বনলতার শহরে একদিন–২
দিঘাপাতিয়া জমিদারবাড়ি..
প্রাসাদের উত্তর পাশে আমবাগান। অন্য গাছও আছে। এ বাগানের একাংশে নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল, যা পুরো রাজবাড়ির বিদ্যুতের চাহিদা মেটাত। পরিখার কোল ঘেঁষে জল উত্তোলনের নলকূপ। যদিও এখন আর জল তোলার প্রয়োজন নেই। বড় বড় গজার মাছ, পরিখার জলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কখনো মিলিয়ে যাচ্ছে গভীর জলে। আবার ভেসে ওঠে যততত্র। ধরার সাধ্য নেই। নয়তো খালি হাতে ফিরতাম না।
জোহরের আজান পড়ে গেল। ক্ষুধার তাড়নাও জানান দিচ্ছে। একটু রেস্ট নিয়ে বেরিয়ে যাব রাজবাড়ি থেকে। বসলাম গ্র্যান্ডমাদার প্যালেসের সামনে পরিযায়ী বৃক্ষের ছায়াতলে। যেসব রানির রাজা মারা যেত অথবা বৃদ্ধ হতো, তাদের জন্য এ প্রাসাদ বরাদ্দ ছিল। অনেকটা আধুনিক বৃদ্ধাশ্রম বলা চলে। বসে দেখছি কুমার ও প্রধান প্যালেসের সামনের গ্রাউন্ডের দৃশ্য। যেন পার্কের আদলে ফুলবান বৃক্ষের সাজানো বাগান। বোতল ট্রি দাঁড়িয়ে আছে শিরদাঁড়া উঁচু করে, পাতাগুলো স্তব্ধ এক বিন্দুও নড়ছে না।
আর দেরি করা ঠিক হবে না, আরও একটা স্থান ভ্রমণ বাকি। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। উত্তরা গণভবন থেকে বের হয়েই খাবারের দোকান খুঁজছিলাম সামনের ছোট্ট বাজারে। বাজারটা গণভবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে হয়তো। এক পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী লোক ডাকছে, ‘মামা আসেন আসেন গরু, খাসি, মুরগি, হাঁস, মিষ্টি সবই আছে আসেন আসেন।’ শেফালী হোটেল অ্যান্ড মিষ্টান্ন ভান্ডার। খাবারের সেকি দাম; হাঁসের চামড়ার বটও নাকি ১২০ টাকা প্লেট। বাকি তরকারির দাম শুনে রীতিমতো ভড়কে গেলাম। ডিম-ভাত খেয়ে কোনোরকমে ক্ষুধা নিবারণ করলাম। তবে খারাপ নয়, পেটের ৩ অংশ ভালোমতোই ভরল।
এবার শেষ গন্তব্য পাটুল; মিনি কক্সবাজারখ্যাত হালতি বিল। স্নিগ্ধর আগ্রহ বেশি বিল দেখবে, নৌকাভ্রমণ করবে। অটো নিলাম। প্রায় ১০ কিলোমিটার পথ। গ্রামের মধ্য দিয়ে সরু রাস্তা, তবে পাকা। সর্পের মতো আঁকাবাঁকা। পাশাপাশি দুটি অটো ক্রসিং করতেই বেগ পেতে হয়। এটাই গ্রামের রাস্তার সৌন্দর্য। কখনো ছাগল বা হাঁস, মুরগিকেই সাইড দিয়ে চলতে হচ্ছে। রাস্তার দুধারে সারি সারি গাছ—তাল, নারকেল, সুপারি। ইউক্যালিপটাস, মেহেগনিসহ অন্যান্য গাছও আছে। কিছু জায়গায় এত তালগাছ দেখলে মনে হবে, নওগাঁর ঘুঘুডাঙা। খেজুরগাছগুলো রস সংগ্রহের জন্য প্রসেস করে রাখা হয়েছে। বেচারা আগামী চার মাস রস দেবে। তারপরও সারা বছর অবহেলায়-অযত্নে দাঁড়িয়ে থাকে নির্বিকার রাস্তার পাশে, উঠানে অথবা জমির আলে; প্রয়োজন ফুরালে দূরত্ব বাড়ে।
সবুজ ধানি জমি আর সবুজ নেই, হলুদ আঁচল জড়ানো। বিশাল বিশাল মাঠ। কৃষকেরা ধান কাটতে ব্যস্ত। নবান্ন উৎসব নয়, তবে এক অন্য রকম আনন্দ। পিঠাপুলির সমাহার গ্রামে গ্রামে এ সময়। গ্রামের বাড়িগুলো কাঁচা থেকে বহুতল ধাঁচের। তবে অধিকাংশই টিনের। কিছু চোখে পড়ল মাটির বাড়ি, কারও বাড়িতে পাটকাঠির বেড়া। উঠানেই গরু বাঁধা, পাশে খড়ের পালা। বাছুরটা মায়ের আশপাশে ছোটাছুটি করছে। মনভরে দেখছি। কত দিন দেখা হয় না। ইটপাথরের রাজ্যে সব চাকচিক্য, গ্রামের নির্মল বাতাস আর প্রশান্তির বালাই নেই।
পাটুল পৌঁছালাম। হালতি বিল। চলনবিলের অংশ। থই থই করছে পানি। অনেকটাই স্বচ্ছ। কিছু কিছু স্থানে কচুরিপানার রাজত্ব ব্যাপকভাবে। এ বিলে চারটি গ্রাম; জলের ওপর ভেসে আছে। ধু ধু করছে। একটা পাকা রাস্তা বিল চিড়ে চলে গেছে উত্তরের গ্রামের দিকে, কখনো সোজা, কখনো বাঁক নিয়ে। কিন্তু বোঝা দায়, এখানে রাস্তা আছে। পুরোটাই পানির অন্তরালে। যেখানে পানি কম, কচুরিপানা জানান দিচ্ছে এটা রাস্তা। বোরো মৌসুমে এ বিলে সবুজের সমারোহ। বছরে একবারই ধান চাষ হয়। প্রাকৃতিকভাবে মৎস্যের বংশবিস্তার ও অভয়ারণ্য হিসেবে উপযুক্ত।
বুঝলাম, কেন মিনি কক্সবাজার বলে পরিচিত। সারি সারি রংবেরঙের ইঞ্জিনচালিত নৌকা বাঁধা। ভ্রমণকারীদের দেখলেই ডাকছে, ‘নৌকা লাগবে নৌকা, চারটা গ্রাম ঘোরাব।’ কেউ ৪০০, কেউ ৬০০, কেউ আরও বেশি ভাড়া হাঁকছেন। আগে পানিতে হাঁটাহাঁটি করি। কত দিন এভাবে পানিতে পা ভেজাইনি। এলাকার অনুভূতি নিচ্ছি প্রাণভরে। ব্রহ্মপুর নদের বুকে পানিকে আলিঙ্গন করেই আমার বসবাস। বিকেলে খেয়াঘাটে বাঁধা ডিঙিটায় বসে থাকতে কার না ভালো লাগে।
কাশেম আর স্নিগ্ধ নৌকায় চড়বেই, নয়তো ভ্রমণ অপূর্ণই থেকে যাবে। আমার আর আশরাফুলের তেমন ইচ্ছা নেই। ইসমোও বলছে, ও প্রায়ই নৌকাভ্রমণ করে। ওরও ইচ্ছা নেই। এদিকে সময়ও নেই। নৌকা দিয়ে চারটা গ্রাম ঘুরে আসতেই সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আবারও দুজন লোক ঘিরে ধরলেন, ‘মামা, নৌকা নেন। বিলে আইবেন নৌকায় চড়বেন, তা–ই কি হয়।’ আবার আগের মতোই দাম। এক মামা বললেন, ‘চলেন, আপনারা পাঁচজন ২০০ টাকা দিয়েন ওই খোলাবাড়িয়া জিরো পয়েন্ট থিকা ঘুরাইয়া আনমু, এক ঘণ্টার মতো লাগবার পারে।’ এবার পিছপা হলাম না, সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেলাম। এর চেয়ে সস্তা হতে পারে না।
মামার নাম জহিরুল; বয়স পঞ্চাশের একটু ওপার। নরম মনের, কথাবার্তায় যতটুকু বুঝলাম। আগ্রহ নিয়ে নৌকাটা আমিই ছাড়লাম। মামাকে ইঞ্জিন স্টার্ট দিতে দিলাম না, নিজেই দিলাম। এসব কাজের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছি শৈশব থেকে, না পারার প্রশ্নই আসে না। কিছুক্ষণ নৌকাও চালালাম। মামা ডিরেকশন দিলেন কোনো পাশ দিয়ে যেতে হবে। নৌকা চলছে স্থির পানি উত্তাল করে। কচুরিপানাগুলো ঢেউয়ে দোল খাচ্ছে। বিলের মাঝে সারি সারি অসংখ্য কারেন্টের খাম্বা এক গ্রামকে আরেক গ্রামের সঙ্গে সংযোগ করেছে বিদ্যুৎ দিয়ে।
হালতি বিলের ঠিক মাঝে এক নান্দনিক রিসোর্ট; দ্য ওয়েসিজ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। ডুবন্ত সে রাস্তাটার পূর্ব পাশেই অবস্থান। কোনো এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার। দূরের ভ্রমণকারীদের রাতযাপনের জন্য রিসোর্টটি একমাত্র ভরসা। তবে ভ্রমণকারীকে অবশ্যই পয়সাওয়ালা হতে হবে; বিলাসবহুল রিসোর্ট বলে কথা। ৫ আগস্টের পরই রিসোর্টের রফাদফ অবস্থা। ভেঙেচুরে ছারখার করা হয়েছে এর নন্দনতত্ত্ব।
বিলের ভিউটা দারুন। ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দীর জন্য অসাধারণ। অতিথি পাখি থাকলে অসম্ভব সুন্দর লাগত। স্নিগ্ধ আর ইসমো বেশ জৌলুশে কমসে কম শ খানেক তুলেছে, তুলেই যাচ্ছে নানা ভঙ্গিমায়। কী খুশি ওরা! মন এবং মাধুর্যের মিল হলে খুশি হওয়ারই কথা। প্রকৃতি মমতাময়ী নারীর মতো, সহজেই মন ছুঁয়ে যায়। কাশেম আর আমিও তুললাম আজাইরা রঙে আর ঢঙে। আশরাফ নৌকার ছাদে বসে আমাদের দেখছে, দেখছে ওই দ্বীপসদৃশ খোলাবাড়ি।
খোলাবাড়ি; হালতি বিলের মূল কেন্দ্র। জিরো পয়েন্টও বলে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত বৃত্তাকার ছোট কৃত্রিম দ্বীপ। মাঝে একটি স্তম্ভ। চারপাশে ছোট ছোট টংদোকান। বিলে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীদের ওপরই নির্ভর দোকানিরা। আগ্রহ নিয়েই বসে থাকেন দোকানিরা, কখন আসবেন একদল দর্শনার্থী, বসবেন দোকানের সামনের পাটাতনে। তা ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে, বিশেষ করে ধানের মৌসুমে শ্রমজীবীদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয়ের একমাত্র স্থল। পাশের গ্রামের লোকজনও আসেন এখানে। খোলাবাড়িয়ায় একমাত্র নৌকাযোগেই প্রবেশ করতে হয়, যত দিন পানি থাকে।
খোলাবাড়ি জিরো পয়েন্ট, মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিফলক
তিনজন ছেলে ডিঙি বাইছে। রাজহংস তাড়া করছে। সূর্যটা ওদের পশ্চিম-দক্ষিণ আকাশে; তীর্যক আলো দিচ্ছে। লগি বাইতে একটি ছেলে পড়ে গেল ডিঙির মধ্যে। বাকি দুজনের সেকি হাসি। কতই–না উল্লাস সে হাসিতে। ওরা খুবই সুখী, হাসিই তার উজ্জ্বল প্রমাণ। স্নিগ্ধ ওদের ভিডিও ও ফ্রেমবন্দী করতে ব্যস্ত। আমরা দেখছি একটু দূরে থেকে। ওরা জানে না এই শৈশবের সৌন্দর্যের আসল মানে। অথচ ওরা বড় হতে চায়, চায় দায়বদ্ধতায় বন্দী হতে।
খোলাবাড়িয়ার আনুমানিক ৩০০ ফুট পশ্চিমে মস্ত বড় ধানমাড়াইয়ের কল। কংক্রিটের স্তম্ভে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি। নৌকাওয়ালা মামা জানালেন, এখন পরিত্যক্ত, অকাজের। উত্তর পাশে মাদ্রাসা। মাদ্রাসার একটু পশ্চিমে প্রাইমারি ও হাইস্কুল। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই যেন একেকটা দ্বীপ, যেন আলাদা ভূখণ্ড, আলাদা দেশ, পানি দিয়ে পৃথক। বছরের অধিকাংশ সময়ই নৌকাযোগে স্কুল-মাদ্রাসায় আসতে হয়। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য রোমাঞ্চকর হলেও স্থানীয় ব্যক্তিদের নানা প্রতিকূলতায় দিনাতিপাত করতে হয়, যা মোটেও সুখকর নয়। তবে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকেন তাঁরা; প্রাণভরে নির্মল নিশ্বাস নেন; মাছে–ভাতে বাঙালি কালচার ধারণ করেন। বড়ই বৈচিত্র্য কৃত্রিমতার চেয়ে।
এবার ফেরার পালা। অনেকটা পথ আসতে হবে। সারা দিন বেশ আনন্দ নিলাম। কিছুটা জমিয়ে রাখলাম দেহতত্ত্বে। আবার সুযোগ হলে বিলিয়ে দেব গ্লানির পাত্রে। যেন সৌন্দর্যে ফিরে আসে; কলির বেশে। সৌন্দর্যের শেষ নেই, রূপান্তর ঘটে মাত্র। ঘাট থেকে ভ্যান নিলাম হরিশপুর বাইপাস। ছাদখোলা ভ্যান। স্বচ্ছ, খোলা আকাশের নিচে চলছে, গ্রামের মধ্য দিয়ে, আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে। অনন্য অনুভূতি, আপ্লুত মন। বিকেলের পরন্ত রোদ; গ্রাম যেন নববধূর শাড়ি, চিকচিক করছে।
বাস চলছে রাজশাহীর পথে। জে কে স্পেশাল, সৈয়দপুর থেকে ছেড়ে আসা। ভাবছি, জীবনানন্দ দাশ কী এমন দেখেছিলেন বনলতার মধ্যে? অথচ সারা নাটোরে তারে খুঁজে পেলাম না, পেলাম শুধু ভাঙা রানিমহল। এত সুন্দর প্রশংসামূলক কবিতা গেঁথে আছে আমাদের প্রত্যেকের মনে। অথচ তারে বাস্তবে পাই না, পাই শুধুই কল্পনাতে। সে কি রানি ভবানী? তা–ও কেন বলে যাননি। এই কবি-লেখকদের একটা স্বভাব, এঁরা স্পষ্ট ভাষায় কিছু বলেন না। নিজেদের মতো অন্যকেও মহাপণ্ডিত মনে করেন। এ রহস্যের উন্মোচন কবে হবে? পারব কি সে অপেক্ষার প্রহর জাগতে?
*লেখক: সবুজ আহমেদ মোল্যাহ, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্বিবদ্যালয়