ হয়। সন্ধ্যায় বাসে করে সকালে চট্টগ্রামে পৌঁছি।

হাওর একদিকে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা তৈরি করলেও এটিকে হাওরে জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হিসেবে পড়ছে। নানা রকম দেশি ও পরিযায়ী পাখি দেখতে শীত মৌসুমে টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে যান পাখিপ্রেমীরা। এতে পাখির আবাসন নষ্ট হচ্ছে ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ টাঙ্গুয়ার হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনের বিকাশে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। হাওরের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা, হাউসবোট পরিচালনা, পর্যটকদের নিরাপত্তাসহ নানা বিষয় চিন্তায় রেখে একটি নীতিমালা করেছে। এটাকে সাধুবাদ জানাই। সুনামগঞ্জে যাতে সারা বছর পর্যটকেরা নির্বিঘ্নে যেতে পারেন, তার ব্যবস্থা করা দরকার। আমি এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আশা করি, সুনামগঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের পর্যটকবান্ধব সব স্থানের লোকজনের প্রত্যাশা পূরণ হবে।

লেখক: মো. জোবাইর হোসেন, ভ্রমণপিপাসু