দার্জিলিংয়ের লেপচা ও লামাহাট্টা ভ্রমণ: ডারচোর ও লুংতা পতাকা

অনেক আকাঙ্ক্ষিত হলেও কিছুটা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবারের যাত্রা ভারতের উত্তরে। শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, কালিম্পং—এ রুট ধরে আমাদের ভ্রমণ।

ভ্রমণের প্রধান কারণ তিন ‘স’। সমরেশ, সত্যজিৎ, আর আমার সহধর্মিণী। কলেজজীবনে সমরেশ মজুমদারের বই পড়ার পর থেকেই মাথার মধ্যে জলপাইগুড়ির চা-বাগান ঘুরপাক খাচ্ছে। আরেক ‘স’ হলেন সত্যজিৎ রায় সাহেব তাঁর ‘দার্জিলিং জমজমাট’–এ কাঞ্চনজঙ্ঘার সাবলাইম সৌন্দর্যের বর্ণনা করেছেন, তা আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে।

এবার আসল ‘স’ আমার সহধর্মিণী। ভ্রমণে তাঁর আগ্রহ যেন অন্য মাত্রায়। মাইলের পর মাইল হাঁটতে তাঁর ক্লান্তি নেই। পাহাড়-ঝরনা ঘুরে দেখার জন্য তিনি তাঁর জমানো টাকা খরচ করতেও কুণ্ঠিত হন না। খেয়ে না–খেয়ে তিনি শুধু ফন্দিফিকির করতে থাকবেন কীভাবে ঘুরতে গিয়ে তালিকার চেয়ে একটা বেশি কিছু দেখে ফেলা যায়।

এখন নিজের মাথার শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কাঞ্চনজঙ্ঘার পোকা বউয়ের মাথায় দেওয়া প্রয়োজন ছিল। তিনি জানেন আমি বইপ্রেমী, তিনি নিজেও তা। বিয়ের প্রথম দুই বছর বাংলা একাডেমির বইমেলায় তাঁকে নিয়ে সমরেশত্রয়ী খুঁজলাম, দাম বেশি, না কিনে মন খারাপ করে ফিরে গিয়েছি। পরে তিনি নিজেই আমাকে নীলক্ষেত থেকে ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ আর ‘কালপুরুষ’ কিনে দিলেন। প্ল্যানের প্রথম ধাপ সফল। আমার তো আগেই পড়া এগুলো, এখন পড়বেন তিনি। আর আমার যা ভাবা তা–ই, তাঁর মাথাতেও এখন শিলিগুড়ি–জল্পাইগুড়ির পোকায় কিলবিল। অনেকটা ‘মেটিকিউলাস প্ল্যান’–এর মতো আমার কর্ম সার্থক। অঞ্জন দত্তের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ গানটার যে প্রভাব নেই, তা বললে কিন্তু ভুল হবে। আমি সত্যিই সত্তর টাকা নিয়ে যাচ্ছি, যদি কানের মাকড়ির দামটা অন্তত দেওয়া যায়।

আমাদের ভ্রমণ শুরু হয় কিছু অফবিট জায়গা দিয়ে। মিরিক লেক ঘুরে দার্জিলিং থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে অসম্ভব সুন্দর নিরিবিলি পাইনবনে মোড়া পাহাড়ি গ্রাম লেপচা জগৎ। সোজা বাংলায় লেপচাদের জগৎ। পাহাড় ও পাইনবন ঘেরা অসম্ভব সুন্দর এই গ্রামে যদিও এখন পর্যটকের আনাগোনা বেড়েছে কিছুটা।

শিলিগুড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে শেয়ার বা রিজার্ভ গাড়িতে মিড়িক বা কার্শিয়াং হয়ে যাওয়া যায় পাহাড়ের কোলে ছোট্ট কিন্তু অসম্ভব সুন্দর মায়াবী এই গ্রামে। যেখানে রোদের খেলার মাঝে কখন যে মেঘের চাদর আপাদমস্তক ঢেকে দেবে এই পাহাড়ি ভূমিকে, বুঝতেই পারা যায় না। ভোরের আলো ফুটে উঠতেই হোমস্টের বারান্দা বা পাইনবনের মাঝে সুন্দর করে সাজানো ভিউ পয়েন্ট থেকে কঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাওয়া, কিংবা সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দূর পাহাড়ের গা–ঘেঁষা আলোঝলমলে দার্জিলিং শহর দেখা—এ এক অন্য রকম অনুভূতি। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তার দুপাশে পাইনবন, হিমালয় থেকে ধেয়ে আশা কাঁপন–ধরানো শীতল বাতাস, হুট করে এসে ঢেকে দেওয়া শ্বেতশুভ্র মেঘ, এ যেন কল্পনার রাজ্য। হোমস্টের বারান্দা থেকে প্রথম সূর্যের কিরণে সোনালি কাঞ্চনজঙ্ঘার আবির্ভাব অবলোকন—এ সত্যি মনোমুগ্ধকর। হোমস্টে থেকে কিছুটা দূরে পাহাড়ের কোলে কাঞ্চনজঙ্ঘা ভিউপয়েন্টের বেঞ্চিতে বসে মেঘের সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘার লুকোচুরি খেলা এক মায়াবী অনুভূতি।

ছোট্ট এই গ্রামে হাতে গোনা কয়েকটি হোমস্টে, কিন্তু প্রতিটিই অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো অসংখ্য ফুল ও অর্কিডের সারিতে। সবচেয়ে অবাক করে এখানকার স্থানীয় লেপচাদের আতিথেয়তা। দার্জিলিংয়ের সবচেয়ে পুরোনো আদিবাসী লেপচাদের এ আদি নিবাস সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৯৫৬ ফুট উঁচুতে হলেও তারা যেন একেবারে মাটির সঙ্গে আত্মিক। প্রকৃতিই তাদের কাছে সব। অসম্ভব কর্মঠ কিন্তু মিষ্টভাষী লেপচাদের অমায়িক ব্যবহার সত্যি গ্রামটির মতোই সুন্দর।

লেপচাজগতের যে হোমস্টেতে আমরা রাতে উঠেছিলাম, সকালে ছাদে গিয়ে পাহাড়, পাইনবন ও মেঘের খেলা দেখতে দেখতেই চোখে পড়ল ছাদের চার কোনে উজ্জ্বল হলুদ, সবুজ, সাদা, লাল রঙের কাপড়ের পতাকা টাঙানো, দেখতে খুব সুন্দর লাগে। এরপর রাস্তায় হাঁটতে বের হয়ে, পাহাড়ের ভিউপয়েন্টে, রাস্তার এপার থেকে ওপার, প্রায় প্রতিটি গাড়ির ব্যাক গ্লাসে, মোটরবাইকের দুই লুকিং মিররের মধ্যে সুতা দিতে টানা। দেখতে ভালোই লাগে, মনে হয় অনেকটা উৎসব উৎসব ব্যাপার।

তৃতীয় দিন লামাহাট্টা গেলাম। সবুজ পাইনবনের মাঝে অবস্থিত এই জায়গা ২০১৩ সালে চালু হওয়া একটি ইকোট্যুরিজম পার্ক। জনপ্রতি ২০ রুপি দিয়ে ঢুকলেই সামনে অসংখ্য রঙের ও নানান প্রজাতির ফুলগাছে সাজানো খুব সুন্দর একটি বাগান আর তার পেছনেই পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা অতন্দ্রপ্রহরীর মতো আকাশ ভেদ করে উঠে যাওয়া পাইনগাছের সারি। ওপরে উঠলেই ওয়াইল্ড লাইফ জোন। সেখানটায় পাইনবনটি যেন এক নৈস্বর্গ। পাইনগাছগুলোকে দেখতে দেখতে ওপরে উঠে যাওয়া, বনের ঝোপ থেকে কোনো এক হরিণশাবকের হুট করে ছুটে যাওয়া, পাইনের সারির ফাঁকে আলো–আঁধারির খেলা, দূর থেকে ভেসে আসা পাহাড়ি মেঘের পাইনবনে মিশে যাওয়া দেখে শান্ত আদৃত মনে নেমে পর্যটকদের জন্য রাখা বেঞ্চগুলোয় বসে জিরিয়ে নেওয়ার সময় পাহাড়ি বাতাস ও সেই বাতাসে ঢেউ খেলা আবারও সেই পাঁচরঙা পতাকাগুলো নজর কাড়ল, তবে এগুলো একটু অন্য রকমের, খুঁটি গেড়ে সারিবদ্ধভাবে লাগানো।

জাতিতে শেরপা, লেপচা ও ভুটিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত লামাহাট্টা কিংবা লেপচার বাসিন্দারা তাদের সংস্কৃতি, উষ্ণ অভ্যর্থনা ও আতিথেয়তার জন্য বেশ পরিচিত। পর্যটকদের সঙ্গে তাদের ব্যবহার অনন্য।

কোথাও ভ্রমণে বের হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি স্থানীয় জনমানুষের চালচিত্র, জীবনযাপন, অনুভূতি ও সংস্কৃতিও আমাকে অনেক আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে নির্দিষ্ট কোনো ঐতিহ্য, আচার-আচরণ, বিশ্বাস, মিথ, বিশেষ কোনো সিম্বল—এসব। তাই গতবারের মেঘালয় ভ্রমণের সেং-খাসি মুভমেন্টের রোস্টার সিম্বলের মতো এই এলাকার কোনো কিছু পাওয়া যায় কি না, সেদিকে আমার অবচেতন মন বারবার নাড়া দিচ্ছিল।

প্রথমে না দেখলেও পরে খেয়াল করলাম, পতাকায় নানা রকম নকশা ও লেখা। সেই সঙ্গে কোনোটাতে বাঘ, গরুর, ড্রাগন ও তুষারসিংহের আঁকা ছবি, বিশেষ করে ঘোড়ার ছবি। হিমালয় থেকে ধেয়ে আশা বাতাসে পতাকাগুলো যখন উড়তে থাকে, ঘোড়াটিকে মনে হয় টগবগিয়ে ছুটে চলছে।

এই রংবেরঙের নকশা আঁকা পতাকা দেখতে দেখতে ও এ নিয়ে মনে প্রশ্ন বয়েই দার্জিলিং ও এর আশপাশ ভ্রমণ করে চলছিলাম। ঠিক তেমনই এক দিন গেলাম দার্জিলিং থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দূরে তিনচুলেতে, অসম্ভব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাচুর্য থাকলেও দর্শনার্থী তেমন নেই; পাহাড়, মেঘ ও চা–বাগানের মন–ভোলানো ভিউতে ওখানেই আমাদের সন্ধ্যা হয়ে যায়, পাহাড়ি রাস্তা ধরে ফিরতে হবে আবার পাহাড়ে সন্ধ্যা মানেই মুহূর্তেই অন্ধকার, সেই সঙ্গে রয়েছে হুট করে মেঘের চাদরে রাস্তা ঢেকে যাওয়া। শুনতে অনেক রোমাঞ্চকর মনে হলেও এ এক ভয়ানক পরিস্থিতি, গাড়ির ফগলাইট জ্বালিয়েও দুই হাত দূরের কিছু দেখা যায় না। সেই সঙ্গে রয়েছে পাহাড়ি জীবজন্তুর হুট করে গাড়ির সামনে চলে আশা। এমন অবস্থায় আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন এক বুড্ডিস্ট মঙ্ক। স্থানীয় মানুষের কাছে অনেক সম্মানিত একজন ধর্মীয় গুরু, জরুরি প্রয়োজনে তাঁর দার্জিলিং যেতে হবে, কিন্তু এ সময়ে অন্য কোনো গাড়ি তিনি পাবেন না। আমাদের চালক অভিষেকের অনুরোধে এ বিদেশ–বিভুঁইয়ে, সঙ্গে আমার সহধর্মিনী থাকা সত্ত্বেও আমরা কিছুটা সংশয় মনে নিয়েই তাঁকে সঙ্গে নিলাম। মনে একটা ক্ষীণ আশা, তাঁর থেকে এই রঙিন পতাকার বিষয় জানা যাবে। কিন্তু সেই আশার গুড়ে ছাই। আমি যতই জিজ্ঞেস করি এই পতাকাগুলো কী? কী লেখা আছে? কেন টাঙানো হয়, কোনো এক অদ্ভুত কারণে তিনি প্রতিটা জিজ্ঞাসাকেই এড়িয়ে গেলেন। বারবার কেবল বললেন এতে মন্ত্র লেখা। যে–ই আমি জিজ্ঞাসা করি, মন্ত্রে কী লেখা, মন্ত্রের মানে কী? তিনি আর উত্তর করেন না। আর কী করা হতাশ হয়েই ফিরতে হলো।

এরপর চ্যাটজিপিটি আর গুগল সার্চের পালা। এবার আর মেঘালয়ান কক বা রেড ককের মতো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। বেশ ভালো ও তথ্যবহুল কিছু ডকুমেন্টারি খুঁজে পেলাম গুগলে। পড়লাম ও জানলাম এ পতাকা তিব্বতিয়ান ঐতিহ্য বহন করে। উজ্জ্বল রঙের চার কোনা এই কাপড়ের পতাকাগুলো হিমালয় ও এর চারপাশের অঞ্চলগুলোয় প্রেয়ার ফ্ল্যাগ বা প্রার্থনার পতাকা বলা হয়।

এর উৎপত্তি প্রাচীন তিব্বতে, যেখানে এগুলো মূলত প্রাক্‌-বৌদ্ধধর্মে ব্যবহৃত হতো। এ ধর্মের শামানরা তাঁদের রোগ নিরাময়ের আচার-অনুষ্ঠানে সাধারণত পতাকাগুলো ব্যবহার করতেন। আরেকটি তত্ত্ব অনুযায়ী, ভারতীয় বৌদ্ধসূত্রগুলো কাপড়ে লিখে পবিত্র শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রথা থেকে এর ব্যবহার শুরু।

প্রতিটি পতাকা, এর রং, লেখা বা মন্ত্রের ও ছবির রয়েছে গভীর অর্থ।

মূলত পাঁচটি রঙের হয় এ পতাকাগুলো। বাঁ থেকে ডানে একে একে নীল, সাদা, লাল, সবুজ ও হলুদ রঙের পতাকা থাকে। সাদা পতাকা বায়ুর প্রতীক, লাল আগুনের, সবুজ জলের, হলুদ পৃথিবীর এবং নীল হলো আকাশ। গাড়িতে বা বাড়িতে সবচেয়ে বেশি যে মন্ত্রযুক্ত পতাকা দেখা যায়, সেটি হচ্ছে তিব্বতি লিপিতে ছয় অক্ষরের আধ্যাত্মিক মন্ত্র ‘ওম মণিপদ্মে হুম’ লেখা পাঁচটি পতাকা। এই মন্ত্র তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে সর্বাপেক্ষা পবিত্রতর মন্ত্র হিসেবে গণ্য হয়। ছয়টি অক্ষর ছয়ভাবে মানুষকে বিশুদ্ধ করে বলে তিব্বতীয় বিশ্বাস।

ওম: অহংকার থেকে বিশুদ্ধ করে।

ম: ঈর্ষা ও বাকশক্তি বিশুদ্ধ করে।

ণি: কামনা ও মনের আসক্তি থেকে বিশুদ্ধ করে।

পদ: অজ্ঞতা থেকে বিশুদ্ধ করে।

মে: লোভ থেকে বিশুদ্ধ করে।

হুম: হিংসা থেকে আত্মাকে বিশুদ্ধ করে।

প্রার্থনার পতাকা দুই ধরনের হয়

লুংতা: এটিতে একটি সুতার মাধ্যমে ৫টি পতাকা রঙের ক্রম অনুসারে অনুভূমিকভাবে ঝুলানো হয়।

ডারচোর: এটি ভূমিতে খুঁটিতে লাগানো হয় এবং বিশেষ স্থান চিহ্নিত করে। লামাহাট্টারগুলো ছিল এই ডারচোর।

পতাকাগুলো সব সময় বাতাস বয়ে চলে—এমন স্থানে টানানো হয়, এখানে ধর্মীয় বিশ্বাস হলো, বাতাসের মাধ্যমে এ মন্ত্রগুলোর শক্তি সবদিকে ছড়িয়ে পড়বে।

তিব্বতীয় অত্যন্ত আদি ভাষায় লেখা এ মন্ত্রযুক্ত পতাকার সঙ্গে পরিচয়, স্থানীয় মানুষের বৈচিত্র্যময় বিশ্বাস ও জীবনযাপন কাছ থেকে দেখা, আমার কাছে ভ্রমণের আসল সুন্দরতা তো এখানেই।

ও হ্যাঁ, লেপচার হোমস্টের বারান্দা থেকে, দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান রেলস্টেশনের অনেক নিচের এক অখ্যাত হোটেলের ছাদ থেকে কিংবা ক্যাভেন্টার্সে হট কফি খেতে খেতে প্রতিদিন কিভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পেয়েছি ও কেমন অনুভূত হয়েছে, সেই গল্প নাহয় আরেক দিন করব। সময়স্বল্পতার কারণে এবার কালিম্পং যাওয়া হয়নি, থাকুক না কিছু ঋণ, কানের মাকড়ি বেচার সেই সত্তর টাকার ঋণ নাহয় বয়েই বেড়ালাম।