হাওরকন্যার মায়ার টানে

বাংলাদেশের বিখ্যাত একজন লেখক চট্টগ্রামের ছেলে আহমদ ছফা চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় না গেলে হয়তো ‘যদ্যপি আমার গুরু’ ‘গাভী বিত্তান্ত’ ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’র মতো আরও শ্রেষ্ঠ অনেক উপন্যাস লেখা হতো না। বিশ্ববিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বিশ্বভ্রমণে বের না হলে হয়তো লেখা হতো না ‘রেহেলা’–এর মতো শ্রেষ্ঠ ভ্রমণকাহিনি।

জানার ইচ্ছা শুধু জিজ্ঞাসা নয়, জানার ইচ্ছা মনোযোগী পাঠক হওয়া। জানার ইচ্ছা রহস্য ভেদ করতে অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠা। সেই অনুসন্ধিৎসু হতে হলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে ভ্রমণের জন্য। চট্টগ্রামের পতেঙ্গার বিখ্যাত ভ্রমণ গ্রুপ ‘লাঠিয়াল’ সদস্যরা স্বদেশকে জানার আকাঙ্ক্ষায় দেশের বিভিন্ন জেলায় ছুটে চলেন। এবারের ভ্রমণের তালিকায় ছিল বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিম ও মরমি কবি হাসন রাজার বিখ্যাত সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে।

পূর্বের ঘোষণা অনুযায়ী, প্রথমবারের মতো লাঠিয়ালদের সঙ্গে ভ্রমণে যুক্ত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। ১৯ সদস্যের দল নিয়ে ২০ সেপ্টেম্বরে আমরা যাত্রা শুরু করি। নতুন সদস্যদের সঙ্গে পরিচিতি, গল্প, আড্ডায় রাত ১১টায় বাস কুমিল্লায় বিরতি দেয়। বাসেই ডিনার সেরে ফেলি। বিরতির পর যাত্রাপথে কেউ ঘুমে কেউ আড্ডায়। এভাবে চলতে চলতে সকাল সাতটায় পৌঁছে গেলাম সুনামগঞ্জ বাসস্টেশনে।

সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর তীরে বসে মরমি কবি হাসন রাজা গলা ছেড়ে গেয়েছিল, ‘লোকে বলে বলেরে ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার’। আসলে শুধু ঘরবাড়ি নয়, সুস্থতাই আল্লাহর দেওয়া শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। বাকি সব হিসাব আসে এর পরেই। চাকরি, পরিবার সমাজ আমাদের সময়কে ভাগ করে নিয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও থাকে বড় কাজের পরিকল্পনা। অনেকে বিছানায় রেস্টের জন্য গেলেও মাথায় ঘোরে অফিস কিংবা ব্যবসার যাবতীয় হিসাব। এসব ব্যস্ততা অনেক সময় তিক্ততার কারণ হয়। মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। হয়তো এসব মাথায় নিয়েই দালাই লামা বলেছিলেন, ‘বছরে অন্তত একবার নতুন কোনো জায়গায় ভ্রমণ করা উচিত।’ একমাত্র ভ্রমণই আপনাকে বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি এবং আনন্দে জাগিয়ে তুলতে পারে।

বাসে দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে সকালে নতুন শহর সুনামগঞ্জে পা রেখেছি। সকালে পানসি রেস্টুরেন্ট খেলাম খিচুড়ি। খিচুড়ির পর চা খেয়ে সবাই একমত, দামের চেয়ে মানে ভালো সুনামগঞ্জ বাসস্টপেজের সেরা এ হোটেল।

খাওয়া শেষে আমরা দুটি রাইডার ভাড়া করে নিলাম তাহিরপুর নৌঘাট যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সবুজ, শ্যামল গ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের গাড়ি। আমাদের আলোচনায় বিষয় হয়ে উঠল, বছরের অর্ধেক সময় পানিতে ডুবে থাকা এখানকার মানুষ কীভাবে টিকে থাকার অবলম্বন তৈরি করে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবর্তন হয় কাজের ধরন। কখনো ধান, কখনো নানা রকমের সবজি চাষ, গরু, হাঁস, মুরগি পালন, কখনো মাছ শিকার ইত্যাদি। রাস্তা ভালো হওয়ায় প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে তাহিরপুর নৌঘাটে গিয়ে নামি।

বর্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের জন্য উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হাউসবোট। সাজসজ্জা আর আধুনিক সুযোগ–সুবিধার ওপর ভিত্তি করে দুই দিনের জন্য ২০ হাজার থেকে শুরু করে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বিলাসবহুল হাউসবোট ভাড়ায় পাওয়া যায়। আমরা হাউসবোট আগেই বুকিং দিয়েছিলাম। তাহিরপুর নৌঘাটে নিজেদের বোট খুঁজে ব্যাগ রেখে মাঝিকে নিয়ে আশপাশে বাজারের খবর নিলাম। তারেক ও ফারুক ভাই গেল থানায় ইনফর্ম করতে। সবার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিয়ে রেজিস্ট্রি না করলে বোট ভ্রমণে অনুমতি দেয় না প্রশাসন। আমি, ইরফান, শাহনুর ও দেলোয়ার ভাই বাজারে গেলাম। দুই দিনের জন্য বাজার করলাম। নৌকা হাওরের দিকে যাত্রা শুরু করে দুপুর ১২টার দিকে।

সুনামগঞ্জকে বলা হয় ‘হাওরকন্যা’। জেলার এ পরিচিতির মূলে আছে টাঙ্গুয়ার হাওর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নয়নাভিরাম টাঙ্গুয়ার হাওর এখন পর্যটকের কাছে অতি প্রিয় স্থান। হাওরের মাঝখানে ওয়াচ টাওয়ার। প্রতিটি বোট পর্যটকদের নিয়ে প্রথমে ওয়াচ টাওয়ার যায়। টাওয়ারের নিচেই সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে সবুজ হিজল ও করচগাছ। হাওরকে বাগানের মতো সাজিয়ে রেখেছে গাছগুলো। বোট টাওয়ারের কাছে যেতেই স্থানীয় লোকজন ইঞ্জিনচালিত  ছোট ছোট নৌকা নিয়ে যেন অভ্যর্থনা জানায়। এই ছোট নৌকা ছাড়া বনের ভেতরে প্রবেশ করা অসম্ভব। আমরা চারটি নৌকা ভাড়া করে লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম।

নৌকা থেকে হাওরের নীল জলে গোসল করার এটাই সবচেয়ে সুন্দর স্থান। গোসলের পর যখন শরীরে শীতল অনুভব হয়, তখন নৌকাতে ভাসমান ব্যবসায়ীরা রং–চা, বিস্কুট নিয়ে হাজির। তারা পর্যটকদের ছোট ছোট নৌকায় ঘোরায়। কেউ চা, নাশতা বিক্রি করে। রং–চায়ে চুমুক দিয়ে সবাই শরীর একটু চাঙা করে নিলাম। দলের সবাই নৌকা জড়ো করে বসে গানের আসর বসিয়েছে...

‘এই সাগর পারে আইসা আমার মাতাল মাতাল লাগে
এই রূপ দেখিয়া মন পিঞ্জিরায় সুখের পঙ্খী ডাকে’

গানে গানে দ্রুত কেটে যায় আনন্দের সময়গুলো। বোটের মাঝি ডাক দিয়ে সময় ফুরিয়ে আসার ইঙ্গিত দেন। রান্না বোটেই চলছিল। সবাই আবার বড় বোটে উঠে ফ্রেশ হয়ে হাওরের পাঁচমিশালি মাছের স্বাদে দুপুরের খাবার শেষে বোট চলতে শুরু করে টেকেরঘাটের দিকে।

টাঙ্গুয়ার হাওরের উত্তরে সবুজে মোড়া ভারতের মেঘালয় পাহাড়। সেই পাহাড়ের পাদদেশ সীমান্তের কাছেই বাংলাদেশের টেকেরঘাট। আমাদের বোট টেকেরঘাটে নোঙর করে সন্ধ্যায়। সারা দিন আকাশে মেঘ ও সূর্যের লুকোচুরি চললেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে নেমেছে মুষলধারায় বৃষ্টি। হাওরবিলাসে যদি বৃষ্টির আসে, তবে বুঝে নেবেন, আপনি একটি সেরা সময়ে আছেন। বোটের জানালা দিয়ে হাওরের পানিতে বৃষ্টি পড়ার ঝুপঝুপ শব্দ আপনাকে ব্যাকুল করে তুলবে। বৃষ্টি একটু থামার পর সবাই বোটের ছাদে গিয়ে গানে মেতে উঠেছে। মিসবাহ ভাই গলা ছেড়ে গিটারে সুর তুলেছে,

‘হইয়া আমি দেশান্তরী
দেশ বিদেশে ভিড়াই তরীরে...’

নাদিম ভাইকে নিয়ে বাবুর্চির কাছে দিনের মতো রাতের খাবারও নিজেরা রান্না করার কথা জানিয়ে দিলাম। সকালে তাহিরপুর বাজার থেকে ছয়টি হাঁস নিয়েছিলাম, জবাই থেকে কাটাকাটিসহ রান্নার সব দায়িত্ব নাদিম ভাই পালন করেছেন। রান্নাও একটি আর্ট—এটা নাদিম ভাই আগেও প্রমাণ করেছেন। রাতে অবস্থানের জন্য নিরাপত্তা বিবেচনায় বোট তীর থেকে একটু হাওরের মাঝখানে নেওয়া হয়েছে। বিশাল বিশাল সবুজ পাহাড়ে ক্যাম্প বসিয়ে লাইট জ্বালিয়ে সীমানা পাহারা দিচ্ছে ভারতীয় বর্ডার গার্ড। রাত যত গভীর হয় চারদিকে নেমে আসে নীরবতা। ঐদিকে হাঁসের ঝাল ফ্রাই, সঙ্গে আলুভর্তা ও পাতলা ডাল দিয়ে রাতের রেসিপি তৈরি। খাবারের আনন্দের প্রতিযোগিতা শেষে হাওরে ভাসমান বোটে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম।

দিনের কাজে যত ক্লান্তি, রাতের ঘুম তত গভীর। রাতে ভালো ঘুম হওয়া মানেই সকালে সতেজ ও ফুরফুরে দেহ–মন। সকাল ছয়টায় উঠে সবাই রেডি নতুন গন্তব্যে যাওয়ার উদ্দেশে। বোট থেকে নেমেই বাংলাদেশের কাশ্মীরখ্যাত শহীদ সিরাজ লেক তথা নিলাদ্রী লেক। খুব কাছেই ভারতের অংশে সবুজে ঘেরা পাহাড়ের ঝরনা থেকে পরিষ্কার পানি এসে লেকে পড়ে। লেক থেকে গড়িয়ে পানি গিয়ে পড়ে হাওরে। সুনামগঞ্জ ভ্রমণে এ লেক পর্যটকদের বেশি আকর্ষণ করে। কেউ নৌকাবাইচ, কেউ সাঁতার কেটে গোসলে কাটিয়ে দেয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

এখানে দ্রুত যাতায়াতে অন্যতম বাহক মোটরসাইকেল। টিম লিডার ইরফান ১০টি ভাড়া করে নিলেন। এবারের গন্তব্য হোন্ডায় চড়ে লালঘাট ঝরনা পরিদর্শন। মূল ঝরনা ভারতের সীমানার ভেতরে পানি ঝুপঝুপ শব্দে দ্রুতবেগে এসে মিশে যায় হাওরে। ফিরতি পথে লাকমাছড়া ঝরনা। সিলেটের বিছনাকান্দির মতো এটা খুবই সুন্দর জায়গা। সাইনবোর্ড লাগানো আছে বাংলাদেশের শেষ সীমানা, ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে আসা পাথর আর কয়লা কণা সংগ্রহে ব্যস্ত স্থানীয় লোকজন।

ভৌগোলিক অবস্থান আমাদের কিছুটা দুর্বল করে রেখেছে। আমাদের ভূমি ভারত থেকে অনেক নিচু। বাংলাদেশের কতটি অংশে দিয়ে ভারতের পানি প্রবেশ করে, দুই দেশের কারও কাছে সঠিক তথ্য আছে কি না সন্দেহ আছে। তবে এই পানি অভিশাপ হিসেবে ধরলেও পানির সঙ্গে আসা বালু, পাথর, কয়লা। এটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ বলা যায়। স্থানীয় লোকজনের আয়ের মূলে অবদান রাখে পানিতে আসা এসব প্রাকৃতিক সম্পদ।

লাকমাছড়া থেকে বের হয়ে হোন্ডা গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। ধানের চারাগুলো হাওয়ায় দুলে মায়াবী আকর্ষণ ছড়াচ্ছে। ৩০ মিনিটে পৌঁছে গেলাম সুনামগঞ্জের আরেক বিখ্যাত স্থান শিমুলবাগানে। মানুষের সুন্দর মনের সুন্দর পরিকল্পনা যেমন বদলে দিতে পারে একটি পরিবেশ, তেমনি দুষ্ট মনের পরিকল্পনা নষ্ট করে দেয় একটি সাজানো বাগান। যেই নিলাদ্রী লেককে কাশ্মীরের সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, সেই লেকের সবুজ পাড়ের ওপর দিয়ে পাথর, কয়লার গাড়ি চালিয়ে নষ্ট করে ফেলেছেন ব্যবসায়ীরা।

কিন্তু শিমুলবাগান ভিন্ন এক সৃষ্টি। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, মাঝে জাদুকাটা নদী আর এপাড়ে শিমুলবাগান। সব মিলেমিশে গড়ে তুলেছে প্রকৃতির এক অনবদ্য কাব্য। জয়নাল আবেদীন নামে স্থানীয় এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর প্রচেষ্টায় বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে মনোমুগ্ধকর এই শিমুলবাগান।
বাগানে প্রবেশ করতেই স্থানীয় কিছু যুবক ঘোড়া নিয়ে হাজির হয়। ১০০–২০০ টাকা দিলেই ঘোড়াই চড়িয়ে পুরো বাগান ঘুরিয়ে আনবে। সারি সারি গাছের সবুজ বাগানের মধ্য দিয়ে ঘোড়া নিয়ে ছুটে চলার আনন্দে ভরে ওঠে মন। ভরা দুপুরে সবাই ছবির স্মৃতি নিয়ে রওনা হলাম বারিক টিলার উদ্দেশে। পাহাড়ি ঢলে জাদুকাটা নদীর পানি বেড়ে বিলে উঠেছে। ঢেউয়ের স্রোতে দ্রুতগতিতে বয়ে চলা পানিতে পায়ে হেঁটে কিছু পথ এসে আবার হোন্ডায় চড়ে পৌঁছে গেলাম বারিক টিলা।
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী যত স্থান এর আগে দেখেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এই জাদুকাটা নদীর তীরে বারিক টিলায় দাঁড়ালেই অনুভব হয়। আমাদের দেশের গানের কথাগুলো এখানে বাস্তবে অবিকল ফুটে ওঠে...

যখন তোর ঐ গাঁয়ের ধারে
ঘুঘু ডাকা নিঝুম কোন দুপুরে,
হংস মিথুন ভেসে বেড়ায়
শাপলা ফোটা টলটলে কোন পুকুরে।
নয়ন পাখি দিশা হারায়
প্রজাপতির পাখায় পাখায়,
অবাক চোখে পলক পড়ে না
রূপ দেখে তোর কেন আমার
নয়ন ভরে না।
তরে এত ভালোবাসি তবু পরান জুড়ে না
হায়রে আমার মন মাতানো দেশ...

বারিক টিলার ওপরে রং–চা খেয়ে রওনা হয়ে আমরা ‘জয় বাংলা’ নামক বাজারে এসে নামলাম। স্থানীয় লোকজনের জন্য বিখ্যাত এ বাজারে দেশি এবং ভারতের বিভিন্ন পণ্যও পাওয়া যায়।

সীমান্তের কাছে সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে নীল পরিষ্কার পানির লেকে সাঁতার কেটে গোসল শেষে পাশের মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করে বোটে উঠি। দুপুরের খাবার খেতে খেতেই তাহিরপুরে দিকে ছুটে চলতে থাকে বোট। বিকেল পাঁচটায় বোট তাহিরপুর ঘাটে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে দেড় ঘণ্টায় লেগুনায় চড়ে আমরা বাসস্ট্যান্ডে আসি। সাড়ে সাতটায় বাসে চড়ি আপন জেলা চট্টগ্রামে ফেরার আশায়।