শিক্ষাভ্রমণে সোনারগাঁওয়ে এক দিন
ভ্রমণ মানুষের জ্ঞানের পরিধি অনেকাংশে বৃদ্ধি করে। ভ্রমণে রয়েছে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা। মানবজীবনের পুরোটাই ছাত্রজীবন। কেননা, পাঠ্যবই ছাড়াও মানুষ মানুষের কাছ থেকে ও প্রকৃতির কাছ থেকে কিছু না কিছু শিক্ষা লাভ করে থাকে সারা জীবন।
ছাত্রজীবন শিক্ষালাভের সময়। তবে এ শিক্ষা লাভ শুধু পাঠ্যপুস্তকের নয়। পুঁথিগত বিদ্যাই সবকিছু নয়। কবির ভাষায় বলা হয়েছে—গ্রন্থগত বিদ্যা আর পরহস্তে ধন/ নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন। এ জন্য ছাত্রজীবনে শিক্ষামূলক ভ্রমণ খুব গুরুত্বপূর্ণ।
এটি আমাদের ধরাবাঁধা একঘেয়ে জীবনকে নতুনমাত্রা দান করে। শিক্ষামূলক ভ্রমণের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান অথবা কোনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত স্থান অবলোকনের সুযোগ পাই। এসব স্থান সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্ব জানতে পারি। এ ভ্রমণ জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে।
সে শিক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত এবং সাবেক মাদারীপুর জেলার শিক্ষার্থীদের সংগঠন মাদারীপুর জেলা ছাত্রকল্যাণের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয় শিক্ষা ও আনন্দভ্রমণ। ২৬ মে আমাদের ভ্রমণের দিন নির্ধারিত হয়। আমাদের ভ্রমণের স্থান ছিল সোনারগাঁও ও পানাম সিটি। নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্তর্গত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মোগড়াপাড়া ক্রসিং থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তরে সোনারগাঁও অবস্থিত। সবুজ বন-বনানী আর অনুপম স্থাপত্যশৈলীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য়ের নান্দনিক ও নৈসর্গিক পরিবেশে ঘেরা বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁও।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে হিন্দু আমলের রাজধানী এখানেই অবস্থিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তী সময় মুসলিম শাসকদের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম থেকে সোনারগাঁও নামের উদ্ভব বলে কারও কারও ধারণা রয়েছে। অন্য ধারণামতে বার ভূঁইয়াপ্রধান ঈশা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবির নামানুসারে সোনারগাঁও নামকরণ করা হয়।
বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদের মধ্যে শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সোনারগাঁও একটি গৌরবময় জনপদ। আনুমানিক ১২৮১ খ্রিস্টাব্দে এ অঞ্চলে মুসলিম আধিপত্যের সূচনা হয়। মধ্যযুগে এটি মুসলিম সুলতানদের রাজধানী ছিল। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ঢাকা সুবে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সোনারগাঁও ছিল পূর্ববঙ্গের রাজধানী। ঈশা খাঁ ও তাঁর বংশধরদের শাসনামলে সোনারগাঁও ছিল পূর্ববঙ্গের রাজধানী। সোনারগাঁওয়ের আরেকটি নাম ছিল পানাম। সোনারগাঁও থেকে খানিকটা দূরেই রয়েছে পানাম সিটির সেসব শেষ নিদর্শন। সারি সারি পুরোনো বাড়ি আর তাতে স্পষ্ট রয়েছে আদিমতার ছাপ। বাড়িগুলো দেখলে মনে হয় আমি ফিরে গিয়েছি সেই পুরোনো দিনে। সে সঙ্গে আমাদের নিজস্ব উদ্যোগে ছিল কিছু সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। অন্ধকারে হাঁড়ি ভাঙা, পিলো পাসিংসহ নানা মজার খেলা। এসব আনন্দ উপভোগ ও সারা দিন দেশের এসব আদিম জনপথের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে সময় ফুরিয়ে এল।
খুব ভোরে রওনা হয়ে আবার ঠিক সন্ধ্যে নামার আগেই আমরা ধরেছিলাম ফেরার পথ। সোনারগাঁও আমাদের জানাল তার সুদীর্ঘকালের ইতিহাস আর অবলোকন করাল তার প্রাকৃতিক সব নৈসর্গিক দৃশ্য। ভ্রমণ থেকেই আমাদের মধ্যে প্রসার ঘটে শিক্ষার। আসে সৃজনশীল চিন্তা। বাংলার ইতিহাস জানতে তাই এসব প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ভ্রমণের গুরুত্ব অপরিসীম। সোনারগাঁওয়ের শিক্ষাভ্রমণ সত্যিকার অর্থেই আমাদের শিক্ষার জায়গাটি আরও সমৃদ্ধ করেছে।
*লেখক: মোহাম্মদ ইয়াছিন ইসলাম, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
***নাগরিক সংবাদে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারবেন যে কেউ। ঠিকানা [email protected]