সিলেটে দুই দিনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খোঁজ

তামাবিল সীমান্ত। গোয়াইনঘাট, সিলেটছবি: লেখকের পাঠানো

সিলেট সুরমা নদীর তীরবর্তী বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এ শহরটিকে দেশের অনেকে ‘আধ্যাত্মিক’ রাজধানীও বলেন। সিলেটকে অতীতে শ্রীহট্ট এবং সুলতানি আমলে জালালাবাদ নামে ডাকা হতো। ‘শ্রীহট্ট’ নাম থেকেই ‘সিলেট’ নামের উৎপত্তি হয়েছে, যেখানে ‘শ্রী’ মানে সুন্দর ও ‘হট্ট’ মানে মানব বসতি। সুলতানি আমলে এই অঞ্চলের নাম ছিল জালালাবাদ। সিলেট অঞ্চলকে ৩৬০ আউলিয়ার ভূমি বলা হয়।

সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে একে অনেক সময় ‘প্রকৃতির কন্যা’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। সিলেট বাংলাদেশের উত্তর–পূর্বে অবস্থিত একটি প্রাচীন জনপদ। বনজ, খনিজ ও মৎস্য সম্পদে ভরপুর এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এ জেলা খ্যাত। হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর দরগাহ, হজরত শাহপরাণ (রহ.)–এর দরগাহ, চা–বাগান, জৈন্তিয়া পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য, জাফলংয়ের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য, ভোলাগঞ্জের সারি সারি সাদাপাথরের স্তূপ, পাথরের বিছানাখ্যাত বিছনাকান্দি, গোয়াইনঘাট উপজেলার রাতারগুল জলাবন, তামাবিল বর্ডার, ও জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল পর্যটকদের বারবার টেনে আনে।

মালনীছড়া চা–বাগান, বিমানবন্দর সড়ক, সিলেট
ছবি: লেখকের পাঠানো

সিলেট ভ্রমণ

আমাদের টিম ‘বেঙ্গল ট্রাভেলার্স’ নিয়ে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে সিলেট ভ্রমণ শুরু হয়। প্রায় ১০ ঘণ্টা ট্রেনে ভ্রমণ শেষে সকাল সাড়ে সাতটার দিকে সিলেট রেলস্টেশনে পৌঁছাই। রেলস্টেশন থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে চলে যাই দরগাহ গেট। সেখানেই সকালের নাশতা সারি। দুই দিনের ভ্রমণে হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর মাজারের পাশে হোটেল মুসাফিরে উঠি। আমরা ছিলাম ১১ জন (আমি, হারুন, আলী রেজা, মোরশেদ, রোহান, আলী আরমান আহমেদ ইসবাত, রিটন, আদিবা, নাজিয়া আক্তার রূপা, মাহবুবা তৈয়ব ঐশী ও মারিয়া)। আমরা দুই দিনের জন্য রিজার্ভ গাড়ি ভাড়া করি।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]

আমাদের প্রথম গন্তব্যে ছিল বিমানবন্দর সড়ক হয়ে মালনীছড়া চা–বাগান। এটি উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন চা–বাগান। মালনীছড়া চা–বাগান বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের বৃহত্তম ও প্রথম প্রতিষ্ঠিত চা–বাগান। এখানে ঘোরাঘুরি করে চলে যাই পরবর্তী গন্তব্যে গোয়াইনঘাট উপজেলায় রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্টে। রাতারগুল ‘সিলেটের সুন্দরবন’ নামে খ্যাত। চেঙ্গির খাল হ্রদের মাধ্যমে বনটি গোয়াইন নদের সঙ্গে সংযুক্ত। এখানে পাড় থেকে নৌকা ভাড়া করে চলে যাই জলাবনের ভেতরে। একটু পরই আমরা ঢুকে যাই রাতারগুল জলাবনে। এখানে পানিতে ভাসতে ভাসতে দেখতে পাবেন গাছগাছালির অপূর্ব সৌন্দর্য। জলাবনে যাওয়ার পথে মাঝির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গান। এটি মূলত বাংলাদেশের একমাত্র সোয়াম্প ফরেস্ট। এরপর চলে যাই গ্রামীণ আঁকাবাঁকা পথ ধরে ভোলাগঞ্জে সাদাপাথরে। সেখানে রেস্তোরাঁয় দুপুরে খাওয়াদাওয়া শেষে ধলাই নদের তীর থেকে নৌকা ভাড়া করে চলে যাই দেশের সর্ববৃহৎ পাথর কোয়ারি অঞ্চল সাদাপাথরে। দৃষ্টিনন্দন এই স্থানের অবস্থান বাংলাদেশ–ভারত সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে।

রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট। গোয়াইনঘাট, সিলেট
ছবি: লেখকের পাঠানো

ভারত অংশে সবুজে আচ্ছাদিত সারি সারি পাহাড় ও আকাশে মেঘের খেলা। বাংলাদেশ অংশে ‘পানির মধ্যে পাথরের বিছানা’খ্যাত সাদাপাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত স্বচ্ছ শীতল পানিতে গা ভাসিয়ে দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করি। এরপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আবার নৌকা করে ঘাটে ফেরার পালা। গাড়িতে চলে আসি হোটেলে। হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চলে যাই সুরমার তীরে সিলেট শহরে। নদীর তীরে কিছুটা সময় আড্ডা দিতে বেজে উঠল কিনব্রিজ‌ের পাশে আলী আমজদের ঘড়ি। এটি ঊনবিংশ শতকের একটি স্থাপনা, যা মূলত একটি বিরাটাকার ঘড়ি। এটি একটি ঘরের চূড়ায় স্থাপিত। এরপর আশপাশে ঘুরে বেড়াই। রাতে খাওয়াদাওয়া করে হোটেলে ঘুমিয়ে পড়ি।

দ্বিতীয় দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চলে যাই হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর দরগাহে। দরগাহ চত্বরে সুলতান ও মোগল আমলে নির্মিত বিভিন্ন স্থাপনা রয়েছে। জিয়ারত শেষে বেরিয়ে পড়ি প্রায় ঘণ্টা দুই–এক গাড়িতে করে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় লালাখালের উদ্দেশে। গোয়াইন নদের সারিঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করে চলে যাই লালাখালের সৌন্দর্য দেখতে। নদের দুই পাশে গ্রামীণ পরিবেশ আর একটু পরপর নদী থেকে বালু উত্তোলন, যা এক অন্য রকম অনুভূতি। নদের গহিনে দেখা মিলল স্বচ্ছ নীল পানি, যা সিলেটের বুকে একটুকরা ‘মালদ্বীপ’। এর পাশে রয়েছে পাহাড়ের টিলায় চা–বাগান। প্রাকৃতিক পরিবেশে সেখানে চা পান করি, যা এক স্বর্গীয় অনুভূতি। ওখান থেকে চলে আসি আবার ঘাটে। ঘাটে অপেক্ষায় থাকা গাড়িতে চা–বাগানের পথ ধরে চলে যাই তামাবিল সীমান্তে। তামাবিল স্থলবন্দরটি সিলেটের অন্তর্গত গোয়াইনঘাট উপজেলার তামাবিলে গোয়াইন নদের উপকণ্ঠে অবস্থিত। এর বিপরীতে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডাউকি সীমান্ত। উভয় পাশে কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন অফিস এবং সড়কপথ।

এরপর চলে যাই আমাদের ভ্রমণের শেষ গন্তব্যস্থল জাফলং। বাংলাদেশের সিলেটের সীমান্তবর্তী এলাকায় জাফলং অবস্থিত। এর অপর পাশে ভারতের ডাউকি অঞ্চল। ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া–জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এবং এখানে পাহাড় ও নদীর অপূর্ব সম্মিলন বলে এই এলাকা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটনস্থল হিসেবে পরিচিত। ডাউকি অঞ্চলের পাহাড় থেকে ডাউকি নদী এই জাফলং দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মূলত পিয়াইন নদীর অববাহিকায় জাফলং অবস্থিত। পর্যটনের সঙ্গে জাফলং পাথরের জন্যও বিখ্যাত। সীমান্তে ভারতের পাহাড়–টিলা, ডাউকি পাহাড় থেকে অবিরাম ধারায় প্রবহমান জলপ্রপাত, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল পানি ও উঁচু পাহাড়ে গহিন অরণ্য চোখে পড়ে। জাফলংয়ে কেনাকাটা করে চলে যাই সিলেট রেলস্টেশনে। রেলস্টেশনে রাতে খাওয়াদাওয়া করে রাত ১০টার ট্রেনে সকালে চট্টগ্রাম পৌঁছাই।

লালাখাল
।ছবি: লেখকের পাঠানো

সিলেট ভ্রমণে যে উপলব্ধি জেগেছে মনে, তা হলো পর্যটকেরা যাতে সারা বছর নির্বিঘ্নে সিলেট যেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করা দরকার এবং ট্রেনে ভ্রমণে নিরাপত্তার জোর দাবি জানাচ্ছি। আমি এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আশা করি, সিলেটের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের পর্যটকবান্ধব সব স্থানের লোকজনের প্রত্যাশা পূরণ হবে।
লেখক: মো. জোবাইর হোসেন, ভ্রমণপিপাসু।