শহর ছেড়ে গহিন বনে: নর্তনদীর মায়াঘেরা সিংড়া জাতীয় উদ্যানে এক দিন

ক্রমাগত কাজ করে চলেছি। অফিস থেকে বাসা আর বাসা থেকে অফিস—চরকির মতো পাক খেতে খেতে যাচ্ছে দিনরাত। সেদিন প্রধান কার্যালয়ে থেকে পরিদর্শক দল এল। তাঁরা ফিরে যাওয়ার পর ব্যবস্থাপক সবার ভুলভ্রান্তি ও অর্জন নিয়ে কথা বলছিলেন। হঠাৎ আমি বলে বসলাম, ‘ভাই, অনেক তো কাজ হলো, চলুন সবাই মিলে কোথাও থেকে ঘুরে আসা যাক।’ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে ভুল করলাম বোধ হয়। আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে জেলা ব্যবস্থাপক খোরশেদ আলম ভাই বললেন, একদম মনের কথা বলেছেন তো! অন্যদেরও তখন বিষয়টিতে উৎসাহী হতে দেখলাম। সিদ্ধান্ত হলো এবারের সাপ্তাহিক ছুটিতে যাওয়া হবে দিনাজপুর সিংড়া জাতীয় উদ্যানে। নদী, খোলা আকাশ, বন, খেতখামার—সবই নাকি আছে সেখানে।

বৃহস্পতিবার থেকেই ভ্রমণের বিষয়ে তোড়জোড় শুরু হলো, বাজার করার দায়িত্ব নিলেন নাজমুল ভাই আর ক্রিকেট খেলার জন্য, ব্যাট, বল, স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে রাখলাম আমি। আমাদের কর্মস্থল ঠাকুরগাঁও সদরে। এখান থেকে ২০ কিলোমিটারে মধ্যেই সিংড়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান।

শুক্রবার সকালে ঢাকা পঞ্চগড় মহাসড়ক দিয়ে রওনা দিয়েছিলাম আমরা। এই রাস্তা আমার অতি প্রিয়, বিশেষ করে ঠাকুরগাঁওয়ের প্রবেশমুখে ‘রামদাঁড়া’কে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি শালগাছ, ঘাস, লতাপাতায় জড়ানো মাটির উঁচু–নিচু ঢিবি, রাস্তা থেকে দেখতে অসাধারণ লাগে। হেমন্তের মিষ্টি রোদ আর ঝিরি ঝিরি বাতাস এসে গায়ে লাগছে। খোশমেজাজে অটোরিকশায় বসে গল্পগুজব করছিলাম সবাই। একটানা ৩৫ মিনিট চলার পর পৌঁছালাম দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার বটতলীর মোড়ে। এখান থেকে দক্ষিণ দিকে আধা পাকা রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে উন্মুক্ত ধানখেত পার হতেই সিংড়া ফরেস্টের বৃক্ষরাজির দেখা মিলল। বনের ভেতর থেকে শুনতে পেলাম ঝিঁঝি পোকার ডাক। দিনের বেলায় এই শব্দ অদ্ভুত লাগলেও উপভোগ্য ছিল।

এখানে আগে নাকি বাঘ, নীলগাইসহ আরও অনেক জীবজন্তু থাকত। এখন আর নেই সেগুলো। রাস্তার দুই ধারে অগোছালো গাছের সারি। শাল, শিমুল, নিম আর সোনালু ছাড়া বাকি গাছগুলো আমার অচেনা। নিচে নানা প্রজাতির লতাপাতার মধ্যে চিনতে পারলাম শুধু বেতগাছ। বনের ভেতরে কিছুটা অন্ধকার, মাঝে দু–একটা গাছ পুরো ডালপালাসমেত আরেকটার ওপর পুরোপুরি হেলে পড়েছে। লতাগুল্মের দল এই গাছগুলোকে কাণ্ড থেকে শাখা–প্রশাখা অবধি পেঁচিয়ে ধরেছে। বেশ রহস্যময় লাগছে বনটা। যানবাহন নিয়ে আর এগোনো যাবে না। অগত্যা অটোরিকশা ছেড়ে মালামাল সবাই হাতে হাতে নিয়ে নিলাম। মূল অ্যাডভেঞ্চারের শুরুটা এখান থেকেই। স্থানীয় কিছু নারী ও শিশুকে দেখলাম, তারা জঙ্গল থেকে লাকড়ি সংগ্রহ করছিল। গাছপালা আর বন্য প্রাণী বিলুপ্তির কারণ তাহলে এই, বিড়বিড় করলাম আমি। নাজমুল ভাই বসার জায়গা কোথায় ভালো হবে, তা জানতে চাইলেন তাদের থেকে। তারা নদীর পাড়ে বসার পরামর্শ দিল। মায়াবী এক নদী আছে এখানে, নাম ‘নর্ত’ নদ। নর্তের পাড় দিয়ে পায়ে চলা পথ ধরে জঙ্গলের ভেতর এগিয়ে চললাম আমরা। ছোটবেলায় প্রচুর ওয়েস্টার্ন, তিন গোয়েন্দা আর মাসুদ রানার বই পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, গল্পের মতো কোনো একটা মিশনে এই জঙ্গলে এসেছি! চলতে চলতে বনের সবচেয়ে গভীর অংশে তখন। মানুষজন নেই বললেই চলে। কিছুক্ষণ পরপর নাম না জানা দু–একটি পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। বাতাস কম, একটু গুমোট ভাব আছে, কর্দমাক্ত পথে আড়াআড়ি কিছু গাছ শিকড়সমেত উপড়ে আছে। সেগুলো ডিঙিয়ে পার হচ্ছি।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

নাজমুল ভাইকে বললাম, ‘ভাই, “অ্যাপোক্যালিপ্টো” দেখেছেন? ওই যে মায়ান সভ্যতা নিয়ে বানানো জঙ্গলের সিনামাটা?’ উনি আবার চলচ্চিত্রপাগল। দেশি-বিদেশি কয়েক হাজার চলচ্চিত্র নাকি দেখেছেন এই বান্দা! ‘হুম, এই বনের আয়তন বেশি না। তবে ঠিকই বলেছেন, “অ্যাপোক্যালিপ্টো”র মতো সারভাইভাল টাইপ একটা ভাব আসছে কিন্তু শরীরের মধ্যে। এবার তিন দিক থেকে আসা পথের এক মিলনস্থলে পৌঁছালাম আমরা।’ খোরশেদ ভাই বললেন, ‘এখানেই বসি, আর ব্রেকফাস্টটাও করে নেওয়া যাক।’ আমরা একটু ইতস্তত করছিলাম, পোকামাকড়ের ভয়েই হবে হয়তো। ‘আরে বসেন তো, সাপ–ব্যাঙ–পোকামাকড় যা আসে আসুক, জঙ্গলে থাকার অনুভূতি নিতে হবে না? সেটা অল্প সময়ের জন্য হলেও নেওয়া চাই, বসেন সবাই।’ কী আর করা, সেখানেই মাদুর বিছিয়ে বসলাম সবাই। ইতিমধ্যে ক্যামেরা বের করে ছবি তোলা শুরু করেছেন বেশ কজন। সহকর্মী মুশফিক, মোখলেস, আলি হোসেন—সবাই হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত। ব্রেকফাস্ট শেষে একটু আরাম করতে চেয়েছিলেন তাঁরা। সে আশার গুড়ে বালি। বড় বড় কালো পিঁপড়ের দল এসে হাজির হলো। সেই সঙ্গে মশার উপদ্রব ফ্রি। অগত্যা আমি আর খোরশেদ ভাই বের হলাম আরেকটা আস্তানার খোঁজে। অবশ্য আলি হোসেন পরে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।

পুরোনো গাছের গুঁড়ি, লতা, গুল্ম, উইয়ের ঢিবি, শুকনা গাছ আর কর্দমাক্ত মেঠো পথ পেরিয়ে আবিষ্কার করলাম, বনের ভেতরে কয়েকটি বসতবাড়িও আছে। তাদের মাটির ঘরগুলো বনের পরিবেশের সঙ্গে বেশ মানানসই। মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া নর্ত নদ, শরতের নীল-সাদা আকাশ, কাশবন, উঁচু–নিচু সবুজ ঘাসের টিলা—সব মিলিয়ে অপূর্ব। জীবনানন্দের রূপসী বাংলার প্রতিচ্ছবিই যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে চোখের সামনে। নদীর ওপর একটি সেতু আছে। পাশেই বাংলোর মতো স্থাপনা, সেগুলো রেস্ট হাউজ ও বন বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য ব্যবহৃত হয়। সামনে মাঝারি একটা আমবাগান, জায়গাটা পরিষ্কার। এখানেই পুরো দিনের জন্য বসার ব্যবস্থা করা হলো। নর্ত নদ বনের মাঝ দিয়ে ইংরেজি বর্ণ ‘S’–এর মতো করে কয়েকটা বাঁক খেয়েছে। এ পাশটায় এসেও নদীর পাড় পেয়েছি আমরা। ক্ষুধা চরমে, বসামাত্রই খাবারের ওপর একরকম ঝাঁপিয়ে পড়লাম। চমৎকার রান্না হয়েছ, ঠাকুরগাঁওয়ের বিখ্যাত চৌধুরীহাট থেকে কেনা রুপচাঁদা মাছের ফ্রাই, বুটের ডাল, সাদা ভাত, মাংস, সালাদ আর শেষে ফালুদা দিয়ে অসাধারণ এক লাঞ্চ হলো। খাওয়া শেষে প্রকৃতির মধ্যে নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে পড়লাম সবাই। শহুরে কোলাহল, ব্যস্ততা, যান্ত্রিকতামুক্ত কয়েক মুহূর্ত। এমন নীরবতা আর প্রকৃতিকে কাছ থেকে অনুভব করাটা আসলেই খুব প্রয়োজন ছিল। বিকেলে ক্রিকেট শুরু হলো, এক দশক পর ব্যাট হাতে নিয়ে মনে হচ্ছিল, শৈশবে ফিরে গিয়েছি। খেলা শেষে যে যার মতো খালি গলায় গান গাওয়া, ধ্যান করা, কৌতুক, অভিনয় হইহুল্লোড় আরও নানা কিছু মিলে সিংড়া জাতীয় উদ্যানে অসাধারণ উপভোগ্য একটি দিন কেটেছিল আমাদের। বুঝলাম, ভ্রমণ মানেই যে বড় আয়োজন বা দূরে কোথাও যেতে হবে তা নয়, মাঝেমধ্যে ছোট পরিসরে এমন প্রকৃতি দর্শন আমাদের প্রাণশক্তি ও চাঞ্চল্য ফেরাতে পারে।